গলা ব্যথা (Sore throat) নিশ্চয় কোনো সুখকর অনুভূতি নয় বরং গলা ব্যথা হলে খাবার গিলতে খুব কষ্ট হয় এমনকি জোরে কথা বলাও যায় না। আর তাই গলা ব্যথার মতো যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেতে হন্যে হয়ে থাকেন গলা ব্যথায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা। আর বাচ্চাদের গলা ব্যথা হলে সেটা মা বাবার জন্য খুব দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ বাচ্চা খেতে চায় না, জ্বর থাকে এবং দুর্বল হয়ে যায়।

সাধারণত মৃদু প্রকৃতির গলা ব্যথার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বরং কতিপয় ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করার ফলে গলা ব্যথা দূর হয়ে যায়। এই অনুচ্ছেদে গলা ব্যথা কমানোর সহজ ও কার্যকরী ঘরোয়া উপায় সমূহ, গলা ব্যথার ওষুধ, গলা ব্যথা হলে কি কি এড়িয়ে চলতে হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও শিশুদের ক্ষেত্রে গলা‌ ব্যথা হলে করণীয় কি, কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং গলা ব্যথা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

দ্রুত গলা ব্যথা কমানোর উপায় 

যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ড্যানিয়েল এলেন (Daniel Allan) এর মতে যেসব ঘরোয়া পদ্ধতি গলা‌‌ ব্যথা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে তা হলোঃ (Cleveland Clinic, 2022)

১. গরম বা ঠান্ডা তরল খাবার খাওয়া 

গলা ব্যথার ঘরোয়া সমাধান

গলা ব্যথার ক্ষেত্রে তরল‌ খাবার খাওয়ার মাধ্যমে গলার ভেতর মিউকাস দূর হয়ে যায় এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। আর তাই এই সময়ে যতটা সম্ভব তরল খাবার খেতে হবে। যেমনঃ চা, কফি, স্যুপ, জুস‌ ইত্যাদি। 

খাবারের তাপমাত্রা কেমন হওয়া উচিত? 

এই ব্যাপারে নির্দেশনা হলো ঠান্ডা ও গরম দুই ধরনের খাবার খেয়ে দেখতে হবে যে, আপনার জন্য কোনটি আরামদায়ক লাগে। সাধারণত গরম খাবার ভালো লাগে তবে কারো ক্ষেত্রে ঠান্ডা খেয়ে আরাম বোধ হলে তার জন্য কোল্ড কফি, আইসক্রিম, বরফ মেশানো শরবত, জুস ইত্যাদি খেতে হবে। 

২. গড়গড়া করা (Gargling) 

 

গলা ব্যথা দূর করার সবচেয়ে সহজ, বহুল ব্যবহৃত ও কার্যকরী পদ্ধতি হলো গড়গড়া করা। কুসুম গরম পানিতে সামান্য পরিমাণ (১/২ চা চামচ) খাবার লবণ মিশিয়ে দিনে কয়েকবার (৫/৭ বার) গড়গড়া করতে হবে। লবণ মেশানো গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করলে গলার ভেতরে ফোলাভাব ও প্রদাহ কমে যায়। 

 

লবণের পরিবর্তে সামান্য পরিমাণে বেকিং সোডা (Baking soda) মিশিয়ে গড়গড়া করার মাধ্যমেও উপকার পাওয়া যায়। বেকিং সোডা মিউকাস দূর করা, প্রদাহ কমানো এবং পাকস্থলী থেকে খাদ্যনালীর মধ্যে দিয়ে উপরের দিকে উঠে আসা এসিড নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গলা ব্যথা দূর করে।  

৩. গরম বাষ্প নেওয়া 

গরম পানিতে গোসল করা অথবা গরম পানির বাষ্প মুখ দিয়ে টানলে মিউকাস দূর করা সহ গলায় প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। গলা‌‌ ব্যথা কমানোর জন্য দিনে কয়েকবার ৫-১০ মিনিট সময় গরম ভাপ নিতে হবে। 

একটি বড় গামলায় গরম পানি নিয়ে তার পাশে বসে গামলার দিকে মুখ ঝুঁকে বসুন। গামলা থেকে মুখের দুরত্ব ৮-১০ ইঞ্চি হতে হবে। এবার পানি থেকে নির্গত হওয়া বাষ্প মুখ দিয়ে টানতে থাকুন। 

৪. আদা, মধু, লেবু ও গরম পানি 

গরম পানিতে সামান্য পরিমাণে লেবুর রস, এক চামচ মধু, আদা কুচি এবং এক টুকরা দারুচিনি দিয়ে সেই পানি পান করুন। মধু, আদা, লেবুর রস, দারুচিনি ইত্যাদি গলা ব্যথা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৫. বিশ্রাম 

যেকোনো ধরনের অসুস্থতায় বিশ্রামে থাকা উচিত। কারণ বিশ্রামের ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বেশি এনার্জি পায়।‌ আর তাই গলা ব্যথার নিরাময়ের জন্য যতক্ষণ ভালো লাগে বিশ্রাম করুন।‌

৬. ঔষধ 

গলা ব্যথা দূর করার জন্য এন্টিহিস্টামিন ও মৃদু প্রকৃতির ব্যথা নাশক ঔষধ সেবন করা যেতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কিছু ওটিসি‌ (OTC- over the counter) ঔষধ সেবন করা যেতে পারে। যেমনঃ 

  • Paracetamol (Napa®, Ace®, Depyrin®, Fast®, Renova®)
  • Ibuprofen (Advel®, Profen®, Reumafen®, Intaflam®) 
  • Cetirizine (Acitrin®, Alatrol®, Atrizin®, Cetizin®) 
  • Loratadine (Alaron®, Lora®, Lorat®, Loratin®, Oradin®) 

প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের জন্য Cetirizine 10mg, Loratadine 10mg অথবা Fexofenadine 120mg যেকোনো একটি ঔষধ দিনে একবার সেবন করতে হবে। এর পাশাপাশি Paracetamol 500mg অথবা Ibuprofen 400mg দিনে ৩ টি ট্যাবলেট খেতে হবে। জ্বর ও ব্যথা বেশি থাকলে দিনে সর্বোচ্চ ৪ টি ট্যাবলেট ৬ ঘন্টা অন্তর অন্তর খাওয়া যেতে পারে। তবে জ্বর ও ব্যথা কমে গেলে ঔষধ সেবন করা কমিয়ে দিতে হবে। 

 

এন্টিহিস্টামিন ও ব্যথা নাশক এইসব ঔষধ ভরাপেটে খেতে হবে। এন্টি-বায়োটিকের মতো এইসব ঔষধের ডোজ কমপ্লিট করার মতো কিছু নাই।‌ গলা ব্যথা দূর হয়ে গেলে আর ঔষধ খাওয়ার প্রয়োজন হবে না। 

 

শিশুদের জন্য ব্যথা কমানোর উপায় 

শিশুদের ক্ষেত্রে গলা ব্যথা হওয়া খুব কমন একটি সমস্যা তবে একদম ছোট শিশুদের অর্থাৎ ২/৩ বছরের কম বয়সীদের গলা ব্যথা তেমন একটা দেখা যায় না। যা হোক, শিশুদের ক্ষেত্রে গলা ব্যথার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে তা‌ হলোঃ 

  • কুসুম গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে গড়গড়া করা 
  • লেবুর ‌রস, মধু ও আদা সহযোগে গরম পানি পান করা  
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করার ব্যাপারে তাগিদ দিতে হবে 
  • স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে অর্থাৎ হাত মুখ ভালোভাবে ধুতে হবে 
  • শিশুকে স্কুলে না পাঠিয়ে বরং বাড়িতে বিশ্রামে রাখতে হবে। 

 

ঔষধ 

এন্টিহিস্টামিন হিসেবে যেকোনো একটি ঔষধ দিনে একবার এবং সেই সাথে জ্বর ও‌‌ ব্যথা নাশক ঔষধ হিসেবে Paracetamol অথবা Ibuprofen যেকোনো একটি ঔষধ দিনে ২/৩ বার ভরাপেটে খাওয়াতে হবে। 

১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ঔষধের মাত্রা বড়দের মতো হবে না। ১২ থেকে ৬ বছর বয়সীদের জন্য বড়দের তুলনায় অর্ধেক পরিমাণে আর ৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য সিরাপ জাতীয় ঔষধ বোতলের গায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী দিতে হবে। 

 

মুখ থেকে অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ, গলা ব্যথার তীব্রতায় খাবার গিলতে না পারা, শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা হওয়া, গলা ফুলে যাওয়া, ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি জ্বর ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে একজন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ অথবা নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের (ইএনটি) শরণাপন্ন হতে হবে। (Wald, 2023)

 

কি কি এড়াতে হবে? 

গলা ব্যথা হলে কিছু কিছু খাবার, অভ্যাস এবং পরিবেশগত বিষয় এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ এগুলো গলা‌ ব্যথার লক্ষণ আরো খারাপ করে দিতে পারে অথবা রোগ নিরাময়ে বাঁধার সৃষ্টি করে থাকে। যেমনঃ 

  • শুষ্ক আবহাওয়া 
  • ধুমপানের অভ্যাস  
  • দূষিত বায়ুতে বসবাস 
  • ফুলের রেণু ও প্রাণির পশম 
  • চিপস ও পপকর্ণ 
  • কোমল পানীয় পান করা 
  • অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার 
  • অ্যালকোহল বা মদ্যপান করা  

এছাড়াও খাবার খাওয়ার পর পরই শোয়া যাবে না। কারণ খাওয়ার পরে পাকস্থলীতে হজমের জন্য এসিড নিঃসরণ হয় যা শুয়ে পড়ার ফলে খাদ্যনালীর মধ্যে দিয়ে গলায় চলে আসতে পারে।‌ আর তাই খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বসে থাকা অথবা হাঁটাহাঁটি করা উচিত। 

গলা ব্যথা সম্পর্কে সচরাচর কিছু প্রশ্ন

১. গলা ব্যথা হওয়ার কারণ কি? 

গলা ব্যথার সবচেয়ে কমন কারণ হলো ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়া‌। তবে ভাইরাস ছাড়াও আরো যেসব কারণে গলা ব্যথা হয়ে থাকে তা‌ হলোঃ (Story, 2022)

  • এলার্জি (Allergy) 
  • ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ 
  • বায়ু দূষণ (Air pollution)
  • গলায় টিউমার বা ক্যান্সার 
  • GERD– Gastroesophageal reflux disease বা এসিডিটি 

২. গলা ব্যথা কতদিন স্থায়ী হয়? 

গলা ব্যথা কতদিন স্থায়ী হবে তা কারণের উপর ভিত্তি করে কম বেশি হয়ে থাকে। ভাইরাস জনিত গলা ব্যথা তেমন জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে না এবং এর জন্য কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন, ওটিসি‌ মেডিসিন, বিশ্রাম নেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ৩ থেকে ৭ দিনের ভেতর ভালো হয়ে যায়। 

ব্যাকটেরিয়া জনিত গলা‌ ব্যথার ক্ষেত্রে গলা ব্যথা তীব্রতর হয়ে থাকে এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী এন্টি-বায়োটিক ঔষধ সেবন করার প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে প্রায় ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায় তবে এন্টি-বায়োটিক সেবন না করলে রোগ আরো জটিলতর হতে থাকে এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভোগায়। 

বায়ু দূষণ, এসিডিটি (GERD), টিউমার ইত্যাদির কারণে গলা ব্যথা হলে সেক্ষেত্রে যতদিন না কারণ দূর করা না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত সমস্যা থেকে যায়। 

৩. গলা ব্যথা কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়? 

  • তিন মাস অন্তর অন্তর টুথব্রাশ পরিবর্তন করতে হবে 
  • অসুস্থ ব্যক্তিদের সংস্পর্শ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে 
  • সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুতে হবে। অপরিষ্কার হাতে নাক, মুখ ও চোখে টাচ করা যাবে না 
  • অতিরিক্ত ঝাল, মশলাযুক্ত ও গরম খাবার খাওয়া যাবে না 
  • ধুমপান বর্জন করা জরুরী। 

 

References

Cleveland Clinic. (2022, February 21). 6 Sore Throat Remedies That Actually Work. Retrieved from Cleveland Clinic: https://health.clevelandclinic.org/sore-throat-remedies-that-actually-work/

Story, C. M. (2022, July 27). Sore Throat Remedies That Work (and What Not to Do). Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/cold-flu/sore-throat-natural-remedies

Wald, E. R. (2023, February). Patient education: Sore throat in children (Beyond the Basics). Retrieved from uptodate: https://www.uptodate.com/contents/sore-throat-in-children-beyond-the-basics/print

 

Last Updated on April 9, 2023