বর্তমান যুগে মানুষ স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক সচেতন। পেটের মেদ বা চর্বি কমানোর জন্য মানুষ বিভিন্ন ধরনের উপায় অবলম্বন করে থাকে। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে পেটের মেদ বা চর্বি অনেকটা কমানো সম্ভব। খাদ্য তালিকায় ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেমনঃ লাল চাল বা লাল আটার তৈরি খাবার এবং শাকসবজি ও ফলমূল জাতীয় খাবার রাখতে হবে। 

গ্রিন টিতে আছে এন্টিঅক্সিডেন্ট যা পেটের মেদ কমাতে খুব বেশি কার্যকর। যাদের চা পানের অভ্যাস রয়েছে তারা দুধ, চিনি মিশ্রিত চায়ের বদলে গ্রিন টি পানের অভ্যাস করলে পেটের মেদ কমাতে বেশ কার্যকর হবে। তবে খাদ্যের পাশাপাশি নিয়ম মেনে কিছু ব্যায়াম করলে খুব দ্রুত পেটের মেদ বা চর্বি কমবে। আজকে আমরা পেটের মেদ বা চর্বি কমানোর কিছু ব্যায়াম নিয়ে আলোচনা করব। 

পেটের মেদ কমানোর ব্যায়াম

১.অ্যারোবিক (Aerobic) বা কার্ডিও ব্যায়াম

অ্যারোবিক (Aerobic) ব্যায়ামকে কার্ডিও ব্যায়ামও বলা হয়। অ্যারোবিক ব্যায়ামের সময় হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের কার্যক্রম বেড়ে যায়। এই ধরনের কিছু ব্যায়াম হলো- হাঁটা, জগিং, দৌড়ানো, সাইক্লিং, সাঁতার, হাইকিং, দড়ি লাফালাফি, নাচানাচি, সিঁড়ি আরোহন, খেলাধুলা করা ইত্যাদি। 

জগিং:

গবেষণায় দেখা গেছে যে, জগিং করা এবং দৌড়ানো পেটের চর্বি কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জগিং এবং দৌড়ানো প্রায় একই রকমের ব্যায়াম যাদের মধ্যে পার্থক্য শুধু গতিতে।‌ অর্থাৎ জগিং এর চেয়ে দৌড়ানোর ক্ষেত্রে গতি খানিকটা বেশি থাকে। 

৭০ কেজি ওজনের ব্যক্তি ঘন্টায় ৮ কিমি গতিতে ৩০ মিনিট জগিং করার ফলে ২৮৮ ক্যালরি বার্ন হয় আর একই ওজনের ব্যক্তি যদি ৯.৭ কিমি গতিতে ৩০ মিনিট দৌড়ায় তবে ৩৬০ ক্যালরি বার্ন হবে যা জগিং এর তুলনায় ৭২ ক্যালরি বেশি বার্ন করে থাকে। 

হাঁটা:

সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ প্রকৃতির ব্যায়াম হলো হাঁটাহাঁটি করা যা সব বয়সের মানুষের জন্য উপযোগী। সহজ এই ব্যায়ামটি শুরু করার জন্য বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ অথবা যন্ত্রপাতির দরকার হয় না বরং দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজকর্ম ও চলাফেরার সময় এটি সম্পন্ন করা যেতে পারে। 

এক মাইল হাঁটলে ১০০ ক্যালরি খরচ হয়। পেটের মেদ কমানোর জন্য প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটা প্রয়োজন।

জার্নাল অফ এক্সারসাইজ নিউট্রিশন অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্থূল মহিলারা যারা ১২ সপ্তাহ ধরে প্রতি সপ্তাহে তিন দিন ৫০ থেকে ৭০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করেছিলেন তাদের পেটের চর্বি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। (GREGORY, 2022) 

সাইক্লিং 

শরীরের ওজন কমানো ও বডি ফিটনেস ভালো রাখার জন্য সাইক্লিং করা খুব ভালো একটি ব্যায়াম হতে পারে। হার্ভার্ড হেলথ এর তথ্য অনুযায়ী ৭০ কেজি ওজনের ব্যক্তি মধ্যম গতিতে (ঘন্টায় ১৯ থেকে ২২ কিমি) স্টেশনারি বাইকের সাহায্যে ৩০ মিনিট সাইক্লিং করলে ২৬০ ক্যালরি বার্ন হয়। 

অপরদিকে একই ওজনের কোনো ব্যক্তি যদি বাইসাইকেল ব্যবহার করে সমান গতিতে ৩০ মিনিট সাইক্লিং করে তবে সেক্ষেত্রে ২৯৮ ক্যালরি বার্ন হবে। বাইসাইকেল চালানোর আরেকটি সুবিধা হলো বাইরের সুন্দর পরিবেশ উপভোগ করা যাবে। 

সাঁতার 

২৪ জন মধ্যবয়সী নারীর উপর ১২ সপ্তাহ ধরে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে, প্রতিদিন ১ ঘন্টা করে সপ্তাহে ৩ দিন সাঁতার কাটার ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পেটের মেদ কমে গেছে। 

যাদের জয়েন্টে সমস্যা রয়েছে অথবা ভারী প্রকৃতির ব্যায়াম করতে পারেন না তাদের জন্য সাঁতার সুবিধাজনক ব্যায়াম হতে পারে। 

কতটুকু করা উচিত

  • প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারী তীব্র অ্যারোবিক ব্যায়াম করা উচিত। যেমন – ঘন্টায় ৩.৮ – ৬.৫ কিলোমিটার দ্রুত হাঁটা বা ঘন্টায় ৮-১৪.৪ কিলোমিটার সাইক্লিং বা নাচ করা।
  • অথবা, প্রতি সপ্তাহে ৭৫ মিনিট তীব্র অ্যারোবিক ব্যায়াম করা। যেমন জগিং, রানিং, হাইকিং বা ১৫ কিলোমিটারের বেশি সাইক্লিং।
  • অথবা, মাঝারী বা জোরালো শারীরিক ব্যায়াম সমন্বয় করেও করা যেতে পারে।

কীভাবে ব্যায়াম শুরু করা উচিত

সারাদিন বসে থাকা ব্যক্তিরা এটি দ্রুত শুরু করে ধীরে ধীরে ব্যায়ামের তীব্রতা, সময়কাল এবং ফ্রিকোয়েন্সি বাড়াবে।

অ্যারোবিক ব্যায়ামের সুবিধা

  • রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে ও শরীরকে অক্সিজেন ভালোভাবে ব্যবহার করতে শেখায়।
  • সহনশীলতা বাড়ায় বা ওজন কমাতে সহায়তা করে।
  • হার্টের কার্যকারিতা উন্নত করে ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
  • ফুসফুসের কার্যকারিতা উন্নত করে।
  • উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করে।
  • ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।
  • দেহের প্রদাহ কমায়।
  • উচ্চ কোলেস্টেরল বা ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়ন্ত্রণ করে।
  • HDL বা ভালো কোলেস্টেরলকে বৃদ্ধি করে।

২. HIIT বা ইন্টারভাল ট্রেনিং

HIIT এর পূর্ণরূপ হলো High-intensity interval training যা করার নিয়ম হলো খুব দ্রুত গতিতে কিছুক্ষণ করে দৌড়ানো এবং তারপর একটু সময় বিশ্রাম নেওয়া। এই প্রক্রিয়ায় এক দিনে কয়েকবার ব্যায়াম করতে হবে যা অন্যান্য ব্যায়ামের তুলনায় বেশি পরিমাণে ক্যালরি বার্ন করতে সাহায্য করে।‌ গবেষণায় দেখা গেছে যে দৌড়ানো, সাইক্লিং ও ভার উত্তোলন করার চেয়ে  ইন্টারভাল ট্রেইনিং করার মাধ্যমে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি ক্যালরি বার্ন হয়ে থাকে। 

ইন্টারভাল ট্রেইনিং করার ফলে পেটের মেদ কমে যায় এবং শরীরের মাংসপেশীগুলো সবল হয়। HIIT ব্যায়াম করার জন্য ট্রেডমিল ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো। কারণ এক্ষেত্রে সহজে দৌড়ের গতি বাড়ানো এবং কমানো যায়। 

বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের হাঁটুতে সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এই ধরনের ব্যায়াম করা কষ্টকর হবে।

৩. পেটের ব্যায়াম

পেটের চর্বি কমানোর সবচেয়ে ভালো ব্যায়াম হলো ক্রাঞ্চ ব্যায়াম। এই ব্যায়াম করার জন্য হাঁটু বাঁকিয়ে এবং মাটিতে পা রেখে সমতল মেঝেতে শুয়ে নিতে হবে। দুই হাত তুলে ছবির মতো করে মাথার পেছনে রাখুন‌। এবার মাথা ও পিঠ বাঁকিয়ে হাঁটুর কাছে নিয়ে যাবেন। এভাবে ১০ থেকে ১৫ বার ব্যায়াম করুন। 

 

পেটের ব্যায়াম

 

৪.ভারোত্তোলন প্রশিক্ষণ

প্রিডায়াবেটিস, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পেটের চর্বি হ্রাসের জন্য ভারোত্তোলন প্রশিক্ষণ অনেক উপকারী। অতিরিক্ত ওজনের কিশোর- কিশোরীদের নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভারোত্তোলন প্রশিক্ষণ (ওজন উত্তোলন) এবং কার্ডিও ব্যায়ামের সংমিশ্রণ পেটের মেদ বা চর্বি সর্বাধিক হ্রাস করতে কার্যকরী। (Spritzler, 2023) 

ভারোত্তোলন প্রশিক্ষণ

সতর্কতা

জগিং ও দৌড়ানো শুরু করার জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। যেমনঃ স্পোর্টস সু (জুতা) ও আরামদায়ক পোশাক পরিধান করতে হবে। খোলা ময়দানে, ফাকা রাস্তায় অথবা পার্কে জগিং করা এবং দৌড়ানো উত্তম।‌ তবে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকলে সেক্ষেত্রে বাসায় অথবা জিমে গিয়ে ট্রেডমিলে (Treadmill) দৌড়ানো যেতে পারে। 

প্রথমদিকে সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন দৈনিক ২০ থেকে ৩০ মিনিট সময় ধরে ব্যায়াম করতে হবে। আস্তে আস্তে ব্যায়ামের সময় বাড়াতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন শরীরে পানি স্বল্পতা না‌ হয় অর্থাৎ ব্যায়ামের পরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। 

ব্যায়াম ছাড়াও খাদ্য তালিকায় কিছু সুষম খাবার রাখতে হবে যা দেহে মেদ জমতে বাঁধা দেয়। এই খাবারগুলো হলো-

  • খাদ্য তালিকায় বেশি করে ফল ও শাকসবজি রাখতে হবে।
  • সাদা চালের পরিবর্তে লাল চাল আর ময়দার পরিবর্তে লাল আটা। 
  • চিনি খাবেন খুব কম, পারলে এড়িয়ে চলুন।
  • মিষ্টি ও কোমল পানীয় একদম এড়িয়ে চলুন। 
  • প্রক্রিয়াজাত করা খাবার ও ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন। 
  • প্রাকৃতিক খাবার ও ঘরে রান্না করা খাবার আহার করতে হবে। 
  • ঘি ও মাখনের মতো প্রাণিজ চর্বি না খাওয়াই ভালো। 
References

Gregory B. (2022, 16 dec) 19 Science-Backed Ways to Lose Belly Fat in Two Weeks, According to Weight Loss Experts. Retrieved from Prevention : https://www.prevention.com/weight-loss/a20458064/new-research-on-how-to-lose-belly-fat/
Spritzler F. (2023,8 Feb) 18 Effective Tips to Lose Belly Fat (Backed by Science) Retrieved from healthline :
https://www.healthline.com/nutrition/20-tips-to-lose-belly-fat

 

Last Updated on May 15, 2023