বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে হামে (Measles) আক্রান্ত হয়ে ১২৮০০০ মানুষ মৃত্যু বরণ করেন যার মধ্যে বেশিরভাগ হলো পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এবং ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন নাই এমন ব্যক্তি। বিশ্বব্যাপী‌ ব্যাপকভাবে ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগে (১৯৬৩ সালের আগে) প্রতি ২ থেকে ৩ বছর অন্তর অন্তর মহামারী আকারে হামের আক্রমণ হতো এবং বছরে ২.৬ মিলিয়ন মানুষ মারা যেত। 

ভ্যাকসিন কার্যক্রমের ফলে হামের সংক্রমণ অনেক কমে গেছে। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাম হতে দেখা যায়। কাদের ক্ষেত্রে হাম হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, হামের লক্ষণ কি কি, কিভাবে রোগ নির্ণয় করা হয়, হাম হলে করণীয়, চিকিৎসা ব্যবস্থা, জটিলতাগুলো কি কি এবং হাম প্রতিরোধে ভ্যাকসিন গ্রহণ করা ছাড়াও আরো কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে সেই সম্পর্কে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

হাম কি? (Measles meaning in Bengali) 

হামের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Measles যা ভাইরাস ঘটিত একটি সংক্রামক রোগ। একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে এই রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস অন্যান্য সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটিকে বায়ুবাহিত সংক্রামক রোগও বলা হয়। কারণ এই রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। 

হাম রোগের কারণ

Measles Reasons

হামের জন্য দায়ী ভাইরাসের নাম হলো Morbillivirus যা খুব ছোঁয়াচে প্রকৃতির একটি ভাইরাস। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে নির্গত ড্রপলেটের সাথে ভাইরাস নির্গত হয়। অতঃপর সেই ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে নিকটবর্তী সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে সংক্রমণ ঘটানোর সুযোগ পায়। (cleveland clinic, 2021)  

এছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে কোলাকুলি করা, হাত মেলানো, ব্যবহৃত জিনিসপত্র বা খাবার অন্যদের সাথে শেয়ার করার কারণে এই ভাইরাসের (Morbillivirus) সংক্রমণ ঘটে থাকে। 

হাম কাদের প্রভাবিত করে?

ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন নাই এমন যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে হাম হতে পারে। সাধারণত ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে হামে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।‌

এছাড়াও যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল অথবা শরীরে ভিটামিন এ এর ঘাটতি‌ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে হাম আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এবং আক্রান্ত হয়ে জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। 

হাম রোগের লক্ষণ

হাম রোগের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই লক্ষণ প্রকাশ পায় না।‌ বরং ১০ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত দেরি হয় যাকে ইনকিউবেশান পিরিয়ড বা সুপ্তিকাল বলা হয়। (Mayo Clinic, 2022) 

সুপ্তিকাল শেষ হওয়ার পরের ২ থেকে ৩ দিন মৃদু প্রকৃতির জ্বর, ঠান্ডা লাগা, গলা ব্যথা, চোখে জ্বালাপোড়া, আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা, কাশি ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। তবে এই পর্যায়ের লক্ষণ অনেকটা সাধারণ জ্বর ঠান্ডার মতো বলে হাম হয়েছে কিনা তা বুঝতে পারা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

যখন শিশুর সারা শরীরে লালচে র‍্যাশ বা ফুসকুড়ি দেখা যায় এবং সেই সাথে তীব্র জ্বর থাকে তখন হাম হয়েছে বোঝা যায়। এই পর্যায়ে মুখের ভেতরে লাল বা সাদা স্পটের (Spots) মতো দেখতে পাওয়া যায়।

কীভাবে হাম ডায়াগনসিস করা হয়?

হামের লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। হাম নির্ণয়ের (Diagnosis) জন্য সাধারণত তেমন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। চিকিৎসক লক্ষণ দেখে হাম হয়েছে তা বুঝতে সক্ষম হন। তবে বিশেষ প্রয়োজনে কখনো কখনো রক্ত, প্রস্রাব বা লালা (Swab) টেস্ট করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।  

কিভাবে হামের চিকিৎসা করা হয়?

হাম ভাইরাসজনিত একটি রোগ। ভাইরাস প্রতিহত করার জন্য কোনো এন্টি-ভাইরাল ওষুধ পাওয়া যায় না। তবে ওষুধ গ্রহণ করা ছাড়াই হামের লক্ষণ প্রকাশের পরবর্তী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। 

প্যারাসিটামল (Paracetamol) 

রোগ লক্ষণ (জ্বর ও ব্যথা) নিরাময়ের জন্য প্যারাসিটামল সেবন করা উপকারী হবে। বড়দের জন্য ট্যাবলেট জাতীয় ওষুধ ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় দিনে ৩ থেকে ৪ বার সেবন করতে হয়। আর ছোটদের জন্য সিরাপ জাতীয় ওষুধ প্যাকেটের গায়ে থাকা নির্দেশনা অনুযায়ী দিতে হবে। 

তীব্র প্রকৃতির জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল সাপোজিটরি (Suppository) ব্যবহার করা যেতে পারে।

এন্টি-বায়োটিক (Antibiotics)

হামের চিকিৎসায় কোনো এন্টি-বায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না। ভাইরাসজনিত রোগের ক্ষেত্রে এন্টি-বায়োটিক কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না। হামের সাথে অন্য কোনো জটিলতা (কানে ইনফেকশন বা ব্যাকটেরিয়া জনিত নিউমোনিয়া) দেখা দিলে সেক্ষেত্রে এন্টি-বায়োটিক ওষুধ গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে চিকিৎসকের নির্দেশনা ব্যতীত এন্টি-বায়োটিক ওষুধ সেবন করা যাবে না।

ভিটামিন এ (Vitamin A) 

যাদের শরীরে ভিটামিন এ এর ঘাটতি রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে হাম হলে তীব্র লক্ষণ দেখা যায় এবং নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে‌। তাই এই ধরনের রোগীদের ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়।  

বাচ্চাদের হাম হলে করণীয় 

চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরী। যেমনঃ

  • রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। শিশুদের স্কুলে পাঠানো যাবে না।  
  • নরম ও ভেজা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে দেওয়া উপকারী হবে। 
  • শরীরে পানির ঘাটতি যেন না হয় সেজন্য পর্যাপ্ত পানি (স্যালাইন ও ফলের জুস) পান করতে হবে।   
  • গলা ব্যথা কমানোর জন্য গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করতে হবে।   
  • চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার এবং যেসব খাবার খেলে এলার্জি হতে পারে সেগুলো বর্জন করতে হবে। 
  • আলোর দিকে তাকালে যদি চোখে যন্ত্রণা হয় তবে রুমের আলো কমিয়ে রাখতে হবে।   
  • রুমের আদ্রর্তা ঠিক রাখার জন্য Humidifier ব্যবহার করতে হবে।  

হামের জটিলতাগুলি কী কী? 

হাম রোগের ফলে সাধারণত তেমন কোনো জটিলতা দেখা যায় না। তবে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল বা শরীরে ভিটামিন এ এর ঘাটতি রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে নিচে উল্লেখিত জটিলতা হতে পারে।

  • ডায়রিয়া ও বমি
  • কানে ইনফেকশন 
  • অন্ধত্ব (Blindness) 
  • নিউমোনিয়া ও ব্রঙ্কাইটিস 
  • মেনিনজাইটিস (Meningitis)
  • এনসেফালাইটিস (Encephalitis)

গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে হাম হলে জটিলতা হিসেবে ডেলিভারির নির্ধারিত সময়ের আগে (৩৭ সপ্তাহের কম) বাচ্চা প্রসব হওয়া, শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা সহ গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়।

হাম রোগের প্রতিরোধে করণীয়

Wash Your Hands
হাম রোগ‌ প্রতিরোধের জন্য সবার জন্য টিকা গ্রহণ করতে হবে। হামের টিকার নাম হলো MMR (Measles Mumps Rubella) যা সরকারিভাবে বিনামূল্যে সকল শিশুকে দেওয়া হয়ে থাকে। 

শিশুর বয়স ১২ থেকে ১৫ মাসের সময় ১ম ডোজ এবং ৪ থেকে ৬ বছর বয়সের সময় ২য় ডোজ (সর্বমোট দুই ডোজ) টিকা গ্রহণ করতে হবে।

দুই ডোজ টিকা গ্রহণ করার ফলে হাম আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। তবে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও হামের সংক্রমণ হতে পারে।‌ যদিও সম্ভাবনা খুব কম রয়েছে। 

হাম প্রতিরোধে করণীয় অন্যান্য বিষয় 

  • হাম আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। 
  • চারদিকে হামের প্রকোপ শুরু হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাইরে চলাফেরা করতে হবে। 
  • বাইরে থেকে ঘরে ফিরে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।  

হামের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগের ও পরের চার দিন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে।‌ তাই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য এই সময়ে হামের রোগীকে আইসোলেশন (Isolation) রাখতে হবে অর্থাৎ যতটা সম্ভব সুস্থদের থেকে আলাদা রাখতে হবে।

যাদের একবার হাম হয়েছিল তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে হাম হওয়ার ঝুঁকি বেশ কম থাকে। কারণ এই রোগে‌ আক্রান্ত হয়ে ভালো হওয়ার পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বিকাশ ঘটে যা পরবর্তীতে হামের সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

References

cleveland clinic. (2021, 10 25). Measles. Retrieved from cleveland clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/8584-measles

Mayo Clinic. (2022, May 11). Measles. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/measles/symptoms-causes/syc-20374857

Last Updated on November 20, 2023