নিজের চেহারা ও সৌন্দর্য নিয়ে আজকাল সবাই কমবেশি সচেতন। তবে ভিন্ন ভিন্ন ত্বকের ধরন অনুসারে রয়েছে নানারকমের সমস্যা। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ব্ল্যাকহেডসের সমস্যা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তৈলাক্ত ত্বকে এটি বেশি দেখা গেলেও, মিশ্র ও শুষ্ক ত্বকেও হরহামেশাই দেখা যায় এর উপস্থিতি। এই ব্ল্যাকহেডস হচ্ছে, নাকের আশেপাশে ও ঠোঁটের নিচে উদয় হওয়া শক্ত, ছোট ও কালো দানাদার বস্তু। এগুলো লোমকুপের মধ্যে বসে যায় এবং লোমকূপকে বন্ধ করে দেয়। ত্বককে করে দেয় মলিন, অনুজ্জ্বল ও অমসৃণ। 

ব্ল্যাকহেডস কেন হয়?

সাধারনত নাকের দুই পাশ ও ঠোঁটের নিচের অংশে স্বাভাবিকের চেয়ে তেল নিঃসরণ বেশি হয়। কারণ, এদিকের লোমকূপগুলোও থাকে বেশি কার্যকর। তৈলাক্ত ত্বকে তো এই তেল নিঃসরণ অতিরিক্ত বেশি হয়। ত্বক সঠিক উপায়ে নিয়মিত পরিষ্কার না করা হলে, ত্বকের তেলের সাথে বাইরের ধুলাবালি, ময়লা, মৃত কোষ, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি সব একসাথে মিশে লোমকূপকে বন্ধ করে দেয়। এগুলো আবার অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কালো রং ধারণ করে। লোমকূপকে আটকে দেয়া এই ময়লার মিশ্রণই হচ্ছে আসলে ব্ল্যাকহেডস। যারা প্রচুর মেকআপ ও প্রসাধনি ব্যবহার করেন, কিন্তু ত্বক ভালো করে পরিষ্কার করেন না, তাদের ত্বকেও মেকআপ ও প্রসাধনির অংশ জমে থেকে ব্ল্যাকহেডস হওয়ার প্রবনতা খুব বেশি। 

নাকের ব্ল্যাকহেডস দূর করার উপায়

অনেক মানুষই ত্বকের এই বিপত্তির সমাধান পার্লারের দামী ফেসিয়ালেই খুজেন। কিন্তু পার্লার থেকে পরিষ্কার মুখ নিয়ে ফেরার পর সপ্তাহ না যেতেই আবার দেখা দেয় এই ব্ল্যাকহেডস! 

কেউবা ত্বকের ধরন না বুঝেই ত্বকের সাথে মানানসই না এমন উপাদান যুক্ত কসমেটিক্স ব্যবহার করে ব্ল্যাকহেডস দূর করার চেষ্টা করেন। কেউ আবার ব্ল্যাকহেডস রিমুভার স্ট্রিপ বা পিল অফ মাস্ক দিয়ে টেনে বের করেন ব্ল্যাকহেডস। অনেকে নখ দিয়ে খুটে বের করার চেষ্টা করেন ব্ল্যাকহেডস। এতে ত্বকে হয় ক্ষত, সেখান থেকে দাগ। হতে পারে জীবাণুর আক্রমনে ইনফেকশনও। 

তবে সঠিক নিয়মে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করে, ত্বককে পুরোপুরি দূরে রাখা যেতে পারে ব্ল্যাকহেডস থেকে। হোক সেটা কসমেটিক্স ব্যবহারে, কিংবা ঘরোয়া পদ্ধতিতে। 

১. স্যালিসাইলিক এসিড

ত্বকের গভীর থেকে যেকোন ময়লা দূর করতে স্যালিসাইলিক এসিডের কোন তুলনা নেই। বাজারে স্যালিসাইলিক এসিড সমৃদ্ধ কিছু ফেইসওয়াশ ও ক্লিনজার পাওয়া যায়। ত্বকে প্রচুর ব্ল্যাকহেডসের আক্রমণ থাকলে, সাধারণ ফেইসওয়াশ বা ক্লিনজারের পরিবর্তে স্যালিসাইলিক এসিড সমৃদ্ধ ফেইসওয়াশ বা ক্লিনজার কিনে ব্যবহার করুন। 

দিনে অন্তত একবার এর ব্যবহারে, লোমকূপের অতিরিক্ত তেলের সাথে গভীর থেকে দূর হবে ময়লা, মৃত কোষ, ব্যাকটেরিয়া ও প্রসাধনীর অবশিষ্টাংশ। ত্বকও মুক্তি পাবে ব্ল্যাকহেডসের যন্ত্রনা থেকে। তবে স্যালিসাইলিক এসিড কারো ত্বকে না মানালে, জ্বালাপোড়া বা যেকোন ধরণের অস্বস্তি হলে প্রতিদিনের পরিবর্তে সপ্তাহে কয়েকবার ব্যবহার করতে পারেন। অথবা এটি বাদ দিয়ে অন্য পদ্ধতি খুজে নিতে পারেন। (Cobb, 2020)

২. রেটিনয়েড ক্রিম বা লোশন

রেটিনয়েড যুক্ত ক্রিম বা লোশনের মূল উপাদান মূলত ভিটামিন-এ। যা ত্বকের লোমকূপকে পরিষ্কার রাখে, পুরনো মৃত কোষ দূর করে নতুন কোষ তৈরি হতে সাহায্য করে। তাই ত্বককে ব্ল্যাকহেডস মুক্ত রাখতে রেটিনয়েড ক্রিম বা লোশনও বেশ কার্যকরী। 

তবে রেটিনয়েড ক্রিম বা লোশন ত্বককে সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মির প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে। তাই রেটিনয়েড যুক্ত যেকোন পণ্য দিনে ব্যবহার না করে রাতে করা উত্তম। 

৩. এক্সফোলিয়েশন

ত্বকে এক্সফোলিয়েশন বা স্ক্রাবিং করা ব্ল্যাকহেডস দূর করার আরেকটি কার্যকরী পদ্ধতি। এর মাধ্যমে ত্বকের মৃত কোষ দূর হয়, ফলে লোমকূপকে বন্ধ করতে পারে না। 

তবে এতে সঠিক উপাদান ও সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন না করলে হতে পারে হিতে বিপরীত। 

যেমন, ত্বকে কোন একটিভ একনি বা ব্রন থাকলে এক্সফোলিয়েশন বা স্ক্রাব দিয়ে ঘষাঘষি করা যাবে না। ত্বক বেশি পাতলা হলে, ভারী এক্সফোলিয়েটর ব্যবহার করা যাবে না। 

এক্ষেত্রে প্রায় সব ধরণের ত্বকের জন্য মানানসই উপাদান আলফা ও বেটা হাইড্রোক্সি এসিড (AHA-BHA) সমৃদ্ধ এক্সফোলিয়েটর ব্যবহার করা যেতে পারে। 

৪. ক্লে মাস্ক

ক্লে মাস্ক

বিভিন্ন প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান দিয়ে প্রস্তুত ক্লে মাস্ক পাওয়া যায় বাজারে। এটি মূলত ত্বকের গভীর থেকে দুষিত বস্তু বের করে আনে ও অতিরিক্ত তৈলাক্ত ভাব কমায়। ব্ল্যাকহেডস দূর করার ক্ষেত্রে চারকোল সমৃদ্ধ ক্লে মাস্ক সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। ভালো ফলাফলের জন্য মাস্ক ব্যবহারের আগে মুখে গরম পানির ভাপ নিয়ে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে মাস্ক পরিস্কারের পর অবশ্যই মুখে বরফ ঘষে নিতে হবে এবং ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। 

চাইলে ঘরেও তৈরি করতে পারেন ক্লে মাস্ক। যদি ঘরেই থাকে মুলতানি মাটি। এর সাথে এলোভেরা জেল মিশিয়ে মাস্ক তৈরি করলে তা ত্বক পরিস্কারে বেশ কার্যকরী। 

তবে এসব ক্লে মাস্ক তৈলাক্ত ত্বকের জন্যই সবচেয়ে ভালো। শুস্ক ত্বককে এটি আরো বেশি শুষ্ক করে দিতে পারে।

৫. নোজ পোর স্ট্রিপ

কোথাও বেরোনোর আগে যদি ঝটপট নাক ও আশপাশের ব্ল্যাকহেডস দূর করতে চান, তাহলে ইনস্ট্যান্ট সমাধান হচ্ছে নোজ পোর স্ট্রিপ। বাজারে পাওয়া যাওয়া এই স্ট্রিপগুলোর একপাশ অনেকটা স্টিকারের মতো। নাক হালকা ভিজিয়ে নিয়ে, একটি স্ট্রিপ খুলে স্টিকারের মতো পাশটি নাকে ভালভাবে আঁটকে নিতে হবে। এগুলো নাকের আকার অনুযায়ীই ডিজাইন করা। তাই বসে যাবে খুব সহজে। ৮ থেকে ১০ মিনিট অপেক্ষা করে স্ট্রিপটি নাক থেকে হালকা টেনে খুলে আনলেই দেখবেন, স্ট্রিপের সাথে সব ব্ল্যাকহেডসও নাকের অংশ থেকে উঠে এসেছে। 

৬. লেবু-চিনি-মধুর স্ক্রাব

লেবু-চিনি-মধুর স্ক্রাব

 

আধা চামচ লেবুর রসে মধু দিতে হবে কয়েক ফোটা। তাতে দুই চিমটি পরিমাণ চিনি মিশিয়ে ব্ল্যাকহেডস আক্রান্ত স্থানে ম্যাসাজ করতে হবে চিনি গলে না যাওয়া পর্যন্ত। তারপর ত্বক ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। ব্ল্যাকহেডসের সাথে দূর হবে মৃত কোষ ও ময়লাও। 

এই পদ্ধতিটি তৈলাক্ত ত্বকের জন্য সবচেয়ে ভালো। তবে ত্বকে একটিভ একনি বা ব্রন থাকলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যাবে না। 

 

যাদের ত্বক খুব পাতলা বা যদি লেবু দিলে জ্বালাপোড়া, অস্বস্তি ভাব হয়, তারা লেবুর রস ত্বকে ব্যবহার না করে মধু ও চিনির সাথে মিশিয়ে নিতে পারেন কয়েক ফোটা দুধ। তারপর একই প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করতে হবে ত্বকে। 

. নারকেল তেল-কফির স্ক্রাব

শুষ্ক ত্বকের ক্ষেত্রে সমপরিমাণ নারকেল তেলকফির মিশ্রন বানিয়ে, মুখের ব্ল্যাকহেডস আক্রান্ত স্থানে ম্যাসাজ করতে হবে। কিছুক্ষণ রেখে দিয়ে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেললেই  ত্বক হয়ে যাবে পরিষ্কার। সপ্তাহে অন্তত একবার এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে লোমকূপে ময়লা আটকে থাকবে না, ব্ল্যাকহেডসের আক্রমণও হবে কম। 

৮. ডিমের সাদা অংশ দিয়ে ঘরোয়া স্ট্রিপ

ঝটপট ব্ল্যাকহেডস দূর করতে চান, কিন্তু হাতের কাছে নেই বাজার থেকে কেনা স্ট্রিপ। সেক্ষেত্রে ডিমের সাদা অংশ আলাদা করে নিতে হবে প্রথমে। সেটা নাক ও চারপাশের ব্ল্যাকহেডস আক্রান্ত অংশে লাগিয়ে তা শুকানোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে হালকা টেনে তুলে ফেলতে হবে। শুকিয়ে যাওয়া ডিমের সাদা অংশের সাথেই উঠে আসবে লোমকুপে আটকে থাকা ব্ল্যাকহেডস ও ময়লা। 

. মধু ও হলুদের এক্সফোলিয়েটর

এক টেবিল চামচ মধুতে তার অর্ধেক পরিমাণ বিশুদ্ধ হলুদ গুড়া মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিতে হবে। পেস্টটি ত্বকে হালকা ম্যাসাজ করে লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিট রেখে দিতে হবে। তারপর হালকা করে চক্রাকারে ম্যাসাজ করে করে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে মুখ। সপ্তাহে দুই দিন এর ব্যবহারে ব্ল্যাকহেডস দূর হওয়ার পাশাপাশি মধু ও হলুদের প্রাকৃতিক এন্টি-অক্সিডেন্ট ত্বককে করবে উজ্জ্বল ও মসৃণ। 

এগুলো সাথে অবশ্যই ত্বকের স্বাভাবিক যত্ন নিতে ভুলবেন না। 

 

References

Richter C. (2020, June 24) 12 Ways to Get Rid of Blackheads, Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/beauty-skin-care/how-to-get-rid-of-blackheads

 

Last Updated on May 31, 2023