নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসে জীবাণুর সংক্রমণ (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ফাংগাস) জনিত একটি রোগ যা সাধারণত শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে হতে দেখা যায়। নিউমোনিয়ার লক্ষণ হলো শ্বাসকষ্ট, জ্বর, বুকে ব্যথা, কাশি এবং কাশির সাথে কফ নির্গত হওয়া। নিউমোনিয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া জনিত নিউমোনিয়ার জন্য এন্টি-বায়োটিক ওষুধ সেবনের প্রয়োজন পড়ে। 

নিউমোনিয়ার লক্ষণ নিরাময়ের ক্ষেত্রে কতিপয় ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা উপকারী হতে পারে যা এই অনুচ্ছেদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। এছাড়াও কখন জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং নিউমোনিয়া প্রতিরোধে করণীয় বিষয়াবলী সম্পর্কে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

নিউমোনিয়ার ঘরোয়া চিকিৎসা 

নিউমোনিয়ার জন্য শুধুমাত্র ঘরোয়া পদ্ধতির উপর নির্ভর করা যাবে না। বরং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে এবং নিয়ম মেনে ওষুধ খেতে হবে। ওষুধ সেবনের পাশাপাশি ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করা হলে তা রোগ লক্ষণ নিরাময়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। লক্ষণ অনুযায়ী নিচে ধারাবাহিকভাবে ১২টি ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। 

কাশি নিরাময়ের জন্য ঘরোয়া উপায়

caugh home remedies

১। তরল খাবার খাওয়া কাশি নিরাময় এবং বুকে জমে থাকা কফ বের করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তরল খাবার বলতে পানি, চা (গ্রীন টি), স্যুপ, ফলের জুস ইত্যাদি খেতে হবে। (Brown, 2022) 

ছোট শিশুদের জন্য ঘন ঘন মায়ের বুকের দুধ দিতে হবে। ছয় মাসের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য বুকের দুধের পাশাপাশি কুসুম গরম পানিতে আদা, লবঙ্গ, লেবু, পুদিনাপাতা ও তুলসীপাতা যোগ করে খাওয়ানো উপকারী হবে।‌ এছাড়াও স্যুপ ও ফলের জুস (ফ্রিজের ঠান্ডা জুস নয়) দেওয়া যেতে পারে।

কাশি নিরাময়ের ক্ষেত্রে চা খাওয়া বেশ উপকারী হবে। তবে ছোট শিশুদের জন্য চা খাওয়া উচিৎ নয়।  

চায়ের সাথে লেবু, লবঙ্গ, আদা, পুদিনাপাতা ও তুলসীপাতা যোগ করা হলে উপকারিতা আরো বেড়ে যায়। 

২। কাশি ও গলা ব্যথা দূর করার জন্য মধু খাওয়া উপকারী হবে। কুসুম গরম পানিতে অথবা চায়ের সাথে মধু যোগ করে খাওয়া যেতে পারে। দৈনিক ১ টেবিল-চামচের (১৫ মিলিলিটার) বেশি মধু খাওয়া উচিত নয়। 

এক বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে কাশি নিরাময়ের জন্য মধু খাওয়ার ব্যাপারে একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।

৩। এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে সামান্য পরিমাণ (আধা চা-চামচ) লবণ মিশিয়ে গড়গড়া করা হলে কাশি ও গলা ব্যথা নিরাময়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। দিনে অন্তত ৩ বার গড়গড়া করতে হবে।

শ্বাসকষ্ট নিরাময়ের জন্য ঘরোয়া উপায় 

৪। রাতে উচু বালিশ ব্যবহার করে শোয়ার ফলে শ্বাসকষ্ট কম হবে। ছোট ও বড় সকলের জন্যই উঁচু বালিশ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে বালিশ উঁচু হওয়ার কারণে যেন ঘাড় ব্যথা না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ বালিশ খুব বেশি উঁচু হওয়া যাবে না।  

৫। ধুমপানের অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করা জরুরী। বিশেষ করে ঘরে ছোট শিশু থাকলে বড়দের জন্য ঘরের ভেতর ধুমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। 

এছাড়াও মশা দূর করার জন্য কয়েল বা এরোসল ব্যবহার না করে বরং মশারী বা ইলেক্ট্রনিক মশা মারার ব্যাট ব্যবহার করা উচিত। কারণ কয়েলের ধোঁয়া ও এরোসল শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দিতে পারে। 

৬। শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম (ব্রিদিং এক্সারসাইজ) করতে হবে। অর্থাৎ যতটা সম্ভব লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে হবে।

বুকে ব্যথা নিরাময়ের জন্য ঘরোয়া উপায় 

৭। নিউমোনিয়া জনিত বুকে ব্যথা নিরাময়ের জন্য আদা চা ও হলুদের গুঁড়া খাওয়া উপকারী হতে পারে। এক কাপ কুসুম গরম পানিতে ১ চা-চামচ হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে খেতে হবে। মিশ্রণটির সাথে লেবুর রস, মধু, গোল মরিচ ইত্যাদি যোগ করা হলে স্বাদ ও উপকারিতা আরো বেড়ে যায়।‌ (Cronkleton, 2023)

৮। নিউমোনিয়া জনিত বুকে ব্যথা নিরাময়ের জন্য নাক দিয়ে গরম বাষ্প টানা যেতে পারে।‌ এছাড়াও এক টুকরো কাপড় গরম করে (চুলা বা ইস্ত্রির সাহায্যে) বুকে সেঁক দেওয়া হলে উপকার পাওয়া যেতে পারে। 

জ্বর নিরাময়ের জন্য ঘরোয়া উপায় 

৯। জ্বর নিরাময়ের সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী ঘরোয়া উপায় হলো প্যারাসিটামল (Paracetamol) সেবন করা। প্যারাসিটামল একটি ওটিসি মেডিসিন যা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই দিনে ৩ থেকে ৪ বার (৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট – নূন্যতম ৬ ঘন্টা অন্তর অন্তর) সেবন করা যেতে পারে। 

শিশুদের জন্য প্যারাসিটামল সিরাপ প্যাকেটের গায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী দিতে হবে।

ঠান্ডা লাগা নিরাময়ের জন্য ঘরোয়া উপায় 

১০। ঠান্ডা লেগে নাক বন্ধ হয়ে থাকা সমস্যা দূর করার জন্য কুসুম গরম পানিতে সামান্য পরিমাণ লবণ মিশিয়ে নাকে ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যাবে। ড্রপারের সাহায্যে ২/৩ ফোঁটা পানি নাকে দিতে হবে। 

১১। ফ্রিজের ঠান্ডা পানি ও খাবার, কোমল পানীয়, আইসক্রিম ইত্যাদি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। 

১২। ধুলাবালি এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ করে ঘরের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে মাস্ক পড়তে হবে। 

কখন ডাক্তার দেখাবেন? 

doctor consultration

সাধারণত ব্যাকটেরিয়া জনিত নিউমোনিয়ার লক্ষণ গুরুতর প্রকৃতির হয়ে থাকে এবং রোগীকে রোগাক্রান্ত হওয়ার শুরু থেকে আরোগ্য হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।‌ এমনকি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।‌ তবে ভাইরাস জনিত নিউমোনিয়ার লক্ষণ তীব্র আকার ধারণ করে না।

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন এবং ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করার মাধ্যমে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে উঠেন।‌ চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে নিচে উল্লেখিত লক্ষণগুলো দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

  • তীব্র শ্বাসকষ্ট হওয়া
  • ঠোঁট নীল হয়ে যাওয়া
  • বুকে‌ তীব্র ব্যথা বোধ 
  • উচ্চ মাত্রার জ্বর 
  • কাশি বাড়তে থাকা 

নিউমোনিয়ার চিকিৎসার জন্য বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের (শিশুদের জন্য শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ) শরণাপন্ন হতে হবে। জরুরী পর্যায়ের রোগীদের হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যেতে হবে।‌

প্রাকৃতিকভাবে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করার উপায় 

নিউমোনিয়া একটি সংক্রামক প্রকৃতির রোগ। অর্থাৎ অসুস্থ ব্যক্তির হাঁচি ও কাশি থেকে নির্গত ড্রপলেটের মাধ্যমে নিউমোনিয়ার জীবাণু সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে। 

কতিপয় নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব। নিউমোনিয়া প্রতিরোধের উপায় হিসেবে নিচে উল্লেখিত নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। (Johnson, 2023) 

  • শিশুদের সময়মতো টিকা দিতে হবে।  
  • ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। অতঃপর বুকের দুধের পাশাপাশি বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। যেমনঃ ডিম,‌ মাছ, মাংস, কলিজা, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি।
  • হাঁচি ও কাশির সময় স্বাস্থ্যবিধি (হাত বা রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে হবে) মেনে চলা উচিত। 
  • শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করার জন্য পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে এবং নিয়মিত ব্যায়াম (বিশেষ করে ব্রিদিং এক্সারসাইজ) করতে হবে।  
  • নিউমোনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ (যতটা সম্ভব) এড়িয়ে চলতে হবে।‌ 

শেষ কথা 

নিউমোনিয়া হলো জীবাণুর সংক্রমণ জনিত ফুসফুসের একটি রোগ যার লক্ষণ নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি কতিপয় ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করা উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। নিউমোনিয়ার রোগীদের পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকতে হবে। 

নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, শিশুদের টিকা দিতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে এবং পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। এছাড়াও ধুমপানের অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করতে হবে। 

Bibliography

Brown, S. (2022, November 21). Home Remedies for Pneumonia. Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/lung/ss/slideshow-pneumonia-home-treatment 

Cronkleton, E. (2023, February 16). 12 Home Remedies for Pneumonia Symptoms. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/home-remedies-for-pneumonia 

Johnson, J. (2023, April 18). Are there any home remedies for pneumonia? Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/320881

Last Updated on January 7, 2024