কিডনির পাথর কী?

কিডনির ভেতরে মিনারেল জমে ক্রিস্টাল বা স্ফটিকের মতো পদার্থ তৈরি করে; একে কিডনি পাথর বলা হয়। অর্থাৎ ক্যালসিয়াম ও অক্সালেটের ডিপোজিশন হলে এই রোগের উৎপত্তি হয়।

কিডনি পাথর দূর করার ঘরোয়া উপায়

কিডনি (Kidney) মানব শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর কিডনি ভালো রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো কিডনির জন্য ক্ষতিকর এমন খাবার গুলো এবং জীবন যাপন পদ্ধতির কতিপয় বদঅভ্যাস বর্জন করা। কিডনিতে অনেক ধরনের রোগ হতে পারে যার মধ্যে সবচেয়ে কমন একটি রোগ হলো কিডনিতে পাথর (Kidney stone) হওয়া। প্রস্রাবে থাকা উচ্চ ঘনত্বের ক্যালসিয়াম, অক্সালেট অথবা ফসফরাস দ্বারা কিডনিতে পাথর হয়ে থাকে। এই অনুচ্ছেদে কিডনির পাথর অপসারণের জন্য কতিপয় ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

পর্যাপ্ত পরিমানে পানি পান করা

কিডনিতে পাথর হওয়া থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলো প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা। কারণ, কিডনিতে পাথর তৈরির জন্য যে বর্জ্য পদার্থ গুলো থাকে তা প্রস্রাবের সাথে বের করে দেয়ার জন্য প্রস্রাবের ঘনত্ব কম রাখা প্রয়োজন। আর এর জন্য শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণের পানির সরবরাহ করতে হবে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য দৈনিক ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করা উচিত। সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে পানি রয়েছে এমন খাবার (যেমনঃ শরবত, ফলমূল ও শাকসবজি) বেশি বেশি পরিমাণে খাওয়া উপকারী হবে।

পানির সাথে লেবুর রস যোগ করে খান

লেবুর পানি হলো ক্ষারযুক্ত পানীয় যা যেকোনো কিছু পরিষ্কার করার কাজে এমনকি তা মানুষের দেহের ভেতরের বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করার ক্ষেত্রেও অনেক উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। লেবুতে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিড একই সাথে কিডনিতে পাথর গঠনে বাঁধা দেয় এবং যদি ইতিমধ্যেই ছোট ছোট পাথর তৈরি হতে শুরু করে তবে সেগুলোকে ভেঙে দেয়। সাইট্রিক অ্যাসিড ছোট পাথর গুলোতে অন্য কোনো ক্ষতিকর পদার্থ যুক্ত হতে বাঁধা দেয় এবং এগুলো বিপজ্জনক হয়ে উঠার আগেই নির্মূল করে দেয়। সুতরাং, আপনার প্রস্রাবে যত বেশি মাত্রায় সাইট্রিক অ্যাসিড থাকবে আপনার কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা তত কম।

এবার আসুন দেখা যাক, কিডনিতে পাথর হলে তা সারানোর জন্য ডাক্তাররা কি ওষুধ সাজেস্ট করেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা পটাসিয়াম সাইট্রেটকে সাইট্রিক অ্যাসিডের ফার্মাকোলজিক্যাল ডোজ হিসেবে প্রেসক্রাইব করেন এবং এটি কিডনির পাথর চিকিৎসায় খুবই কার্যকরী। এর জন্য প্রতিদিন প্রায় ১২ টি ট্যাবলেট সেবন করতে হয় এবং এটি বেশ ব্যায়বহুলও বটে।

কিন্তু আপনি কি জানেন, কিডনিতে পাথর না হওয়ার ক্ষেত্রে যে সাইট্রিক অ্যাসিড এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় লেবু থেকে? প্রতিদিন আধা কাপ বা ৪ আউন্স খাঁটি লেবুর রস অথবা ৩২ আউন্স প্রস্তুতকৃত লেবুর রস বা লেমোনেড উপরে উল্লিখিত ফার্মাকোলজিকাল থেরাপির মতো একই পরিমাণ সাইট্রিক অ্যাসিড সরবরাহ করে।

প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় ২ আউন্স লেবুর রস ৬ আউন্স পানির সাথে মিশিয়ে পান করুন। এভাবে আপনার প্রতিদিন ৪ আউন্স লেবুর রস পান করা হবে। আর নিয়মিত ভাবে কয়েক দিন ধরে এটি পান করলে কিডনিতে পাথর সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। এটি একটি প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং এর সাথে নেফ্রোলজিস্টরা (কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ) সমর্থন দিয়েছেন।

লেবুর রস অলিভ অয়েল

কিডনিতে খুব ছোট আকারের পাথর হলে তা খুব সহজেই প্রস্রাবের সাথে বেড়িয়ে যেতে পারে। আর এই ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পর্যাপ্ত ‌পানি পান করার পাশাপাশি বিশেষ আরেকটি রেসিপি গ্রহণ করতে পারেন। এই রেসিপি টি হলো লেবুর রস ও অলিভ অয়েলের মিশ্রণ। লেবুর রসে থাকা সাইট্রিক এসিড পাথর ভাঙ্গতে এবং অলিভ অয়েলের বিশেষ গুণ হলো পাথর প্রস্রাবের সাথে বেড়িয়ে যেতে সহায়তা করা। একটি ছোট কাপের মধ্যে কিছু পরিমাণ লেবুর রস এবং তাতে সমপরিমাণ অলিভ অয়েল নিয়ে মিশ্রণ তৈরি করুন। দিনে কয়েকবার করে এই মিশ্রণটি গ্রহণ করতে হবে,‌ আশা করা যায় উপকৃত হবেন।

আপেল সিডার ভিনেগার

আপেল সিডার ভিনেগার পেটের জন্য অনেক উপকারী এটা হয়তো অনেকেই জেনে থাকবেন। তবে এর গুণাগুণ শুধু এতটুকুই সীমাবদ্ধ নয়, বরং শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে এর ভূমিকা রয়েছে। ভিনেগারে থাকা সাইট্রিক এসিড কিডনির পাথর ভেঙে শরীর থেকে বের করে দেওয়ার কাজে সহায়তা করে থাকে। এছাড়াও, এটি সুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কিডনিতে পাথর হওয়া প্রতিরোধ করতে পারে। ২০১৯ সালে ৯০০০ মানুষের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে‌, যাদের নিয়মিত আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। (Huizen, 2022)

আপেলের রস

আপেল সিডার ভিনেগারের মতো সরাসরি আপেল থেকে ব্লেন্ডারিং করে রস‌ খাওয়ার মাধ্যমেও কিডনি পাথর অপসারণের ক্ষেত্রে উপকারিতা পাওয়া সম্ভব। এর জন্য আপনাকে অবশ্যই ফ্রেশ আপেল সংগ্রহ করতে হবে এবং তা পানিতে কমপক্ষে ১ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে ফরমালিন মুক্ত করে নিতে হবে। অতঃপর ব্লেন্ডারের সাহায্যে রস‌ তৈরি করে ইচ্ছা মতো পরিমাণে পান করতে পারেন। নিয়মিত আপেলের রস খেলে তা কিডনির পাথর দূরীকরণে সহায়তা করে আর সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য কিডনির কার্যকারিতা ভালো রাখতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

ডালিম

ডালিম রোগীদের জন্য খুব ভালো একটি পথ্য হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে কিডনি ভালো রাখতে ডালিমের জুস যুগ যুগ ধরে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এতে থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং কিডনিতে পাথর হওয়া প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও কিডনি‌ থেকে বিষাক্ত (Toxins) পদার্থ এবং পাথর অপসারণে এটি সহায়তা করে বলে মনে করা‌ হয়। ডালিমের রস কিডনিতে পাথরের রোগীদের জন্য বেশ ভালো একটি পথ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ‌তবে যারা‌ কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ সেবন করেন তাদের জন্য নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ডালিমের রস সেবনের পূর্বে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া উচিত।‌ কারণ, আমেরিকান স্ট্রোক এসোসিয়েশনের মতে কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধের সাথে ডালিমের রসের ক্ষতিকর বিক্রিয়া ঘটতে পারে। (Cronkleton, 2022)

তুলসী পাতা

তুলসী পাতার গুণাগুণ বলে শেষ করার মতো নয়। আমাদের দেশে ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতিতে এর জুড়ি মেলা ভার। সতেজ তুলসী পাতা চায়ের সাথে মিশিয়ে অথবা ফ্রেশ তুলসী পাতা থেকে রস বের করে খাওয়া কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে উপকারী হবে বলে মনে করা হয়। তবে ঠিক কিভাবে এটি কিডনি পাথর দূর করতে পারে তা এখনো পরিষ্কার নয়। আশার কথা হলো, এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সহজলভ্য। আর তাই কিডনিতে পাথর দূর করতে নিশ্চিন্তে এটি যত খুশি তত ব্যবহার করা যেতে পারে। আর যেহেতু এটি ভেষজগুণ সম্পন্ন আর তাই উপকার আশা‌ করা যায়।

কিডনি মটরশুটি

কিডনি মটরশুটি ম্যাগনেসিয়ামের খুব ভালো একটি উৎস যা কিডনিতে পাথরের লক্ষণগুলি হ্রাস করে থাকে। এছাড়াও এটি কিডনি এবং মূত্রতন্ত্রের (Urinary system) সামগ্রিক কার্যকারিতা উন্নত করে। কিডনি বিন ব্যবহার করে একটি স্যুপ বা ঝোল তৈরি করুন এবং পাথর জনিত ব্যথা কমাতে সারা দিনে কয়েকবার করে এটি পান করলে বেশ উপকারিতা পাবেন।

এছাড়াও কিছু কিছু খাবার রয়েছে যেগুলো কিডনিতে পাথর হয়েছে এমন রোগীদের জন্য যতটা সম্ভব বর্জন করে চলা উচিত।‌‌ যেমনঃ অতিরিক্ত চা,‌ কফি, কোমল পানীয় বা কার্বোনেটেড বেভারেজ,‌ অ্যালকোহল, চিনি, লবণ, চর্বি যুক্ত খাবার ইত্যাদি।

কিডনি রোগের লক্ষণ

মনে রাখা জরুরী যে, কিডনি রোগের জটিল অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। যেমনঃ

  • চার সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তলপেটে ব্যথা অনুভব হওয়া
  • জ্বর ও শীতবোধ
  • বমি অথবা বমি বমি ভাব
  • প্রস্রাব করতে ব্যথা হওয়া
  • প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া
  • প্রস্রাবে ফেনা ও দুর্গন্ধ

 

References

Cronkleton, E. (2022, 08 31). Home Remedies for Kidney Stones: What Works? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/kidney-health/home-remedies-for-kidney-stones

Huizen, J. (2022, May 19). Natural home remedies for kidney stones. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/319418

 

Last Updated on April 16, 2023