শরীরের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী প্রতিনিয়ত মাথার চুল পড়ে যায় আবার নতুন চুল গজায়। অতিরিক্ত চুল পড়ে যাওয়া, পর্যাপ্ত পরিমাণে নতুন চুল না গজানো এবং চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার ফলে মাথায় চুলের পরিমাণ কমে যেতে দেখা যায়।
নানাবিধ কারণে চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে যা এই অনুচ্ছেদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। এছাড়াও হেয়ার গ্রোথ স্টেজ বা চুলের বৃদ্ধি পর্যায়, চুলের জন্য কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে, কি ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে এবং ঘরোয়া প্রতিকার সম্পর্কে জানতে পারবেন।
Table of Contents
হেয়ার গ্রোথ স্টেজ
চুলের জীবনকাল তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যথাঃ
- অ্যানাজেন (Anagen)
- ক্যাটাজেন (Catagen)
- টেলোজেন (Telogen)
অ্যানাজেন (Anagen)
অ্যানাজেন হলো চুলের বৃদ্ধি পর্যায় অর্থাৎ এই পর্যায়ে চুলের বৃদ্ধি (প্রতিদিন ০.৩৫ মিলিমিটার বা প্রতি মাসে ১ সেন্টিমিটার পরিমাণ) ঘটে। সাধারণত চুলের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেয়ে ১৮ থেকে ৩০ ইঞ্চি হয়ে থাকে।
মাথার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ চুল অ্যানাজেন পর্যায়ে থাকে। এই পর্যায়ের স্থায়িত্বকাল (মাথার চুলের ক্ষেত্রে ২ থেকে সর্বোচ্চ ৮ বছর) অন্যান্য পর্যায়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি।
বয়স, জিনগত প্রভাব, খাদ্যাভ্যাস, জীবন যাপন পদ্ধতি ও স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে অ্যানাজেন পর্যায়ের স্থায়িত্বকাল কম-বেশি হয়ে থাকে। অ্যানাজেন পর্যায়ের স্থায়িত্বকাল যত বেশি, চুলের বৃদ্ধি তত ভালো হয়।
ক্যাটাজেন (Catagen)
ক্যাটাজেন পর্যায় হলো অ্যানাজেন থেকে টেলোজেন পর্যায়ে রুপান্তরের ধাপ। এই পর্যায়ের স্থায়িত্বকাল (৪ থেকে ৬ সপ্তাহ) সবচেয়ে কম হয়ে থাকে।
খুব অল্প সংখ্যক চুল ক্যাটাজেন পর্যায়ে থাকে। এই পর্যায়ে চুলের কোনো বৃদ্ধি হয় না। তবে চুল পড়া শুরু হয় না।
টেলোজেন (Telogen)
টেলোফেজ হলো সর্বশেষ পর্যায় যাকে রেস্টিং ফেজ (Resting phase) বলা হয়। এই পর্যায়ের স্থায়িত্বকাল সর্বোচ্চ ৩ মাস হয়ে থাকে। মাথার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চুল টেলোফেজ পর্যায়ে থাকে। (Hoover, 2023)
টেলোফেজ পর্যায়ে চুল পড়ে যেতে থাকে এবং সেই সাথে নতুন চুল গজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।
চুল বৃদ্ধি না হওয়ার কারণ সমূহ
চুলের সঠিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার কারণ সমূহ নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে।
জিনগত প্রভাব
চুলের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জিনগত প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ পারিবারিক ইতিহাস অনুযায়ী চুলের বৃদ্ধি কম-বেশি হয়ে থাকে।
জিনগত প্রভাব দূর করা যায় না। অর্থাৎ এই সমস্যা সমাধানের তেমন কোনো কার্যকরী উপায় নেই।
বয়স
বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে চুল বৃদ্ধির হার মন্থর হয়ে পড়ে। তবে ব্যক্তিভেদে বয়সের সাথে চুলের পরিবর্তন (চুলের বৃদ্ধি কমে যাওয়া, অতিরিক্ত চুল পড়া, চুল পেকে যাওয়া ইত্যাদি) কম-বেশি হতে দেখা যায়।
থাইরয়েডের সমস্যা
থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন বিপাক প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে থাইরয়েডের ভূমিকা রয়েছে।
থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে কম (হাইপোথাইরয়েডিজম) বা বেশি মাত্রায় হরমোন নিঃসরণ হলে (হাইপারথাইরয়েডিজম) চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। (Gupta, 2021)
অতিরিক্ত মানসিক চাপ
অতিরিক্ত মানসিক চাপ স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং এর ফলে চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
পুষ্টিকর খাবারের অভাব
পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা না হলে চুলের বৃদ্ধির জন্য শরীর থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান পায় না।
মহিলাদের শরীরে হরমোনের পরিবর্তন
মহিলাদের শরীরে সবচেয়ে বেশি হরমোনের পরিবর্তন ঘটে যার ফলে চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। বিশেষ করে সন্তান জন্মদানের পরে অস্বাভাবিক হারে চুল পড়তে দেখা যায়। এছাড়াও অস্বাভাবিক পিরিয়ড, মেনোপজ, পিসিওএস (পলিসিস্টিক ওভারী সিনড্রোম) ইত্যাদির ফলে চুলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
চুলের সঠিক যত্ন না নেওয়া
সঠিক যত্নের অভাবে চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। যেমনঃ অতিরিক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করা, চুল কালার করা, চুলে হিট দেওয়া, হেয়াল ড্রায়ার ব্যবহার করে চুল শুকানো, চুল শক্ত করে বেঁধে রাখা ইত্যাদি।
চুল বৃদ্ধির ঘরোয়া উপায়
- চুলের সঠিক বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। খাদ্যতালিকায় ভালো মানের প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। যেমনঃ মাছ, ডিম, দুধ, মুরগির মাংস, বাদাম, ডাল, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি।
- সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৩ দিনের বেশি শ্যাম্পু ব্যবহার করা উচিত নয়। শ্যাম্পু ব্যবহারের পর কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও চুলে নিয়মিত তেল (নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল) দিতে হবে।
- রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে চুল কালার করা এবং হিট দিয়ে চুলের স্টাইল করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে প্রাকৃতিক কালার হিসেবে মেহেদী (পাতা বেটে পেস্ট তৈরি করে) দেওয়া যাবে।
- চুল শুকানোর জন্য হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার না করে বরং ফ্যানের বাতাসে চুল শুকানো উত্তম। কারণ হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করলে চুল রুক্ষ প্রকৃতির হয়ে যায় এবং সহজেই ভেঙে যায়।
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে ইয়োগা ও মেডিটেশন চর্চা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও রাতে ভালো ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন?
চুলের সমস্যার কারণ যদি হরমোন জনিত হয় তবে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। ঘরোয়া প্রতিকারের মাধ্যমে উপকার পাওয়া না গেলে অথবা চুলের সমস্যার পাশাপাশি শরীরে অন্য কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে অভ্যন্তরীণ কোনো সমস্যা রয়েছে।
চুলের সমস্যার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের (ডার্মাটোলজিস্ট) শরণাপন্ন হতে হবে। অতঃপর প্রয়োজন অনুযায়ী অন্যান্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া লাগতে পারে। যেমনঃ থাইরয়েডের জন্য হরমোন বিশেষজ্ঞ, মহিলাদের সমস্যার জন্য গাইনী ডাক্তার ইত্যাদি।
চিকিৎসা
চুলের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার সাথে সম্পর্কিত কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসার মাধ্যমে সেই কারণ দূর করার চেষ্টা করা হয়। যেমনঃ থাইরয়েড জনিত সমস্যার কারণে চুলের বৃদ্ধি ব্যাহত হলে থাইরয়েড হরমোন নিয়ন্ত্রণের ওষুধ সেবনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এছাড়াও সরাসরি চুলের সাথে সম্পর্কিত চিকিৎসা হিসেবে রয়েছে মাথায় মেডিকেটেড শ্যাম্পু ব্যবহার করা, মুখে ওষুধ সেবন করা এবং অত্যাধুনিক চিকিৎসা হিসেবে রয়েছে হেয়ার ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট সহ আরো অনেক কিছু। চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে আপনার জন্য সবচেয়ে উপযোগী হবে এমন চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করুন।
Bibliography
Gupta, A. (2021, 08 25). Has your hair growth come to a halt? Retrieved from health shots: https://www.healthshots.com/beauty/hair-care/8-reasons-why-your-hair-has-stopped-growing/
Hoover, E. (2023, July 30). Physiology, Hair. Retrieved from The National Library of Medicine : https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK499948/
Last Updated on November 4, 2023
Leave A Comment