মা হওয়ার জন্য যেমন সার্বিক প্রস্তুতি নেয়ার প্রয়োজন হয়, তেমনি বাবা হওয়ার জন্যও শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি কেননা সন্তানের সুস্থতা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অনেকটাই নির্ভর করে বাবা হিসেবে আপনি কেমন তার উপর। এই অনুচ্ছেদে আমরা কথা বলবো বাবা হওয়ার জন্য ১৬ টি প্রস্তুতি টিপস নিয়ে যা আপনাকে একজন আদর্শ বাবা হতে সহায়তা করবে।

বাবা হওয়ার জন্য ১৬ টি প্রস্তুতি টিপস

১. নিজের স্বাস্থ্য ঠিক রাখুন

প্রথমত নিজের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা জরুরি কারণ বাবা হিসেবে আপনাকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে যার জন্য প্রয়োজন সুস্থতা। এছাড়াও কিছু কিছু রোগ রয়েছে বিশেষত যৌন রোগ (Sexually transmitted diseases) যেমন সিফিলিস, গনোরিয়া ইত্যাদি রোগের ক্ষতিকর প্রভাব বংশানুক্রমে বাবার শরীর থেকে সন্তানের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর তাই সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করার আগেই এই সমস্ত রোগ রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে জানা উচিত।

সাধারণত VDRL (venereal disease research laboratory), NAAT (Nucleic acid amplification testing) ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে সিফিলিস ও গনোরিয়ার উপস্থিতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়। পরীক্ষায় যদি পজিটিভ রেজাল্ট আসে অর্থাৎ আপনার শরীরে সিফিলিস বা গনোরিয়া রোগের সংক্রমণ পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী যথাযথ এন্টি বায়োটিক (antibiotics) ওষুধ সেবনের মাধ্যমে সুস্থ হওয়া সম্ভব। মনে রাখবেন এই রোগগুলোর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ হওয়ার পর বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে।

বাচ্চা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো শুক্রাণু (Sperm) যা সহবাসের মাধ্যমে নারীর শরীরে প্রবেশের পর ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়ে ভ্রূণ গঠন করে। সুস্থ ও সবল শুক্রাণু উৎপাদনের জন্য পুরুষের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে টেস্টোস্টেরন (Testosterone) হরমোনের উপস্থিতি আবশ্যক। সেই সাথে আরো প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা যা শুক্রাণুর গুনগত মান ভালো রাখতে সহায়তা করে।

শুক্রাণুর জন্য উপকারী খাবার গুলো হলো বাদাম, কলা, খেজুর, মধু, সবুজ শাক-সবজি, গাজর, টমেটো, ডিম, মাছ, মাংস,‌ দুধ, পনির ইত্যাদি। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে কারণ ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরে টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ বেড়ে যায়।

২. ধুমপানের অভ্যাস পরিত্যাগ করুন

ধুমপানের অভ্যাস পরিত্যাগ করুন

গবেষণায় দেখা গেছে যে ধুমপানের ফলে পুরুষের যৌন সক্ষমতা ও শুক্রাণুর গুনগত মান কমে যায়। (DeNoon, 2010)  আর তাই ধুমপান পরিত্যাগ করা জরুরি কেননা তা আপনার জন্য বাবা হওয়ার পথে বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে অনেক ধুমপায়ী ব্যক্তি রয়েছেন যারা ধূমপান করেন অথচ বাবা হতে সক্ষম হয়েছেন। এর কারণ হলো শুধুমাত্র একটি সুস্থ সবল শুক্রাণুই যথেষ্ট ভ্রূণ গঠনের জন্য তবে এক্ষেত্রে বিপত্তি ঘটে অন্য যায়গায়।

আর তা হলো পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে গর্ভস্থ সন্তানের নানাবিধ সমস্যা হতে দেখা যায়। অর্থাৎ আপনার ধুমপানের ক্ষতিকর প্রভাব আপনার গর্ভবতী স্ত্রীর মাধ্যমে গর্ভস্থ শিশুর শরীরের উপর পড়ে। এক্ষেত্রে শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করা, মৃত বাচ্চা প্রসব করা অথবা ত্রুটিপূর্ণ শিশু জন্ম গ্রহণ করতে পারে। আর তাই আপনার স্ত্রী গর্ভধারণের আগেই আপনাকে ধুমপানের অভ্যাস ছাড়তে হবে।

বাবার ধুমপানের প্রভাব শুধুমাত্র গর্ভস্থ শিশুর শরীরে প্রভাব ফেলে না বরং তা বাচ্চা প্রসব হওয়ার পর থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন: পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে শিশু বাচ্চাদের ফুসফুসের রোগ এবং সহজেই ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। আবার বড় হয়ে একটি শিশু যখন তার বাবাকে ধুমপান করতে দেখবে তখন শিশুর মনে ধুমপান করার ইচ্ছা জাগবে। কারণ শিশুরা অনুকরণপ্রিয় হয়ে থাকে আর তাই বাবা ধুমপান করলে সেক্ষেত্রে সন্তানেরও ধুমপায়ী হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি থাকে।

৩. পিতৃত্ব কালীন সময় নিয়ে কিছুটা গবেষণা করুন

পিতা হিসেবে কেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে,‌ গর্ভকালীন সময়ে স্ত্রীর কি কি সমস্যা হতে পারে এবং সেই সময়ে করণীয় বিষয়াবলী সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জনের জন্য কিছুটা গবেষণা করতে হবে। যেমন: গর্ভকালীন সময়ের শুরুতে স্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক অনেক পরিবর্তন দেখা যায় যা স্বাভাবিক বলে বিবেচিত। তবে এই সময়ে স্ত্রী মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে আর এমন পরিস্থিতি সম্পর্কে আগে থেকেই জানা থাকলে স্ত্রী কে সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব হবে।

গর্ভকালীন সময়ের কোন পর্যায়ে স্ত্রীর জন্য কি কি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি কখন করানো উচিত, প্রসবের জন্য সিজারিয়ান ডেলিভারি করানো লাগবে কিনা, সিজারিয়ান ডেলিভারির ভালো মন্দ সবকিছু সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য জার্নাল, বই, ইউটিউব চ্যানেল, গুগল, মাসিক পত্রিকা ইত্যাদির মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। তবে জ্ঞান অর্জনের উৎস হতে হবে অবশ্যই নির্ভরযোগ্য।

গর্ভকালীন সময়ের শুরুতে কি কি লক্ষণ দেখা যায় এবং কখন আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো উচিত তা জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন

৪. প্যারেন্টিং এর পরিকল্পনা নিয়ে সঙ্গিনীর সাথে আলোচনা করুন

প্রথমবারের মতো মা হওয়ার আগে যেমন একজন নারী নানাবিধ পরিকল্পনা ও চিন্তা ভাবনা করেন তেমনি ভাবে পুরুষের ক্ষেত্রেও কিছুটা পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। সবচেয়ে ভালো হয় স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে পরামর্শ ও পরিকল্পনা করা‌। শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় কখন বাচ্চা নিলে সবচেয়ে ভালো হবে সেই বিষয়ে দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। (McTigue, 2020) প্রয়োজনে স্বামী স্ত্রী দুজনে একসাথে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ (Gynecologist) চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করতে হবে।

আগেকার দিনে বাচ্চা নেওয়ার পূর্বে এভাবে পরিকল্পনার বিষয়টি তেমন দেখা যেতো না। কিন্তু বর্তমানে মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে পরিকল্পিত গর্ভধারণ বিষয়টি চালু হয়েছে। পরিকল্পিত গর্ভধারণের মাধ্যমে সঠিক সময়ে বাচ্চা নেওয়া সহ গর্ভবতী মা ও শিশুর যত্নের বিষয়টি নিশ্চিত করা সহজ হয়।

৫. অন্যান্য বাবাদের সাথে কথা বলুন

আপনার কলিগ বা বন্ধুদের মধ্যে যারা সন্তানের বাবা হয়েছেন তাদের সাথে কথা বলুন।‌ কারণ তাদের ব্যক্তিগত জীবনে বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে।‌ বাবা হওয়ার যাত্রায় কি কি ধাপ পার করতে হয় এবং কিভাবে জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায় সেই বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে আপনি জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে ভবিষ্যত বাবা হিসেবে পথ চলার আগাম ধারণা পেতে পারেন।

তারা কোন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে থেকে ভালো সেবা পেয়েছেন, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে ভালো এমন চিকিৎসকের চেম্বার বা হাসপাতালের ঠিকানা সহ গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য সংগ্রহ করে রাখুন। জরুরি ভিত্তিতে সিজারিয়ান ডেলিভারি করানোর জন্য পার্শবর্তী কোন হসপিটালে নেওয়া যেতে পারে সেই বিষয়ে খোঁজ রাখুন। স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে বন্ধু, কলিগ এবং পরিচিতদের মধ্যে যার রক্তের গ্রুপের সাথে মিলে যায় সেই ব্যক্তিকে আপনার প্রয়োজনের ব্যাপারে আগে থেকেই অবগত করে রাখতে পারেন।

৬. পরিবর্তিত যৌন জীবনের প্রস্তুতি নিন

বিয়ের পর থেকে যেভাবে যৌন জীবন পার করা হয় বাবা হওয়ার পথে তার কিছুটা পরিবর্তন হয়ে থাকে। আর একজন সচেতন পুরুষ হিসেবে এই পরিবর্তনের বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিতে হবে। গর্ভকালীন সময়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই তবে যেক্ষেত্রে স্ত্রীর ইচ্ছা অনুপস্থিত সেক্ষেত্রে বিরত থাকা উচিত। কারণ এই সময়ে গর্ভবতী নারীর শরীরে নানাধরনের পরিবর্তন হয়ে থাকে এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে। এছাড়াও যদি কোনো রোগ বা অস্বাভাবিকতার দরুন চিকিৎসক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন যে গর্ভকালীন সময়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না সেক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা জরুরি। সাধারণত নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে চিকিৎসক গর্ভকালীন সময়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকেন। যেমন:

  • গর্ভপাতের প্রবণতা
  • জরায়ু মুখের (Cervix) অতিরিক্ত প্রসারণ
  • গর্ভকালীন সময় শেষ হওয়ার আগেই বাচ্চা প্রসবের ইতিহাস
  • অস্বাভাবিক রক্তপাত হওয়া
  • Placenta previa
  • জমজ বাচ্চা ইত্যাদি

কোনো সমস্যা না‌ থাকলে স্ত্রীর সম্মতিক্রমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেনো স্ত্রীর পেটের উপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। এছাড়াও বাচ্চা প্রসবের পরবর্তী ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত যৌন মিলন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অতঃপর স্ত্রীর শরীর সুস্থ ও স্বাভাবিক বলে মনে হলে তখন যৌন মিলন করা যাবে।

৭. দায়িত্ব ভাগ করে নিন

দায়িত্ব ভাগ করে নিন

সন্তান জন্ম গ্রহণের পর একটি সংসারে অনেক কাজ বেড়ে যায় যা একজন মায়ের পক্ষে একা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। আর তাই নিজের সাধ্যমতো সংসারের কাজ এবং বাচ্চার দেখাশোনা করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিজের কাজে আপনার নব সন্তানের মাকে ডাকার অভ্যাস কমানো। যেমন: নিজে নিজে চা বানিয়ে খাওয়া, অফিসে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়া ইত্যাদি। এতে করে বাচ্চার মা যথেষ্ট সময় পাবে বাচ্চার যত্ন নেওয়ার।

সেই সাথে বাচ্চার মায়ের পাশাপাশি আপনিও সন্তানের যত্ন নিতে পারেন। যেমন: ডায়াপার পরিবর্তন করে দেওয়া।‌ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অনেক সময় বাচ্চার মায়ের কাজে ব্যস্ততার কারণে ডায়াপার পরিবর্তনে দেরি হতে পারে। আর এতে করে বাচ্চা যেমন অস্বস্তি বোধ করে তেমনি ভাবে তা ফাংগাল ইনফেকশনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।‌ আর তাই কিছুক্ষণ পর পর বাচ্চার ডায়াপার চেক করে দেখতে হবে যে তা ভিজে গেছে কিনা। ভিজে যাওয়া ডায়াপার অতিসত্বর পরিবর্তন করে দিতে হবে। সম্ভব হলে দিনের কিছুটা সময় ডায়াপার ছাড়া রাখুন।

এছাড়াও বাচ্চার বিভিন্ন কাজ যেমন গোসল করিয়ে দেওয়া, খাওয়ার সময় সহযোগিতা করা, সকাল সন্ধ্যায় সাথে নিয়ে পড়তে বসা, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কাজ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এতে করে যেমন বাচ্চার মা কিছুটা সময় বিশ্রাম করার সুযোগ পাবে তেমনি ভাবে শিশুর সাথে বাবার আন্তরিকতা বৃদ্ধি হওয়ার সুযোগ হবে।

৮. সময় ভাগ করে ঘুমানোর অভ্যাস করুন

অধিকাংশ মানুষ রাতের বেলায় বাচ্চা ও মায়ের দিকে খেয়াল না দিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকেন।‌ এমন অবিবেচকের মতো না হয়ে বরং আপনার স্ত্রী ও বাচ্চা ঘুমাতে পারছে কিনা সেই খোঁজ রাখুন। বাচ্চার মা রাতের বেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে না পারলে দিনের বেলায় ক্লান্তি বোধ করবে যা সন্তানের যত্ন নেওয়ার পথে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। আর তাই সবচেয়ে ভালো হয় রাতের কিছু সময় যদি আপনি নিজে জেগে থেকে সন্তানের দিকে খেয়াল রাখতে পারেন আর সেই সময় টুকু বাচ্চার মা আরামে ঘুমাবে।

তবে রাতের বেলায় দুজনেই একসাথে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়া উচিত নয় কারণ এতে করে সন্তান কোন অসুবিধায় কষ্ট পেতে পারে। আবার দুজনে একসাথে জেগে থাকা বা শুধু মা জেগে থাকা উচিত হবে না। পর্যায়ক্রমে ঘুমানোর মাধ্যমে মা বাবা দুজনেই যেনো ৬ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমতে পারে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে মায়ের জন্য দিনের বেলায় কিছুটা সময় যেনো ঘুমাতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. কেমন বাবা হতে চান তার একটা সিদ্ধান্ত নিন

কে না চায় তার বাচ্চার কাছে একজন আদর্শ বাবা হতে? সবাই চাইবে আর এই চাওয়ার সাথে সাথে তার জন্য প্রয়োজন আদর্শ বাবা হওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা। যেমন: নিজের ব্যক্তিগত জীবন এবং কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে স্ত্রী ও সন্তানদের সময় দিতে হবে। আপনি আপনার সন্তানের জন্য যথেষ্ট সময় না দিলে সন্তান আপনার দিকে মনোযোগী হবে না। বিষয়টি কোনো বাবার কাছেই ভালো লাগার মতো হবে না। সব বাবা‌ চাইবে যেন তার সন্তানের সাথে সুসম্পর্ক থাকে। এমনটি আপনিও চাইলে তার জন্য সময় দিতে হবে এবং সন্তানের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা থাকতে হবে।

বাবা হিসেবে আচরণ, চরিত্র, চলাফেরা সবকিছু এমন হতে হবে যেনো সন্তান তার বাবাকে অনুসরণ করার মাধ্যমে একজন ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে। এই জন্যে প্রথমত বাবা হিসেবে সৎ, নিষ্ঠাবান, ধার্মিক এবং অন্যান্য নৈতিক গুণের অধিকারী হতে হবে। সেই সাথে সন্তানকে বোঝাতে হবে কোনটি ভালো এবং কোনটি মন্দ যা এড়িয়ে চলতে হবে ইত্যাদি।

১০. আপনার বাচ্চার কাছে আপনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে শিখুন

অনেক সময় মায়ের সাথে সন্তানের বেশি সখ্যতা দেখার পর বাবার মনে হতে পারে যে সন্তানের সাথে তার ভালো সম্পর্ক নেই অথবা সংসারে তার গুরুত্ব অনেক কম। এমনটি ভেবে হীনমন্যতায় ভোগার কিছু নেই কারণ ছোট বেলার বেশির ভাগ সময় একটি শিশুর কাটে তার মায়ের সাথে আর তাই বেশি সখ্যতা গড়ে ওঠে মায়ের সাথেই। তবে বাচ্চার কাছে আপনিও একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠতে চাইলে বাচ্চাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। বাচ্চার চাহিদা বুঝতে হবে এবং চাহিদা পূরণ করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। সর্বোপরি সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে সন্তানের কাছে আদর্শ বাবা হওয়া সম্ভব। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশুরা মায়ের পাশাপাশি বাবার প্রতিও আন্তরিক এবং শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠে।

১১. বাচ্চার ভালোর জন্য দ্রুত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখুন

সন্তানের ভালো মন্দ সবকিছুতে সবার আগে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে বাবার। কারণ অধিকাংশ পরিবারেই সন্তানের মুল গার্ডিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয় বাবাকে। আর দায়িত্ব পালন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়লে কোথায় চিকিৎসা নিতে হবে, কোন চিকিৎসক ভালো হবে, কে সাথে নিয়ে যাবে ইত্যাদি বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারতে হবে।

অনেকেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না আবার অনেকেই হয়তো সিদ্ধান্ত গ্রহের বেলায় সংশয় বা হীনমন্যতায় ভোগেন। এমন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজন মানসিক দক্ষতা যা বাবা হওয়ার আগে থেকেই পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্জন করা যায়।

শিশু বড় হওয়ার পর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয় পড়ালেখা করানোর ব্যাপারে। সন্তান কোন বিষয়ে পড়াশোনা করলে ভালো হবে, কোন স্কুলের পড়ালেখার মান ভালো, কোনটাতে খরচ কেমন ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে যথাসময়ে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে।

১২. সহানুভূতিশীল হতে শিখুন

সহানুভূতিশীল হতে শিখুন

আপনি যদি আগে থেকেই অনেক সহানুভূতিশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে থাকেন তবে তো খুবই ভালো। আর যদি তা না হয়ে থাকেন তবে বাবা হওয়ার এই যাত্রায় আপনার ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন করে হতে হবে একজন সহানুভূতিশীল মানুষ। তবেই আপনি আপনার সন্তানের মা ও সন্তানের অভাব, দুঃখ, কষ্ট ইত্যাদি বুঝতে সক্ষম হবেন।

কিভাবে সহানুভূতিশীল ব্যক্তি হতে পারেন? এর জন্য শুরুতেই নিজের মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। অন্যের দিকে মনোযোগ দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। নিজেকে অন্যের কষ্টকর পরিস্থিতিতে কল্পনা করার মাধ্যমে অনেকটাই সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে পারেন আপনি।

১৩. বাচ্চাদের সাথে মিশুন

নিজের বাচ্চা হোক অথবা পরিবারের অন্য সদস্যদের বাচ্চা যে কোনো বাচ্চার সাথে সহজেই মেশা, গল্প করা, কথা বলা ইত্যাদির অভ্যাস গড়ে তুলুন। ছোট বাচ্চাদের সাথে আন্তরিক ভাবে মিশতে পারলে বাচ্চারাও বড়দের দেখে ভয় না পেয়ে বরং সাচ্ছন্দে মিশতে থাকবে। আর এতে করে যেমন সম্পর্ক ভালো হয় তেমনি ভাবে বাচ্চারা গল্প এবং খেলার ছলে অনেক কিছু শিখতে পারে।

শিশুদের সাথে মেশার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেনো কখনো মিথ্যে গল্প বা ভয়ের গল্প শোনানো না হয় যা অনেক বাবা-মাই করে থাকেন। বরং মানবিক গুণাবলীর বিকাশ হয় এমন গল্প শোনাতে হবে। মনে রাখবেন, ছোট বেলায় বাচ্চাদেরকে যেমন শিক্ষা দেওয়া হবে বড় হয়ে বাচ্চাটি তেমন চরিত্র নিয়েই বেড়ে উঠবে। ছোটদের জন্য নির্বাচিত অনেক গল্প রয়েছে যেগুলো থেকে শিশুরা একাধারে মজা এবং নানাবিধ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে। এছাড়াও শিশুদের আঁকাআঁকি করতে দেওয়া, গণণা শেখানো, নিজের কাজ নিজে নিজে করতে উৎসাহিত করার মাধ্যমে জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো যায়।

১৪. প্যারেন্টিং ক্লাসে যোগ দিন

আমাদের দেশে প্যারেন্টিং বিষয়ে তেমন কোনো শিক্ষা বা ক্লাসের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। তবে অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে প্যারেন্টিং বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। আর এইসব পদ্ধতিতে শিক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে নিজেকে আদর্শ বাবা হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ পাওয়া যায়। এই সমস্ত ক্লাসের মাধ্যমে আপনি যা শিখতে পারবেন তা হলো:

  • কিভাবে শিশুদের সাথে আন্তরিক ভাবে মেশা যায়
  • শিশুর আচরণ বুঝতে পারা
  • বাচ্চাকে কিভাবে পড়ালেখার অভ্যাস গড়ে তোলা যায়
  • সন্তানের সাথে খেলাধুলা করার উপায়
  • সন্তানের রাগ, জেদ ও আবেগের মুহূর্তে করণীয় বিষয়াবলী
  • সন্তানের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেওয়া ইত্যাদি

১৫. প্যারেন্টিং নিয়ে টিম ওয়ার্ক শুরু করুন

প্যারেন্টিং বিষয়ক টিম ওয়ার্কের ধারণাটি অনেকের কাছেই একদম নতুন মনে হতে পারে। মূলত বিষয়টি হলো বাবা  মা মিলিত ভাবে সন্তানের সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বা সন্তানের জন্য কাজ করা। অনেক সময় সন্তানের কোনো একটি বিষয় নিয়ে মা বাবার মতপার্থক্য হতে পারে।‌ এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। নিজের চিন্তা বা মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য একঘেয়েমি করা যাবে না। মোটকথা টিম ওয়ার্কের সময় যেমন টিম মেম্বারদের মধ্যে মতবিনিময়ের মাধ্যমে একটা কাজ সবচেয়ে ভালো ভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় তেমনি ভাবে বাবা মা মিলিত হয়ে টিম ওয়ার্কের মতো করে সন্তানের সব ভালো মন্দের দেখভাল করতে হবে।

১৬. বাবা হওয়ার প্রস্তুতি কেমন নিচ্ছেন তা ট্রেস করুন

বাবা হওয়ার জন্য যেসব প্রস্তুতি টিপসগুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যকার কতগুলো টিপস আপনি মানতে পারছেন তা চিহ্নিত করুন। যে কোনো বিষয়ে জানার পর সেটা বাস্তবায়ন করা কঠিন আর আপনি এই কঠিন ধাপ কতটুকু অতিক্রম করতে সক্ষম হলেন তা ট্রেস করা বা খোঁজ করা প্রয়োজন। খাতা বা মোবাইলে নোট করুন যে আপনি ইতিমধ্যেই কোন কোন অভ্যাসগুলো অর্জন করে ফেলেছেন।‌

সেই সাথে কোন অভ্যাসগুলো এখনো অর্জন করতে পারেননি তা চিহ্নিত করুন এবং কারণ খুঁজে বের করতে চেষ্টা করুন যে কেন এইসব গুণাবলী অর্জন করতে সক্ষম হননি। অতঃপর কারণ দূরীকরণের মাধ্যমে আদর্শ বাবা হয়ে উঠার পথে সফলভাবে পাড়ি জমান। আপনি আদর্শ বাবা হওয়ার জন্য প্রস্তুতি পথে কতটা অগ্রসর হতে চলেছেন তা নির্ণয় করতে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর মনে করুন।

  • যৌন রোগ আছে কিনা তা পরীক্ষা করেছেন?
  • ধুমপান ছেড়ে দিবেন বলে মনস্থির করেছেন?
  • গর্ভকালীন সময়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে সংযত থাকার প্রস্তুতি নিয়েছেন?
  • স্ত্রীর জন্য জরুরি মূহুর্তে রক্ত সরবরাহ করতে পারে এমন লোকের ব্যবস্থা করতে পারবেন?
  • আপনার বাসার পার্শবর্তী হাসপাতালে যোগাযোগের নাম্বার সংগ্রহ করেছেন?
  • বাচ্চা হওয়ার পর দায়িত্ব ভাগ করে নিবেন এবং স্ত্রীকে বিশ্রাম নেয়ার বা ঘুমানোর যথেষ্ট সুযোগ করে দিবেন?
  • মা এবং বাচ্চার কষ্ট বুঝতে পারার জন্য নিজের মনকে সহানুভূতিশীল বা যথেষ্ট পরিমাণে নরম করতে পারবেন তো?

 

References

DeNoon, D. J. (2010, September 10). Smokers’ Sperm Less Fertile. From WebMD: https://www.webmd.com/smoking-cessation/news/20100910/smokers-sperm-less-fertile

McTigue, S. (2020, March 26). Preparing for Fatherhood: 16 Ways to Get Ready to Become a Dad. From Healthline: https://www.healthline.com/health/preparing-for-fatherhood

Last Updated on April 13, 2023