সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ভালো ঘুমের গুরুত্ব অপরিসীম। নানাবিধ কারণে ঘুমের সমস্যা দেখা যায় যার মধ্যে স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep Apnea) অন্যতম একটি কারণ। এটি শুধু ভালো ঘুমের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে তাই নয়, বরং কখনো কখনো এটি ঘুমের মধ্যে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া কেন হয়, কাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে, স্লিপ অ্যাপনিয়ার ধরন, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং জটিলতা সমূহ সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep Apnea) কি?
গ্রীক শব্দ ‘Apnea’ অর্থ হলো শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া আর Sleep মানে ঘুম এটা সবারই জানা। ঘুমের মধ্যে কোনো কারণবশত শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep apnea) বলা হয়। (Cleveland Clinic, 2022)
শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চলার পথে (নাক, গলা ও শ্বাসনালী) প্রতিবন্ধকতা অথবা মস্তিষ্ক থেকে সিগন্যাল ব্যাহত হলে স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়ে থাকে।
শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রমে ব্যঘাত ঘটার ফলে রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। এমতাবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চালু করার জন্য ঘুম ভেঙ্গে যায়। আবার যদি ঘুম ভেঙ্গে না যায় তথা শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুনরায় চালু না হয় সেক্ষেত্রে মৃত্যু হতে পারে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া জনিত মৃত্যু খুব বিরল ঘটনা অর্থাৎ সচরাচর এমনটি হয় না। তবে স্লিপ অ্যাপনিয়ার ফলে বার বার ঘুম ভেঙ্গে যায় অর্থাৎ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে থাকে যা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep Apnea) এর ধরন
কারণ অনুযায়ী স্লিপ অ্যাপনিয়া মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (OSA- Obstructive sleep apnea)
Obstructive অর্থ হলো প্রতিবন্ধকতা অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চলার পথে (নাক, গলা ও শ্বাসনালী) কোনো বাঁধার ফলে এই ধরনের স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়ে থাকে। এটি সবচাইতে কমন প্রকৃতির স্লিপ অ্যাপনিয়া।
সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া (CSA- Central sleep apnea)
এক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চলার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। তবে শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চলার জন্য মস্তিষ্ক থেকে প্রতিনিয়ত যে সিগন্যাল আসে তা কোনো কারণবশত ব্যাহত হয়ে এমন সমস্যা হয়ে থাকে।
এই দুই ধরনের মিশ্রণে স্লিপ অ্যাপনিয়া হলে তাকে Mixed/complex sleep apnea বলা হয়।
তীব্রতা অনুযায়ী স্লিপ অ্যাপনিয়া ৩ ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ
- Mild sleep apnea: মৃদু প্রকৃতির সমস্যা যেখানে রাতে ঘুমানোর সময় প্রতি ঘন্টায় ৫ থেকে ১৫ বার শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রমে সমস্যা হয়।
- Moderate sleep apnea: মাঝারি প্রকৃতির সমস্যা যেখানে রাতে প্রতি ঘন্টায় ১৫ থেকে ২৯ বার পর্যন্ত শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে থাকে।
- Severe sleep apnea: তীব্র সমস্যা যেখানে রাতে প্রতি ঘন্টায় ৩০ বারের বেশি শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে থাকে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep Apnea) এর কারণ
অবস্ট্রাকটিভ ও সেন্ট্রাল দুই ধরনের স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণ এবং ঝুঁকির কারণ (Risk factors) ভিন্নতর হয়ে থাকে। (Mayo Clinic, 2023)
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (OSA)
- শরীরের অতিরিক্ত ওজনের সাথে এই ধরনের স্লিপ অ্যাপনিয়া হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। শরীরে অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি জমে যাওয়ার ফলে এমনটি হয়ে থাকে।
- যাদের গলা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু সরু প্রকৃতির তাদের ক্ষেত্রে শ্বাসনালী সরু হয়ে থাকে যা স্লিপ অ্যাপনিয়া হওয়ার জন্য দায়ী।
- টনসিল বা এডিনয়েড (Adenoids) ইনফেকশনের ফলে ফুলে যাওয়া বা স্বাভাবিকের চেয়ে সাইজে বড় হয়ে গেলে শ্বাসনালীতে চাপ পড়ে যা স্লিপ অ্যাপনিয়া হওয়ার কারণ।
- মহিলাদের তুলনায় পুরুষ মানুষের ক্ষেত্রে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া হওয়ার ঝুঁকি ২ থেকে ৩ গুণ পর্যন্ত বেশি থাকে।
- কম বয়সী মানুষের তুলনায় অধিক বয়স্কদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি ঝুঁকি রয়েছে।
- যাদের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে অর্থাৎ মা বাবা ভাই বোনদের মধ্যে কারো অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকলে তাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
- ধুমপান, মদ্যপান, ঘুমের ওষুধ এবং উদ্বিগ্নতা নিরাময়ের ওষুধ সেবন করেন তাদের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকি রয়েছে।
সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া (CSA)
বয়স্ক ব্যক্তি এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়াও আরো যেসব বিষয় এই ধরনের স্লিপ অ্যাপনিয়ার ঝুঁকি বাড়ায় তা হলোঃ
- স্ট্রোক (Stroke)
- হার্ট ফেইলুর (Heart failure)
- রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া (Hypoxia)
- ব্যথা নাশক ওষুধ সেবন করা
- Parkinson’s disease
- Nervous system damage
- Amyotrophic Lateral Sclerosis
স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep Apnea) এর লক্ষণ
স্লিপ অ্যাপনিয়ার লক্ষণগুলো হলোঃ
নাক ডাকা (Snoring)
স্লিপ অ্যাপনিয়ার ক্ষেত্রে নাক ডাকা খুব কমন একটি লক্ষণ। তবে রোগী নিজে থেকে সাধারণত বুঝতে সক্ষম হয় না যে, সে রাতে ঘুমানোর সময় নাক ডাকে। রোগীর সাথে রাতে থাকেন এমন ব্যক্তির কাছ থেকে এই লক্ষণ সম্পর্কে জানা যায়।
নাক ডাকা মানেই স্লিপ অ্যাপনিয়া নয়, আবার স্লিপ অ্যাপনিয়ার ক্ষেত্রে নাক ডাকা লক্ষণ থাকবেই এমন কোনো কথা নেই। নাক ডাকা লক্ষণ ছাড়াও স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে।
ক্লান্তি বোধ
স্লিপ অ্যাপনিয়ার ফলে রাতে বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনা রোগীর মনে থাকে না। কিন্তু ঘুমের ব্যাঘাত হওয়ার ফলে রাতে দীর্ঘসময় ঘুমানোর পরেও ক্লান্তি দূর হয় না।
দিনে ঘুম পায়
প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের জন্য প্রতিদিন ৭ থেকে ৯ ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন। শুধু সময় ধরে নয়, বরং ভালো ঘুম (Sounds sleep) হতে হবে। স্লিপ অ্যাপনিয়ার ক্ষেত্রে ৯ ঘন্টার বেশি সময় রাতে বিছানায় কাটালেও ভালো মানের ঘুম হয় না বলে দিনে প্রচুর ঘুম পায়।
কাজে মনোনিবেশ করতে পারে না
স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে ঘুমের ঘাটতির ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়। সেই সাথে কাজের প্রতি মনোনিবেশ করতে অসুবিধা হয়।
মানসিক সমস্যা
ঘুমের ঘাটতি হলে তা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে স্লিপ অ্যাপনিয়ার ফলে উদ্বিগ্নতা (Anxiety) ও বিষন্নতা (Depression) দেখা যেতে পারে।
স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে আরো যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ
- রাতে অস্থিরতা
- সকালে মাথাব্যথা
- ইনসোমনিয়া (Insomnia)
- রাতে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
- যৌন সক্ষমতা কমে যাওয়া
শিশুদের ক্ষেত্রে স্লিপ অ্যাপনিয়া
ছোট বড় সব বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে স্লিপ অ্যাপনিয়ার ফলে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ
- নাক ডাকা
- ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে হাত ও পা নাড়াচাড়া করা
- বিছানায় প্রস্রাব করা (Bed-wetting)
- রাতে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
- এসিডিটি বা বুক জ্বালাপোড়া
- চঞ্চলতা এবং পড়ালেখার প্রতি মনোযোগ কমে যাওয়া (ADHD– attention deficit hyperactivity disorders)
স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep Apnea) কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
স্লিপ অ্যাপনিয়া নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক রোগী ও রোগীর সাথে রাতে থাকেন এমন ব্যক্তির মুখ থেকে লক্ষণ শোনা, রোগীর শারীরিক পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় টেস্ট করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।
স্লিপ স্টাডি (Overnight sleep study/ Polysomnogram)
স্লিপ অ্যাপনিয়া নির্ণয়ের জন্য দারুন একটি টেস্ট হলো স্লিপ স্টাডি যেখানে রোগীকে একটি আরামদায়ক ঘরে ঘুমাতে দেওয়া হয়। ঘুমের সময় রোগীর হার্ট রেট, শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা, মস্তিষ্ক তরঙ্গ (Brain waves) ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই পরীক্ষাটি ব্যয়বহুল এবং বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতালে করা যায়। যেমনঃ স্কয়ার, ল্যাব এইড, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল।
অন্যান্য
বিভিন্ন রোগের সাথে স্লিপ অ্যাপনিয়া হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে যেগুলো সম্পর্কে জানার জন্য স্লিপ স্টাডি ছাড়াও আরো যেসব টেস্ট করা লাগতে পারে তা হলোঃ
- এক্সরে
- আল্ট্রাসনোগ্রাফি
- এমআরআই (MRI)
- রক্ত পরীক্ষা (Blood tests)
চিকিৎসা
কারণ অনুযায়ী স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসা ভিন্নতর হয়ে থাকে। যেসব চিকিৎসা পদ্ধতি এক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে তা হলোঃ
- মুখে ওষুধ সেবন করাঃ সাধারণত সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়ার ক্ষেত্রে মুখে ওষুধ সেবনের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে।
- সি-প্যাপ যন্ত্র (CPAP– Continuous positive airway pressure): এটি মুখে মাস্কের মতো পড়তে হয় যা শ্বাসনালীতে অনবরত শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চালু রাখতে সাহায্য করে।
- Oral devices: এটিও একধরনের যন্ত্র যা মুখের ভেতর ব্যবহার করা হয় এবং শ্বাসনালীতে চাপ পড়তে দেয় না।
- সার্জারিঃ নাক, গলা ও শ্বাসনালীতে অস্বাভাবিক টিস্যু বৃদ্ধি থাকলে তা সার্জারির মাধ্যমে অপসারণ করা হয়।
জটিলতা
স্লিপ অ্যাপনিয়ার জন্য যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। যেমনঃ (Benisek, 2021)
- দিনে প্রচন্ড ঘুম পায় যার ফলে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। বিশেষ করে যারা ড্রাইভিং করেন তাদের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
- উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হওয়া
- ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বা টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়া
- রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল (LDL– low density lipoprotein) এর মাত্রা বেড়ে যাওয়া
- লিভারের সমস্যা ইত্যাদি
স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগটিকে অবহেলা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বরং এই রোগের নির্দেশক লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যেমনঃ নাক ডাকা, রাতে দীর্ঘসময় ঘুমানোর পরেও দিনে ক্লান্তি বোধ ও ঘুম ঘুম ভাব ইত্যাদি।
স্লিপ অ্যাপনিয়ার জন্য স্লিপ এক্সপার্ট অথবা নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।
References
Benisek, A. (2021, September 07). Sleep Apnea. Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/sleep-disorders/sleep-apnea/sleep-apnea
Cleveland Clinic. (2022, November 15). Sleep Apnea. Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/8718-sleep-apnea
Mayo Clinic. (2023, April 06). Sleep apnea. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/sleep-apnea/symptoms-causes/syc-20377631
Last Updated on May 28, 2023
Leave A Comment