সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিয়মমাফিক খাদ্য গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অনিয়মিত জীবন যাপন, খাবারের প্রতি অরুচি, আলসেমি ইত্যাদি নানাবিধ কারণে খাদ্য গ্রহণ সঠিকভাবে করা হয়ে উঠে না অনেকেরই। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে আবার সঠিক নিয়ম মেনে খেতে না পারার কারণ থাকে ইটিং ডিজঅর্ডার (eating disorders) বা খাওয়ার অসুখ।
খাওয়ার অসুখ বিষয়টি অনেকের কাছেই অপরিচিত মনে হতে পারে এমনকি কেউ কেউ হয়তোবা এই রোগে ভুগছেন অথচ এটি যে একটি রোগ তা বুঝতেই পারছেন না। এই অনুচ্ছেদে ইটিং ডিজঅর্ডার বা খাওয়ার অসুখের কারণ, খাওয়ার অসুখ কত ধরনের হয়ে থাকে, কি কি লক্ষণ দেখা যায় এবং চিকিৎসা পদ্ধতি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। (Petre, 2022)
Table of Contents
খাওয়ার অসুখ (Eating Disorders) কি?
খাওয়ার সাথে সম্পর্কিত হলেও এটি মূলত একটি মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর খাওয়ার সমস্যা কোনো শারীরিক অসুস্থতা জনিত নয় বরং কতিপয় মানসিক সমস্যার কারণে রোগী খাওয়ার ব্যাপারে অনিয়ম করে থাকেন।
খাবার, শরীরের ওজন ও শারীরিক গঠন কেন্দ্রিক অস্বাভাবিক চিন্তাভাবনা থেকে এই রোগের (eating disorders) উৎপত্তি হয়ে থাকে।
আক্রান্ত রোগী সাধারণত নিজেকে কখনো অস্বাভাবিক হিসেবে মনে করেন না। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো এই রোগটির জন্য যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে এমনকি তা অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
খাওয়ার অসুখের কারণ?
ইটিং ডিজঅর্ডার বা খাওয়ার অসুখের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো জিনগত (genetics) প্রভাব। পিতা মাতা অথবা ভাই বোনের এই রোগ থাকলে তাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অনেক বেশি ঝুঁকি রয়েছে।
এছাড়াও নিজেকে পার্ফেক্ট হিসেবে উপস্থাপন করার অস্বাভাবিক ইচ্ছা, সমাজ ও বন্ধু মহলের সমালোচনার প্রভাব, মোটা হয়ে গেলে দেখতে কুৎসিত লাগবে এবং মানুষ নিন্দা করবে এমন ভয়ের কারণে খাওয়ার অসুখ হতে পারে। তবে খাওয়ার অসুখের সুস্পষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়ার জন্য গবেষণা বিদ্যমান রয়েছে।
খাওয়ার অসুখের লক্ষণগুলি কী কী?
খাওয়ার অসুখের ধরন ও তীব্রতা অনুযায়ী লক্ষণ ভিন্নতর হয়ে থাকে। তবে খাবার ও শরীরের ওজন বিষয়ে রোগীর অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা এই রোগের সবচেয়ে কমন লক্ষণ। খাওয়ার অসুখে আক্রান্ত রোগীদের শারীরিক ও মানসিক যেসব লক্ষণ দেখা যেতে পারে তা হলোঃ
মানসিক লক্ষণ:
- রোগীর চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হলো শরীরের ওজন, খাবার, ক্যালরি, ফ্যাট, ডায়েট ইত্যাদি
- শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার তীব্র ভয়ে অস্থির থাকে
- খাবার গ্রহণের সময়ে নানাবিধ অজুহাত দেখিয়ে খেতে না চাওয়া
- সবসময় কম ক্যালোরি যুক্ত খাবার খাওয়ার প্রতি আগ্রহ দেখা যায়
- খাদ্যবস্তু নয় এমন জিনিস খাওয়া
- খাবার গ্রহণের পর অনুতপ্ত বোধ
- জনসম্মুখে খাবার খেতে চায় না
- ক্ষুধার প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া
- ঘন ঘন শরীরের ওজন চেক করা
- শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যায়াম করা
- কোন কাজে মনোযোগ দিতে পারে না
শারীরিক লক্ষণ:
- শরীরের ওজন কমে যাওয়া
- পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব ও বমি
- দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ
- ঘুমের সমস্যা দেখা যায়
- ত্বকের শুষ্কতা
- নখ পাতলা হয়ে যায়
- চুল পড়ে যাওয়া
- ক্ষতস্থান সহজে সারতে চায় না
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়
- মহিলাদের ক্ষেত্রে পিরিয়ড হয় না
এছাড়াও হার্ট রেট কমে যাওয়া সহ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এনিমিয়া (Anemia), শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, রক্তে পটাশিয়ামের ঘাটতি এবং রক্তকণিকা কমে যেতে দেখা যায়। তবে শুধুমাত্র লক্ষণ দেখে এই রোগ হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায় না। বরং উল্লেখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিস্ট) এর শরণাপন্ন হয়ে রোগ নির্ণয় করতে হবে।
খাওয়ার অসুখের ধরন
খাওয়ার অসুখের বেশ কিছু ধরন রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৬ টি সম্পর্কে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা (Anorexia nervosa)
খাওয়ার অসুখের সবচেয়ে কমন ধরন হলো অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা যা সাধারণত টিনেজারদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বেলায় এই সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসায় আক্রান্ত রোগী মনে করেন যে তার শরীরের ওজন অনেক বেশি আর তাই সে খুব কম ক্যালোরি সমৃদ্ধ খাবার খেতে চায় অথবা না খেয়ে থাকে এবং ঘন ঘন নিজের শরীরের ওজন চেক করে।
শরীরের ওজন স্বাভাবিক থাকুক অথবা কম বেশি যাই হোক না কেন শুধু ওজনের উপর নির্ভর করে এই রোগ নির্ণয় করা হয় না। বরং খাবার গ্রহণ ও ওজন কেন্দ্রিক অস্বাভাবিক আচরণ হলো এই রোগের প্রধান নির্দেশক লক্ষণ।
দীর্ঘদিন যাবত অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসায় আক্রান্ত থাকলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হয়। বিশেষ করে হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া সহ চুল, ত্বক ও নখের ক্ষতি হয়। এছাড়াও মহিলাদের ক্ষেত্রে পিরিয়ড হয় না, নারী পুরুষ উভয়ের জন্য বন্ধাত্ব্য সমস্যা দেখা যায় এবং জটিল পর্যায়ের ক্ষেত্রে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে রোগীর অকাল মৃত্যু হতে পারে।
বুলিমিয়া নার্ভোসা (Bulimia nervosa)
বুলিমিমা নার্ভোসার রোগীরা খাবার সামনে পেলে নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে অল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণে খাবার গ্রহণ করে। পরবর্তীতে এই কাজের জন্য অনুতপ্ত হয় এবং খাবার যেন শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে না দাঁড়ায় তার জন্য অস্বাভাবিক আচরণ করে। যেমনঃ গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করা অথবা ল্যাক্সাটিভ ঔষধ সেবন করে যেন মলত্যাগের মাধ্যমে খাবার শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।
বুলিমিয়া নার্ভোসার রোগীদের অস্বাভাবিক আচরণের ফলে গলায় ক্ষত হওয়া, পানি স্বল্পতা, ইলোক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা সহ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হতে পারে।
বিনজ ইটিং ডিসঅর্ডার (Binge eating disorder)
বিনজ ইটিং ডিসঅর্ডার রোগীরা বুলিমিয়া নার্ভোসার মতো নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে অল্প সময়ে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করে। পরবর্তীতে খুব অনুতপ্ত হয় তবে বুলিমিয়া নার্ভোসার মতো অস্বাভাবিক আচরণ করে না। এই সমস্যার জটিলতা হিসেবে হার্টের রোগ, স্ট্রোক ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস হতে পারে।
Pica
Pica আক্রান্ত রোগীদের খাদ্যবস্তু নয় এমন জিনিস খাওয়ার প্রতি তীব্র ইচ্ছা থাকে। যেমনঃ কাগজ, চক, সাবান, কাপড়, মাটি, চুল, বরফ ইত্যাদি। সাধারণত অটিজম ও সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। এই সমস্যার জটিলতা হিসেবে ফুড পয়জনিং, পুষ্টিহীনতা, ইনফেকশন ইত্যাদি হতে পারে।
Rumination disorder
এই রোগে আক্রান্ত রোগী খাবার খাওয়ার পরে সেই খাবার উদগীরণ (regurgitation) করে এবং পুনরায় চিবিয়ে খায় অথবা ফেলে দেয়। এটি খাবার গ্রহণ সম্পর্কিত অস্বাভাবিক আচরণ জনিত একটি রোগ। সাধারণত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি দেখা যায়। তবে কদাচিৎ বড়দের ক্ষেত্রেও দেখা যেতে পারে। বড়দের ক্ষেত্রে এই লক্ষণটির পাশাপাশি কম খাবার খাওয়ার প্রবণতা থাকে।
ARFID (Avoidant/restrictive food intake disorder)
এই রোগে আক্রান্ত রোগী খাবারের গন্ধ, স্বাদ, রং ইত্যাদি অপছন্দ করে অথবা খাবারের প্রতি অনিহার ফলে প্রায়ই না খেয়ে থাকে যার ফলে শরীরে পুষ্টিহীনতা দেখা যায়। কালচার বা ধর্মীয় চিন্তাভাবনা থেকে কোনো খাবার খেতে না চাইলে সেটি ARFID এর অন্তর্ভুক্ত হবে না।
আপনার খাওয়ার অসুখ (Eating Disorders) আছে কিনা তা কীভাবে বুঝবেন?
খাওয়ার অসুখের লক্ষণ ও ধরন জেনে হয়তোবা অনেকেই নিজেকে অসুস্থ মনে করতে পারেন। বিশেষ করে অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা, Pica, ARFID ইত্যাদি রোগগুলো মানুষের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ অনেক সময়েই মানুষ খাবার গ্রহণে অনিহা দেখায় বা শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চিন্তিত হয় যা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
আপনার কার্যক্রম ও চিন্তাভাবনা নিজের কাছে অথবা অন্যদের দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক বলে মনে হলে খাওয়ার অসুখ হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে।
খাওয়ার অসুখ একটি মানসিক রোগ আর মানসিক রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখে সাধারণ মানুষের পক্ষে রোগ নির্ণয় করা বা ধরন বোঝা সম্ভব নয়। বরং অনেক সময় অসুস্থ ব্যক্তি বুঝতেই পারেন না যে তার আচরণ অস্বাভাবিক। এর জন্য পরিবারের অন্য সদস্যরা সচেতন হয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যেতে হবে। রোগের বর্ণনা শুনে, আচরণ দেখে এবং কতিপয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করার মাধ্যমে সাইকিয়াট্রিস্ট রোগ নির্ণয় করবেন। (Higuera, 2016)
খাওয়ার অসুখের চিকিৎসা
খাওয়ার অসুখ নিরাময়ের জন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর শরণাপন্ন হয়ে নিয়মিত সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং করতে হবে।
সেই সাথে মানসিক সমস্যা নিরাময়ে যেসব ঔষধ ব্যবহৃত হয় সেগুলো নিয়ম মেনে সেবন করতে হবে। এছাড়াও একজন পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে যার কাছ থেকে শরীরের ওজন, খাবার, পুষ্টিগুণ ও ক্যালোরি সম্পর্কে সঠিক ধারণা এবং স্বাস্থ্যকর ডায়েটের নির্দেশনা পাওয়া যাবে।
খাওয়ার অসুখে আক্রান্ত রোগীদের জন্য পরিবার ও বন্ধুদের সাপোর্ট পাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সবার সাথে শেয়ার করা এবং আন্তরিকতা বজায় রেখে চলার মাধ্যমে দ্রুত সুস্থতা লাভ করা সম্ভব।
References
Higuera, V. (2016, December 19). Diagnosing an Eating Disorder. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/eating-disorders-diagnosis
Petre, A. (2022, May 18). 6 Common Types of Eating Disorders (and Their Symptoms). Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/common-eating-disorders
Last Updated on April 9, 2023
Leave A Comment