স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep apnea) শব্দটি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় Sleep (ঘুম) ও Apnea (এটি একটি গ্রীক শব্দ যার অর্থ হলো শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া) অর্থাৎ কোনো কারণবশত ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep apnea) বলা হয়।
স্লিপ অ্যাপনিয়া মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে। সবচেয়ে কমন হলো অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (OSA- Obstructive sleep apnea) যা নাক ডাকা রোগ নামে অনেকের কাছে পরিচিত হলেও মূলত নাক ডাকা হলো এই রোগের একটি লক্ষণ মাত্র।
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া এর কারণ, কাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা, জটিলতা এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে আজকের অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া কি?
অবস্ট্রাকটিভ শব্দটি দ্বারা বাধাগ্রস্ত হওয়া বোঝানো হয়। অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চলার পথে (নাক, মুখগহ্বর, গলা অথবা শ্বাসনালীতে) বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ফলে স্লিপ অ্যাপনিয়া হলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা হয়।
শরীরের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী নাক বা মুখ দিয়ে বায়ু (শ্বাস) ঢুকে গলার অংশ পার হওয়ার পর শ্বাসনালীর মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে। আবার ফুসফুস থেকে বায়ু (প্রশ্বাস) একই পথে বাইরে বেরিয়ে আসে। নাক, মুখগহ্বর, গলা অথবা শ্বাসনালীতে কোনো বাঁধা থাকলে তা শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়। এমতাবস্থায় ডায়াফ্রাম সহ বুকের অন্যান্য পেশিগুলো এই বাঁধা অতিক্রম করে শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চালু রাখার চেষ্টা করে যার ফলে ঘুমের ব্যাঘাত সহ নাক ডাকা সমস্যা হয়ে থাকে।
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া এর কারণ
যে সমস্ত বিষয়গুলোকে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা হলোঃ
- শরীরের অতিরিক্ত ওজন
- ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস
- হাঁপানি (Asthma)
- ডায়াবেটিস
- উচ্চ রক্তচাপ
- নাকে পলিপাস
- নাকের হাড় বাঁকা হয়ে যাওয়া
- টনসিলাইটিস (Tonsillitis)
- এডিনয়েড গ্রন্থিতে ইনফেকশন
- ঘুমের ওষুধ ও উদ্বিগ্নতা নিরাময়ের ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
- স্বাভাবিকের তুলনায় সরু অথবা লম্বা প্রকৃতির গলা
যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে। তবে কম বয়সী মানুষের তুলনায় বয়স্কদের ক্ষেত্রে বেশি প্রবণতা দেখা যায়। এছাড়াও মহিলাদের তুলনায় পুরুষ মানুষের ক্ষেত্রে ২ থেকে ৩ গুণ পর্যন্ত বেশি ঝুঁকি রয়েছে। তবে মেনোপজের পরে নারীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
যাদের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে অর্থাৎ মা বাবা অথবা ভাই বোনদের মধ্যে কারো অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকলে সেই সন্তান বা সহোদরের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অনেক বেশি ঝুঁকি থাকে।
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া এর লক্ষণ
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কমন একটি লক্ষণ হলো ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা। তবে নাক ডাকা মানেই অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া নয়, আবার অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার ক্ষেত্রে নাক ডাকা লক্ষণ থাকবেই এমন কোনো কথা নেই। নাক ডাকা ছাড়াও এই রোগের ক্ষেত্রে আরো যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ (Mayo Clinic, 2021)
- রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং অস্থিরতা বোধ হয়, প্রচন্ড ঘাম হয়, মুখ ও গলা শুকিয়ে যায়।
- সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর মাথাব্যথা হয়
- রাতে বার বার ঘুম ভেঙ্গে যায় যার ফলে ক্লান্তি দূর হয় না এবং দিনের বেলায় খুব ঘুম পায়।
- ভালো ঘুম হয় না যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং কাজের প্রতি মনোনিবেশ করতে অসুবিধা হয়।
- শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা যায় যার ফলে যৌন সক্ষমতা কমে যায়।
- মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উদ্বিগ্নতা (Anxiety) ও বিষন্নতা (Depression) দেখা যায়।
শিশুদের ক্ষেত্রে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া
শিশুদের ক্ষেত্রে টনসিলাইটিস, এডিনয়েড ইনফেকশন, নাকে পলিপাস অথবা হাড় বেঁকে যাওয়া সমস্যা থেকে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে লক্ষণ হিসেবে দেখা যায়- (Khatri, 2021)
- নাক ডাকা
- নিঃশ্বাসে শব্দ হওয়া
- মুখ থেকে লালা পড়া
- রাতে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
- রাতে বিছানায় প্রস্রাব করা
- ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে হাত ও পা নাড়াচাড়া করা
- চঞ্চল স্বভাব ও পড়ালেখার প্রতি মনোযোগ কমে যাওয়া
রোগ নির্ণয় (Diagnosis)
ছোট বড় সবার জন্যই অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক রোগী ও রোগীর সাথে একই বিছানায় রাতে থাকেন এমন ব্যক্তির কাছে লক্ষণ শোনার পর রোগীকে শারীরিক পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেমনঃ
- স্লিপ স্টাডি (Overnight sleep study/ Polysomnogram)
- রক্ত পরীক্ষা (Blood tests)
- এক্সরে (X-ray)
- আল্ট্রাসনোগ্রাফি
- এমআরআই (MRI) ইত্যাদি
চিকিৎসা
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসার জন্য যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে তা হলোঃ
- এলার্জি জনিত সমস্যা (বিশেষ করে এলার্জিক রাইনাইটিস) থাকলে এলার্জি নিয়ন্ত্রণের জন্য এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ সেবনের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে।
- সি-প্যাপ যন্ত্র (CPAP– Continuous positive airway pressure): এটি মুখে মাস্কের মতো পড়তে হয় যা শ্বাসনালীতে অনবরত শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চালু রাখতে সাহায্য করে।
- Oral devices: এটিও একধরনের যন্ত্র যা মুখের ভেতর ব্যবহার করা হয় এবং শ্বাসনালীতে চাপ পড়তে দেয় না।
- সার্জারিঃ নাক, গলা অথবা শ্বাসনালীতে অস্বাভাবিক টিস্যু বৃদ্ধি থাকলে তা সার্জারির মাধ্যমে অপসারণ করা হয়।
চিৎ হয়ে শোয়ার ফলে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার লক্ষণ বেড়ে যায়। তাই রাতে ঘুমানোর সময় চিৎ হয়ে না শুয়ে বরং কাত হয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে। এছাড়াও একটু উঁচু বালিশ ব্যবহার করলে উপকারিতা পাওয়া যেতে পারে।
জটিলতা
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার ফলে রাতে বার বার ঘুম ভেঙ্গে যায় অর্থাৎ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে থাকে যা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। দীর্ঘদিন যাবত অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভুগলে এবং যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে যেসব জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে তা হলোঃ
- দিনে প্রচন্ড ঘুম পায় যার ফলে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়।
- যারা ড্রাইভিং করেন তাদের ক্ষেত্রে চোখে ঘুম ঘুম ভাব দুর্ঘটনা ঘটার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
- উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হওয়া
- ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বা টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়া
- রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল (LDL– low density lipoprotein) এর মাত্রা বেড়ে যাওয়া
- লিভারের সমস্যা ইত্যাদি
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার দরুণ শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুনরায় শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চালু না হলে সেক্ষেত্রে মৃত্যু হতে পারে। অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া জনিত মৃত্যু খুব বিরল ঘটনা অর্থাৎ সচরাচর এমনটি হতে দেখা যায় না।
প্রতিরোধের উপায়
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া প্রতিরোধের শতভাগ কার্যকরী কোনো পদ্ধতি নেই। তবে কতিপয় নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়।
- শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- ধুমপান ও মদ্যপান করা যাবে না।
- রাতে যেন ভালো ঘুম হয় সেজন্য প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে।
- ঘুমানোর আগে চা ও কফি পান করা যাবে না।
- ঘরের আলো, তাপমাত্রা ও বিছানা আরামদায়ক হতে হবে।
References
Khatri, M. (2021, November 05). Obstructive Sleep Apnea (OSA). Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/sleep-disorders/sleep-apnea/understanding-obstructive-sleep-apnea-syndrome
Mayo Clinic. (2021, July 27). Obstructive sleep apnea. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/obstructive-sleep-apnea/symptoms-causes/syc-20352090
Last Updated on June 4, 2023
Leave A Comment