ভেরিকোজ ভেইন কি? ভেরিকোজ ভেইন (Varicose veins) হলো রক্তনালীর (শিরা) একটি রোগ। হার্ট সারা শরীরে রক্তনালীর মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালনের কাজ করে থাকে। ধমনীর মাধ্যমে রক্ত হার্ট থেকে সারা শরীরে পৌঁছে যায় এবং শিরার মাধ্যমে পুনরায় রক্ত হার্টের দিকে ফিরে আসে। ভেইন (Veins) হলো শিরার ইংরেজি প্রতিশব্দ। ভেরিকোজ ভেইন সাধারণত পায়ের শিরায় হয়ে থাকে। অর্থাৎ পায়ের শিরা আঁকাবাঁকা অবস্থায় নীল হয়ে ফুলে যেতে দেখা যায়।
ভেরিকোজ ভেইন কেন হয়, কাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, কিভাবে রোগ নির্ণয় করা হয়, চিকিৎসা ও জটিলতা সহ ভেরিকোজ ভেইন প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
ভেরিকোজ ভেইন (Varicose Veins) এর কারণগুলি কী কী?
শিরার ভেতর একমুখী কপাটিকা বা ভালভ (Valves) থাকে যা হার্টের দিকে রক্ত প্রবাহ হতে সাহায্য করে। কোনো কারণে ভালভের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হলে রক্ত শিরা থেকে ভালোভাবে প্রবাহিত হতে পারে না বরং শিরাতে জমা হয়ে শিরা ফুলে উঠে। (Cleveland Clinic, 2021)
পায়ের শিরা হার্ট থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করে এবং গ্র্যাভিটির প্রভাবে রক্ত হার্টে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটা কিছুটা কঠিন হয়ে থাকে। অর্থাৎ হাতের রক্ত যত সহজে হার্টের দিকে ফিরে যেতে পারে পায়ের ক্ষেত্রে রক্ত শরীরের উপরের দিকে যেতে হয় (হার্টের দিকে ফিরে যাওয়া) বলে বিষয়টা তুলনামূলক কিছুটা কঠিন হয়ে থাকে। তাই ভেরিকোজ ভেইন সাধারণত পায়ের শিরায় হতে দেখা যায়।
কাদের ক্ষেত্রে ভেরিকোজ ভেইন হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে?
১. সাধারণত বয়স্কদের ক্ষেত্রে ভেরিকোজ ভেইন হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। কারণ বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শিরায় থাকা ভালভের কার্যক্ষমতা কমে যায়। এছাড়াও পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
২. বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, যারা জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য পিল গ্রহণ করেন এবং মেনোপজের সময়ে শরীরে হরমোনের পরিবর্তন হওয়ার ফলে ভেরিকোজ ভেইন হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
যারা দীর্ঘসময় পর্যন্ত দাঁড়িয়ে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে ভেরিকোজ ভেইন হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। কারণ দীর্ঘসময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে পায়ের শিরায় রক্ত সঞ্চালন কিছুটা ব্যাহত হয়।
৩. বংশগত প্রভাবে ভেরিকোজ ভেইন হতে পারে। অর্থাৎ মা বাবা অথবা ভাই বোনদের মধ্যে কারো ভেরিকোজ ভেইন থাকলে সেই সন্তান অথবা সহোদরের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়াও যাদের ধুমপানের অভ্যাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ভেরিকোজ ভেইন হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
৪. শরীরের ওজনের সাথে ভেরিকোজ ভেইন হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে পায়ে অতিরিক্ত চাপ পড়ার কারণে ভেরিকোজ ভেইন হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের ১৪টি টিপস জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
ভেরিকোজ ভেইন (Varicose Veins) এর লক্ষণগুলি কী কী?
ত্বকের ঠিক নিচেই শিরা থাকে। ভেরিকোজ ভেইনের ক্ষেত্রে শিরায় রক্ত জমা হয়ে ফুলে যায়। তাই ত্বকের উপরিভাগে আঁকাবাঁকা ফোলাভাব লক্ষ্য করা যায়। শিরায় প্রবাহিত হওয়া রক্ত কিছুটা নীল বর্ণের হয়ে থাকে বলে ফোলাভাব (শিরা) নীল বর্ণের দেখায়।
সাধারণত হাঁটুর নিচের অংশে ভেরিকোজ ভেইন দেখা যায়। তবে হাঁটুর উপরিভাগেও হতে পারে। ফোলাভাব ছাড়া আরো যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ
- রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয় বলে পেশি সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং পা ভারী মনে হয়।
- পায়ের শিরায় টান ধরে (ঘুমের সময় এই সমস্যা বেশি হয়ে থাকে)
- পেশিতে কামড়ানি বা ব্যথা হয়।
- পায়ে চুলকানি হতে পারে।
ভেরিকোজ ভেইন (Varicose Veins) কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
সাধারণত ভেরিকোজ ভেইন নির্ণয় করার জন্য তেমন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে না। চিকিৎসক রোগীর লক্ষণ দেখে বুঝতে পারেন যে ভেরিকোজ ভেইন হয়েছে। তবে শিরার অবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার জন্য ডপলার আলট্রাসনোগ্রাফি (Doppler ultrasonography) করা হয়ে থাকে।
ভেরিকোজ ভেইন (Varicose Veins) এর চিকিৎসা
ভেরিকোজ ভেইন খুব তীব্র প্রকৃতির কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করলে সাধারণত এর জন্য কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় না। চিকিৎসক কতিপয় নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন যার মাধ্যমে সমস্যা নিয়ন্ত্রণে থাকে। (Gabbey, 2019)
- বিশেষ ধরনের (Compression Stocking) মোজা পরিধান করা।
- শরীরের তুলনায় পা কিছুটা উঁচুতে রেখে ঘুমানো। এর জন্য পায়ের নিচে বালিশ ব্যবহার না করে বরং পায়ের দিকে বিছানা কিছুটা উঁচু রাখতে হবে।
তীব্র প্রকৃতির সমস্যার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ বা সার্জারি করতে হবে। ভেরিকোজ ভেইন এর জন্য দুই ধরনের সার্জারি রয়েছে। একটি হলো সাধারণ সার্জারি আর অন্যটি হলো লেজার সার্জারি যা আধুনিক ও কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে। সার্জারির পর চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করতে হবে। অন্যথায় পুনরায় ভেরিকোজ ভেইন হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ভেরিকোজ ভেইন এর চিকিৎসার জন্য একজন ভাস্কুলার সার্জনের শরণাপন্ন হতে হবে। ভাস্কুলার শব্দটি দ্বারা রক্তনালী বোঝানো হয় অর্থাৎ এই ধরনের সার্জনরা শুধুমাত্র রক্তনালী নিয়ে কাজ করে থাকেন।
ভেরিকোজ ভেইন এর জটিলতা
ভেরিকোজ ভেইন মারাত্মক প্রকৃতির কোনো রোগ নয়। এই রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা না হলে তেমন কোনো জটিলতা দেখা দেয় না। তবে ধীরে ধীরে ভেরিকোজ ভেইন এর তীব্রতা বাড়তে থাকে।
এছাড়াও কোনো ব্যক্তি যদি পুলিশ অথবা আর্মিতে যোগদান করতে চায় তবে তাদের জন্য ভেরিকোজ ভেইন থাকলে প্রার্থীর অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। তাদের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
তীব্র প্রকৃতির ভেরিকোজ ভেইন এর জন্য চিকিৎসা গ্রহণ করা না হলে জটিলতা হিসেবে যেসব সমস্যা হতে পারে তা হলোঃ
- ফুলে যাওয়া শিরার পাশে তীব্র ব্যথাযুক্ত আলসার হতে পারে।
- শিরা ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে যার জন্য জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে।
ভেরিকোজ ভেইন কখনোই প্রাণঘাতী হয়ে উঠে না। তবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
কিভাবে ভেরিকোজ ভেইন (Varicose Veins) প্রতিরোধ করা যায়?
ভেরিকোজ ভেইন প্রতিরোধের শতভাগ কার্যকরী কোনো পদ্ধতি নেই। তবে কতিপয় নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে এই রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব হয়। যেমনঃ
- দীর্ঘসময় একটানা দাঁড়িয়ে না থেকে বরং কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যে একটু হাঁটাহাঁটি করতে হবে।
- উচু হিলের জুতা ও টাইট প্রকৃতির পায়জামা বা প্যান্ট পড়া যাবে না।
- কম লবণ সমৃদ্ধ ও প্রচুর আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে।
- ধুমপানের অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করা জরুরী।
- শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
References
Cleveland Clinic. (2021, 12 29). Varicose Veins. Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/4722-varicose-veins
Gabbey, A. E. (2019, March 08). Varicose Veins. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/varicose-veins
Last Updated on November 12, 2023
Leave A Comment