ত্বকের ঠিকঠাক যত্ন নিতে গেলে সবার আগেই যা বুঝে নেয়া প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, ত্বকের ধরন। কারণ, সব মানুষের ত্বক কিন্তু একই রকম নয়। কারো খুব তৈলাক্ত, তো কারো খুবই শুষ্ক। কারো ত্বকের আবার কিছু অংশ তৈলাক্ত, কিছু অংশ শুষ্ক। মানে মিশ্র ধরণের ত্বক। কিছু মানুষের ত্বক আবার তৈলাক্ত বা শুষ্কতা ছাড়াও প্রচণ্ড সংবেদনশীল বা সেনসিটিভ। আর এই ধরণের ত্বকের যত্ন নেয়াই সবচেয়ে কঠিন।
একই মানুষের একেক বয়সেও দেখা দিতে পারে ত্বকের ভিন্নতা। বয়সের সাথে বদলাতে পারে ত্বকের ধরন।
সেনসিটিভ ত্বকের সমস্যাগুলোর কারণ, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যাপারে জানতে হলে, থাকতে হবে আজকের আলোচনার শেষ পর্যন্ত।
Table of Contents
সেনসিটিভ স্কিন কি
সেনসিটিভ স্কিন হচ্ছে এমন এক ত্বকের ধরন, যা ইরিটেট বা উত্তেজিত হয়, বাজেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় খুব সহজেই। প্রতিকুল আবহাওয়া, ময়লা, ধুলাবালি, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, খসখসে কাপড় অথবা এক বা একাধিক বিশেষ কোন উপাদানের সংস্পর্শ, ইত্যাদি নানান কারনে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলে সেনসিটিভ স্কিন। র্যাশ, ত্বক লালচে হয়ে যাওয়া, চুলকানি, ঘামাচির মতো ছোট ছোট ফোড়া, জ্বালাপোড়া, প্রতিক্রিয়া হতে পারে নানানরকম।
সাবান, শ্যাম্পু, গৃহস্থালি উপাদান কিংবা স্কিনকেয়ার অথবা মেকআপের কোন পণ্য, এগুলোর সংস্পর্শেও সেনসিটিভ ত্বকে হতে পারে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া। যদি এগুলোতে উপস্থিত থাকে সেনসিটিভ স্কিনে মানানসই না এমন কোন উপাদান।
সেনসিটিভ স্কিন (Sensitive Skin) এর কারণ
ত্বকের এই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া ও সংবেদনশীলতা দেখানোর পেছণে আছে বেশ কিছু কারণ। যদিও সবার জন্যই কারণগুলো একই না। কিছু চর্মরোগের কারনেও ত্বক হয়ে যেতে পারে সেনসিটিভ। তবে ত্বকের এই সেনসিটিভিটি বা সংবেদনশীলতা দেখানোর পেছণের কারণগুলো জানা থাকলে, সেনসিটিভ স্কিনের যন্ত্রণাদায়ক প্রতিক্রিয়ার চিকিৎসা করাও সহজ হয়ে যায়।
১. অতিরিক্ত শুষ্কতা
কারো ত্বকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পানি ও তেলের অভাব দেখা দিলে, সেই ত্বক মাত্রাতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে পড়ে। ফলে ত্বকের উপরিভাগের লেয়ার শুকিয়ে, ফেটে উঠে আসতে থাকে। কোথাও কোথাও অনাবৃত হয়ে পরে উপরিভাগের সুরক্ষা বলয়ের নিচে থাকা নাজুক ত্বক। যার ফলে ত্বক হয়ে যেতে পারে অতিরিক্ত সংবেদনশীল বা সেনসিটিভ।
২. একজিমা (Eczema)
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় একটি কমন চর্মরোগ হচ্ছে একজিমা। শরীরের যে কোন স্থানের ত্বকে হতে পারে এটি। একজিমার আক্রমণে ত্বকের বহির্ভাগের সুরক্ষা বলয় নষ্ট হতে পারে। যার কারনে যে কোন ময়লা, জীবাণু, ক্যামিকাল ইত্যাদির প্রতি আক্রান্ত নাজুক ত্বক প্রচণ্ড স্পর্শকাতর হয়ে উঠে। এবং র্যাশ, জ্বালাপোড়া, চুলকানি, এলার্জির মতো প্রতিক্রিয়াও দেখায় খুব দ্রুত। এমনকি এমনও অনেক কিছুর সংস্পর্শে ত্বক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, যেসব জিনিস সাধারণত অন্যরা ব্যবহার করতে পারে খুব সহজে।
৩. নির্দিষ্ট কিছুর প্রতি এলার্জি
কোন মানুষের নির্দিষ্ট কোন উপাদানের প্রতি এলার্জি থাকতে পারে। হতে পারে সেটা ডিটার্জেন্ট, পারফিউম, কোন নির্দিষ্ট ধরণের তেল বা অন্য যে কোন কিছু। সেই উপাদানটির সংস্পর্শে আসলেই ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, র্যাশ, চুলকানি, ফোলা, ফুসকুড়ি, জ্বালাপোড়ার মতো সেনসিটিভ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
৪. রোজেসিয়া (Rosacea)
গরম আবহাওয়ার দেশগুলোয় আরেকটি কমন ত্বকের সমস্যার নাম হচ্ছে, রোজেসিয়া (Rosacea)। বেশিভাগ ক্ষেত্রে মুখের ত্বকে দেখা গেলেও, এটি হতে পারে কান, বুক, পিঠের মতো স্থানেও। ত্বকের কোন অংশ অত্যাধিক লাল বর্ণ ধারণ করা, চামড়ার ঠিক নিচের শিরা দেখা যাওয়া এই চর্মরোগেরই ফল। চামড়া বেশি পাতলা হয়ে যাওয়া, পাতলা ত্বকের ঠিক পৃষ্ঠদেশে রক্ত উঠে আসার ফলে এই সমস্যাটি হয়। রোজেসিয়া নামক চর্মরোগে ভুগতে থাকা ত্বকও স্বাভাবিকের তুলনায় খুব বেশি প্রতিক্রিয়াশীল ও সেনসিটিভ হয়ে যায়।
৫. ফটোডার্মাটোসিস (Photodermatoses)
ত্বক অতিরিক্ত স্পর্শকাতর হয়ে ওঠার পেছনে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে ফটোডার্মাটোসিস (Photodermatoses)। এই চর্মরোগের কারনে ত্বক মূলত সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির প্রতি সেনসিটিভ হয়ে ওঠে। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি সরাসরি এই সমস্যায় ভোগা মানুষদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ট্রিগার করে। ফলে ত্বকের যেসব অংশ সূর্যের আলোয় উন্মুক্ত হয়, সেইসব অংশেই ত্বক লাল হয়ে খুব দ্রুত র্যাশ, ফুসকুড়ি, জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যেতে পারে।
৬. কিউট্যানিয়াস মাস্টোসাইটোসিস (Cutaneous mastocytosis)
মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় মাস্ট কোষ (Mast Cells) হচ্ছে এমন কিছু শ্বেত রক্তকণিকা, যা আমাদের শরীরের কানেক্টিভ টিস্যুগুলোয় পাওয়া যায়। এগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অংশ হিসেবে ইমিউন সিস্টেমকে সাহায্য করে। আর মাস্টোসাইটোসিস হচ্ছে ত্বকের এমন একটি অবস্থা, যেখানে ত্বকের নিচের মাস্ট কোষগুলোর সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা বেড়ে যায়।
যখনই ত্বকে কোন রকম হুমকি বোধ করে, তখনই এই কোষগুলো কিছু রাসায়নিক উপাদান ছেড়ে দেয়। যাদের মাস্ট কোষ বেড়ে যায়, তাদের ক্ষেত্রে এই রাসায়নিক উপাদান নিঃসরণের পরিমাণও হয় বেশি। কখনো আবার অপ্রয়োজনীয়ও। আর এই অতিরিক্ত নিঃসরিত রাসায়নিক উপাদানের প্রভাবে ত্বকে লালচে ছোপ, চুলকানি ইত্যাদি দেখা দেয়।
কারনে, অকারনে প্রতিক্রিয়া দেখায় বলে, কিউট্যানিয়াস মাস্টোসাইটোসিসও ত্বক সেনসিটিভ হওয়ার একটি কারণ।
৭. একোয়াজেনিক প্রুরিটাস (Aquagenic Pruritus)
চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রুরিটাস অর্থ হচ্ছে চুলকানি। আর একোয়াজেনিক মানে হচ্ছে পানি সম্পর্কিত। এর থেকে নিশ্চয়ই ধারনা করা যাচ্ছে যে, একোয়াজেনিক প্রুরিটাস রোগটি হচ্ছে পানি থেকে হওয়া চুলকানি নিয়ে। এই রোগে আক্রান্তদের ত্বক মূলত পানির প্রতি সেনসিটিভ হয়ে যায়। পানির সংস্পর্শে আসলেই শুরু হয় প্রচুর চুলকানি, যা স্থায়ী হতে পারে কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত।
কিভাবে চিকিৎসা করা হয়?
কারো ত্বক সেনসিটিভ হয়ে থাকলে, সেটা কোন চিকিৎসাতেই রাতারাতি বদলে ফেলা সম্ভব না। তবে কিছু বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে সেনসিটিভ ত্বক থেকে হওয়া যন্ত্রনা ও ভোগান্তি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। জেনে নেই সেনসিটিভ ত্বকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দূর করতে কি ধরণের চিকিৎসা বা পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।
- ত্বক খুব বেশি শুষ্ক ও ফাটাফাটা হয়ে থাকলে, দিনে অন্তত দুই থেকে তিনবার ভালো ময়েশ্চারাইজিং ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। এতে ত্বকের কোষের ভেতর থেকে হারানো আর্দ্রতা ফিরে পারে। ত্বক বারবার শুষ্ক হয়ে সুরক্ষা বলয় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও কমবে।
- ডিওডোরেন্ট (Deodorant) বা দুর্গন্ধনাশক যে কোন কিছু, উচ্চ মাত্রায় ক্ষার ও কৃত্রিম সুগন্ধিযুক্ত সাবান, ফেইসওয়াশ, ক্রিম, ইত্যাদি ত্বকে ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, এগুলো সেনসিটিভ স্কিনকে দ্রুত ট্রিগার করে।
- ক্ষারহীন, মৃদু প্রকৃতির ক্লিনজার, বডিওয়াশ ইত্যাদি ব্যবহার করা ভালো। এগুলো ত্বকের স্বাভাবিক আর্দ্রতা ও তেল নষ্ট করবে না।
৮-১৪ দিন পরপ পর ত্বক এক্সফোলিয়েট বা স্ক্রাব করা যেতে পারে। ঘন ঘন এক্সফোলিয়েট বা স্ক্রাব সেনসিটিভ ত্বককে আরও সেনসিটিভ করে তুলে।
- যাদের একজিমা আছে, তাদের খুব ঘন ঘন চুলকানির সমস্যা হয়। এই চুলকানির সমস্যার জন্য চুলকানি দূর করার ক্রিম বা অয়েনমেন্ট রাখতে হবে সাথে সবসময়। সাথে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে ময়েশ্চারাইজার। চুলকানি অতিরিক্ত বেশি হলে, সাথে সাথেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
- যাদের এলার্জির কারনে ত্বকে সেনসিটিভিটির সমস্যা দেখা দেয়, তাদের এলার্জিজনিত সমস্যা কমানোর জন্য সাধারনত এন্টি-হিস্টামিন জাতীয় ওষুধই কাজে লাগে।
- রোজেসিয়া, মাস্টোসাইটোসিস, একোয়াজেনিক প্রুরিটাস এইধরনের চর্মরোগগুলোর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ নিয়মমতো অনুসরণ করা খুব জরুরী। মুখে খাওয়ার ওষুধ থেকে শুরু করে, ক্রিম, অয়েনমেন্ট, স্টেরয়েড, রোগের ধরন ও প্রচণ্ডতা ভেদে যে কোন রূপে হতে পারে ওষুধ।
- ফটোডার্মাটোসিসের ক্ষেত্রেও চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ ব্যবহার করতে হবে গুরুত্ব দিয়ে। এছাড়াও ত্বকের অস্বস্তি কমাতে নিজে থেকেই ব্যবহার করতে হবে ভালো মানের ৩০+ এসপিএফ (SPF) যুক্ত সানস্ক্রিন। বাইরে গেলে ত্বক যেন সরাসরি রোদ বা অতিবেগুনী রশ্মিতে উন্মুক্ত না থাকে, সেইজন্য ব্যবহার করা যেতে পারে বড় ওড়না, হ্যাট বা টুপি।
- ত্বকে ব্যবহারের জন্য ময়েশ্চারাইজার, ক্লিনজার বা অন্য যে কোন কিছু কেনার আগে সেই প্রোডাক্টের গায়ে থাকা ইনগ্রিডিয়েন্টস বা উপাদানের লিস্ট ভালো করে দেখে নিতে হবে। সেই সব উপাদান সেনসিটিভ ত্বকের জন্য উপযুক্ত হলেই কেবল সেই প্রোডাক্ট ত্বকে ব্যবহার করতে হবে।
খুব গরম পানি, বা খুব ঠাণ্ডা পানি- উভয়ই সেনসিটিভ স্কিনকে প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলতে পারে।
(Jaliman D, 2022)
অনেকেই সেনসিটিভ স্কিনের অধিকারীদের ভোগান্তি বেশি হয়, শুধুমাত্র এর ব্যাপারে বিস্তারিত জানা ও সচেতনতার অভাবের কারনে। সেনসিটিভ স্কিনে হওয়া নানান অস্বস্তি দিন দিন বাড়তে পারে, যদি না আপনি সঠিকভাবে এর পেছনের কারণ ও প্রতিকার না জানেন।
References
Jaliman D. (2022, November 16) 20 Common Questions About Sensitive Skin, Retrieved from Webmd: https://www.webmd.com/beauty/sensitive-skin-20-questions
Cobb C. (2019, August 8) What Causes Sensitive Skin and How Can I Care for It?, Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/skin-disorders/sensitive-skin
Last Updated on October 31, 2023
Leave A Comment