নাক দিয়ে রক্ত পড়া (Nosebleeds) কমন (বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে) একটি স্বাস্থ্য সমস্যা যার ফলে মানুষ খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাক দিয়ে রক্ত পড়া জটিল কোনো রোগের ইঙ্গিত বহন করে না। বরং এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় নাক দিয়ে রক্ত পড়াকে Epistaxis বলা হয়। এই অনুচ্ছেদে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ, কাদের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকি রয়েছে, নাক দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ করতে করণীয় কি, কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে, কিভাবে কারণ নির্ণয় করা হয় এবং চিকিৎসা পদ্ধতি কেমন সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ
নাক দিয়ে রক্ত পড়ার সবচেয়ে কমন কারণ হলো নাকের ভেতর আঙ্গুল দেওয়া। অর্থাৎ নাকের ভেতর চুলকানো, ময়লা বের করা বা শুষ্ক আবহাওয়া জনিত অস্বস্তি দূর করার জন্য নাকের ভেতর আঙ্গুল প্রবেশ করানোর (নাক খোঁটানো) ফলে নখের দ্বারা ক্ষত সৃষ্টি হয়ে নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে।
এছাড়াও আরো নানাবিধ কারণে নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাক দিয়ে রক্ত পড়ার তেমন কোনো জটিল কারণ থাকে না। কমন কারণগুলো হলোঃ
- নাকে আঘাত লাগা
- নাকের ভেতর কোনো কিছু (যেমনঃ পোকামাকড়, ধাতব বস্তু, কাঠি ইত্যাদি) ঢুকে যাওয়া
- রাসায়নিক উপাদানের সংস্পর্শ
- মাদকদ্রব্য সেবন করা
- বার বার তীব্র প্রকৃতির হাঁচি হওয়া
- অ্যালার্জিক রাইনাইটিস (এলার্জি)
- নাকের ভেতর ইনফেকশন
- নাকের পলিপাস বা টিউমার
- পাহাড়ে উঠা বা বিমানে আরোহণ
কাদের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকি রয়েছে?
যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রেই নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে। জীবদ্দশায় হঠাৎ একবার নাক দিয়ে রক্ত পড়ার অভিজ্ঞতা অনেকের ক্ষেত্রেই হতে দেখা যায়।
- দুই থেকে দশ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। সহজেই ঠান্ডা লাগা, এলার্জি ও নাক খোটার অভ্যাসের ফলে এমনটি হয়ে থাকে। (Cleveland Clinic, 2023)
- বয়স্কদের ক্ষেত্রে (৪৫ বছরের বেশি বয়সী) রক্তজমাট বাঁধার সময়সীমা বেড়ে যায়। এছাড়াও অধিকাংশ বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেশার) দেখা যায়। যার ফলে সহজেই নাক দিয়ে রক্ত পড়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।
গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার ঝুঁকি থাকে। কারণ গর্ভকালীন সময়ে শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে এবং রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়। এছাড়াও পিরিয়ডের (Menstruation) সময়েও এমন (নাক দিয়ে রক্ত পড়া) হতে পারে।
- উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানোর জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয় এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ওষুধের প্রভাবে নাক দিয়ে রক্ত বের হতে পারে।
- হিমোফিলিয়া (Hemophilia) নামক জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে। এই রোগের লক্ষণ হলো শরীরের কোনো স্থান থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হলে সহজে রক্ত জমাট বাঁধে না।
নাক দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধে করণীয়
নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হলে প্রাথমিক পর্যায়ে করণীয় হলোঃ
- আতঙ্কিত না হয়ে (চেয়ার অথবা বিছানায়) সোজা হয়ে বসে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখা।
- দুই আঙুল দিয়ে নাক (একটানা ১০ থেকে ১৫ মিনিট) চেপে ধরে রাখতে হবে।
- এই সময়ে মুখ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চালাতে হবে।
- এক টুকরো কাপড়ের মধ্যে বরফ কুচি নিয়ে নাকে চেপে ধরে রাখলে উপকার পাওয়া যাবে।
নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হলে মাথা পেছনের দিকে হেলানো বা শুয়ে পড়া যাবে না।
আরও যা করতে পারেন-
- নাকে আঙ্গুল দেওয়া (নাক খোঁটানো) একটি বাজে অভ্যাস যা বর্জনের চেষ্টা করতে হবে।
- শিশুদের নখ ছোট ও পরিষ্কার রাখতে হবে।
- টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করে নাক পরিষ্কার করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
- শুষ্ক আবহাওয়ায় নাকের ভেতরের শুষ্কতা দূর করতে পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করার ফলে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার ঝুঁকি কমে যাবে।
হার্টের রোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য (রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধের ওষুধ) নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন বন্ধ রাখতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসক ওষুধের মাত্রা বা ডোজ পরিবর্তন করে দিতে পারবেন।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে?
একবার নাক দিয়ে রক্ত পড়ার পর আর কখনো এই ধরনের সমস্যা দেখা না দিলে জটিল কোনো সমস্যা নয় বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে এবং এমতাবস্থায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে মাঝেমধ্যেই নাক থেকে রক্ত পড়তে দেখা গেলে সেক্ষেত্রে একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের (ইএনটি স্পেশালিস্ট) শরণাপন্ন হতে হবে।
এছাড়াও নাক থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়ে সহজে বন্ধ না হলে অথবা অনেক বেশি পরিমাণে রক্তক্ষরণ হলে সেক্ষেত্রে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নাক দিয়ে রক্ত পড়ার চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন।
নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ নির্ণয়
নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক কতিপয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেমনঃ (Higuera, 2019)
- রক্ত পরীক্ষা (CBC- Complete Blood Count, PTT- Partial Thromboplastin Time)
- এন্ডোসকপি (Nasal endoscopy)
- মুখমণ্ডলের এক্সরে ও সিটি স্ক্যান
নাক দিয়ে রক্ত পড়ার চিকিৎসা
কারণ অনুযায়ী যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যেমনঃ
- এলার্জি জনিত সমস্যা দূর করার জন্য এন্টিহিস্টামিন ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়।
- রক্তক্ষরণ জনিত সমস্যার জন্য রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়ক ওষুধ দেওয়া হয়।
- ইনফেকশন হলে এন্টিবায়োটিক সেবনের প্রয়োজন পড়ে।
- নাকের গঠনগত ত্রুটি বা টিউমার থাকলে সার্জারি করতে হয়।
শেষ কথা
অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই কোনো জটিল কারণ ছাড়াই নাক দিয়ে রক্ত পড়ার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এমতাবস্থায় আতংকিত না হয়ে বরং শান্ত হয়ে বসে কিছুক্ষণ (একটানা ১০ থেকে ১৫ মিনিট) নাক চেপে ধরে রাখুন।
নাক দিয়ে রক্ত পড়ার ঘটনা বার বার ঘটতে দেখা গেলে বা অন্তর্নিহিত জটিল কোনো কারণ রয়েছে বলে মনে হলে সেক্ষেত্রে একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।
Bibliography
Cleveland Clinic. (2023, 4 17). Nosebleed (Epistaxis). Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/13464-nosebleed-epistaxis
Higuera, V. (2019, March 24). What Causes Nosebleeds and How to Treat Them. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/nosebleed
Last Updated on January 4, 2024
Leave A Comment