ভিটামিন – সি যার রাসায়নিক নাম অ্যাসকরবিক এসিড (Ascorbic acid)। রাসায়নিক সংকেত C6H8O6 (Bangal, 2015)।এটি পানিতে- দ্রবণীয় একটি ভিটামিন যা বিভিন্ন ফল এবং শাকসবজিতে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। এটি শরীরে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxidant) হিসেবেও কাজ করে।
এছাড়াও এটি ত্বকের স্বাস্থ্য এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার জন্য সুপরিচিত। আমাদের শরীর ভিটামিন সি উৎপাদন এবং সঞ্চয় করে রাখতে পারে না। তাই Vitamin C এর উপকারিতা, এবং এটি কোন কোন খাবারে পাওয়া যায় ইত্যাদি প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরা হবে আজকের লেখার মাধ্যমে।
Table of Contents
ভিটামিন সি কি? (What is Vitamin C?)
ওয়াটার সলিউবল (Water soluble) একটি ভিটামিন, যা সহজেই পানির সাথে মিশে যেতে পারে এবং তাপে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তাই ভিটামিন সি রান্না করা ফলমুল বা সবজি থেকে কাঁচা ফলমুল বা সবজিতে বেশি পরিমাণ থাকে।
ভিটামিন সি কিসে পাওয়া যায়?
আমাদের দেহে প্রতিদিন ৯০ মিগ্রা করে ভিটামিন সি দরকার (Hill, 2018)। আর এই চাহিদা পূরন করতে প্রতিদিন সঠিক পরিমাণে Vitamin C জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। তাহলে চলুন জানি কোন কোন খাবারে বেশি পরিমাণে এই ভিটামিন পাওয়া যায়-
১।কমলা: একটি মাঝারি আকারের কমলাতে ৭০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি থাকে।
২।স্ট্রবেরি: এক কাপ স্ট্রবেরিতে ৮৯ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি থাকে। এছাড়াও স্ট্রবেরিতে থাকে ম্যাঙ্গানিজ (Manganese), ফ্ল্যাভোনয়েডস (Flavonoids), ফোলেট (Folate) এবং অন্যান্য উপকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের বিচিত্র এবং শক্তিশালী মিশ্রণ । গবেষণায় দেখা যায় যে স্ট্রবেরিতে বেশি পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxidant) থাকায় এটি ক্যান্সার, ভাস্কুলার ডিজিজ (vascular disease) এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে।
৩। লেবু: সবচেয়ে সহজলভ্য ভিটামিন সি ভরপুর খাবার হল লেবু। খোসা সহ একটি কাঁচা লেবুতে ৮৩ মিগ্রা থাকে এই ভিটামিন । ১৭০০ সালের দিকে স্কার্ভি প্রতিরোধে নাবিকদের প্রচুর পরিমাণে লেবু খাওয়ানো হত । কেননা লেবুর রসে থাকা Vitamin C অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবেও কাজ করে।
৪। লিচু: একটি লিচুতে এই ভিটামিন প্রায় ৭ মিগ্রা থাকে। লিচুতে ওমেগা -৩ এবং ওমেগা -৬ ফ্যাটি অ্যাসিডও (Omega-3 and Omega-6) রয়েছে যা কিনা আপনার মস্তিষ্ক, হার্ট এবং রক্তনালী সুস্থ রাখে । ১৯৬০০০ জন মানুষের উপর একটি গবেষণা করে দেখা গেছে যে যারা নিয়মিত ভিটামিন সি জাতীয় খাবার গ্রহন করে, তাদের স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি ৪৩% কম থাকে।
৫। পেঁপে: এক কাপ (১৪৫ গ্রাম) পেঁপেতে ৮৭ মিগ্রা ভিটামিন সি থাকে। এর উপাদান মস্তিষ্কে স্মৃতি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়।
৬। পেয়ারা: একটি মাঝারি আকারের পেয়ারাতে ১২৬ মিগ্রা ভিটামিন সি থাকে। ছয় সপ্তাহের একটি সমীক্ষায় দেখা যায় প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম পেয়ারা খেলে রক্তচাপ এবং মোট কোলেস্টেরল মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।
৭। আনারস: আনারসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ এবং সি থাকে। দাঁত ও মাড়ির যত্নে আনারস খুবই উপকারী। প্রতি ১০০ গ্রাম আনারসে এর পরিমাণ ৪৭ মিগ্রা।
৮। কাঁচা মরিচ: কাঁচামরিচে এই ভিটামিন প্রচুর পরিমাণে থাকে। একটি কাঁচা মরিচে ১০৯ মিগ্রা পর্যন্ত ভিটামিন সি থাকে।
৯। সরিষা শাক: এক কাপ কাঁচা সরিষা শাকে ১৯৫ মিগ্রা এবং রান্না করা সরিষা শাকে ১১৭ মিগ্রা ভিটামিন সি থাকে। (Hill, 2018)। এছাড়াও থাকে ভিটামিন এ, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফাইবার এবং ফোলেট।
১০। পাতা কপি: এক কাপ পাতা কপিতে ৮০ মিগ্রা থাকে এই ভিটামিন। সেই সাথে থাকে ভিটামিন কে (Vit-K) এবং ক্যারোটিনয়েডস লুটিন (carotenoids lutein) ।
ভিটামিন সি এর উপকারিতা (বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত)
Vitamin C এর উপকারিতা বলে শেষ করার মত না। অধিকাংশ খাদ্যেই এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এর কিছু গুরুত্বপূর্ন উপকারি দিক নিচে তুলে ধরা হল –
১। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় (Raman, 2020)
ভিটামিন সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আপনার দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর অনুগুলো ফ্রি র্যাডিকেল (Free Radical) নামক ক্ষতিকারক অণু থেকে দেহের কোষকে রক্ষা করে। এই ভিটামিন বেশি পরিমাণে খেলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর পরিমান ৩০% পর্যন্ত বেড়ে যায় এবং রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও এটি শ্বেত রক্তকণিকার উপাদান লিম্ফোসাইট (Lymphocyte) এবং ফ্যাগোসাইট (Phagocyte) এর উৎপাদন বাড়ায়। এটি এই রক্তকণিকাকে আরও কার্যকরী করতে সহায়তা করে । আর এই শ্বেত রক্তকণিকাই হল দেহের মূল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
ভিটামিন সি বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফ্রি রেডিক্যাল ইত্যাদির বিরুদ্ধে লিম্ফোসাইট (Lymphocyte) এবং ফ্যাগোসাইটকে (Phagocyte) কাজ করতে সাহায্য করে।
২। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে
উচ্চ রক্তচাপ আপনাকে হৃদরোগের ঝুঁকিতে ফেলে, যা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। ভিটামিন সি উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করে। ২৯ টি মানব গবেষণার বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে এটি গ্রহণের ফলে সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার (সাধারনভাবে আমরা যেটাকে ১২০ হিসেবে জানি, উচ্চ রক্তচাপে এই মান আরো বেশি থাকে) ৩.৮ মি.মি. মার্কারি (mmHg) এবং ডায়াস্টলিক ব্লাড প্রেশার (সাধারনভাবে আমরা যেটাকে ৮০ হিসেবে জানি, উচ্চ রক্তচাপে এই মান আরো বেশি থাকে) ১.৫ মি.মি. মার্কারি (mmHg) কমে যায়। (Raman, 2020) এছাড়া রক্তনালির দেয়ালগুলোকে চাপ মুক্ত করে।
৩। হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
হৃদরোগ বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। কিছু কিছু ফ্যাক্টর আছে যা হৃদ রোগের ঝুঁকি বাড়ায় এবং কমায় যেমন LDL, HDL কোলেস্টেরল।
এলডিএল (LDL) কোলেস্টেরলকে প্রায়শই ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল বলা হয় কারণ এটি হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো স্বাস্থ্য সমস্যার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। অপরদিকে এইচডিএল (HDL) বা ‘ভাল’ কোলেস্টেরল যা হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে।
ভিটামিন সি এই ফ্যাক্টরগুলোকে সহনীয় মাত্রায় রাখে। এটি সেরাম কোলেস্টেরলের (Serum Cholesterol) মাত্রা ঠিক রেখে করোনারি হার্ট ডিজিজ (coronary heart disease) কমায়।
একটি গবেষণায় দেখা যায় যারা দৈনিক কমপক্ষে ৭০০ মিগ্রা ভিটামিন সি গ্রহন করে তাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ২০% কম। আরেকটি গবেষণার প্রকাশিত ফল আনুযায়ী প্রতিদিন ৫০০ মিগ্রা এই ভিটামিন গ্রহণ করলে ব্লাড কোলেস্টেরল (Blood Cholesterol) এবং ট্রাইগ্লিসারাইড (Triglycerude) এর মাত্রা কমে।
৪। রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা কমায়
অতিরিক্ত ইউরিক এসিডের (Uric acid) ফলে হাড়ের জোড়ায় জোড়ায় ব্যাথা করে। ভিটামিন সি ইউরিক এসিডের মাত্রা ঠিক রাখে। একটি গবেষণায় দেখা যায় যারা নিয়মিত এটি গ্রহন করে তাদের রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে।
রক্তে খুব বেশি ইউরিক অ্যাসিড থাকলে গাউটের (Gout) লক্ষণগুলি দেখা দেয়। গাউট এমন এক ধরণের রোগ যার ফলে আক্রান্ত রোগীর জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যাথা হয়। ইউরিক অ্যাসিড মানব দেহে উৎপাদিত একটি বর্জ্য পদার্থ। যা উচ্চমাত্রায় থাকলে কিডনিতে পাথর জমতে পারে।
১৩৮৭ জন মানুষের উপর একটি পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, যারা পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন সি গ্রহন করে তাদের রক্তে কম মাত্রার ইউরিক এসিড থাকে, তাদের চেয়ে যারা কম পরিমাণে Vitamin C গ্রহন করে।
৫। আয়রনের ঘাটতি রোধে ভিটামিন সি
আয়রন একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান যা দেহে বিভিন্ন ধরণের ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহন করে। এটি রক্তের রক্তকণিকা তৈরি এবং সারা শরীর জুড়ে অক্সিজেন পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয়। ভিটামিন সি, পরিপূরক খাদ্য থেকে আয়রনের শোষণকে বাড়ায়। ফলস্বরূপ, শরীরে আয়রনের ঘাটতি কমে।
১০০ মিগ্রা Vitamin C গ্রহন করলে তা শরীরে আয়রন শোষণের হারকে ৬৭% বৃদ্ধি করে। (Raman, 2020)
৬। ক্যান্সার প্রতিরোধ করে
উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি মূত্রথলী, যকৃৎ, মলাশয় এবং অন্যান্য ক্যান্সার কোষগুলিকে বৃদ্ধি হতে দেয় না। সার্জারী উপযোগী নয় এমন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রোগীর দেহে শিরা দিয়ে এক ধরনের ভিটামিন সি প্রবেশ করানো হয়। যার ফলে কোন প্বার্শপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই টিউমার ছোট হয়ে যায়।
৭। দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখে
ভিটামিন সি দাঁত ও মাড়িকে সুস্থ রাখে। মাড়ি থেকে অকারণে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে এবং দাঁতের সাথে মাড়ির সংযোগ মজবুত করে।
৮। ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে
এই ভিটামিন রক্তে সুগারের মাত্রা ঠিক রাখে। প্রতিদিন ১০০০ মিগ্রা সাপ্লিমেন্টারি ভিটামিন সি গ্রহন করলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে থাকে। জাপানের একটি গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন সি ইনসুলিন এর ক্ষরণকে ত্বরান্বিত করে। তাই টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি অনেক ভাল উপকারী।
১০। এলার্জি দূর করে
হিস্টামিন (মানব শরীরে উৎপন্ন একধরণের হরমোন) নিঃসরণ এর কারণে এলার্জি হয়। ভিটামিন সি এই হরমোন নিঃসরন কমিয়ে এলার্জি নিয়ন্ত্রণ করে।
ভিটামিন সি এর উপকারিতা (যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়)
১. সাধারণ সর্দি-কাশি দূর করে
ভিটামিন সি সর্দি-কাশি প্রতিরোধ করতে পারেনা, তবে এর তীব্রতা কমিয়ে দিতে পারে। এটি বয়ষ্কদের সর্দি-কাশির তীব্রতা ৮% এবং বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ১৪% কমিয়ে দেয়।
২. ক্যান্সারের প্রবণতা কমায়
কিছু কিছু গবেষণায় দেখা যায়, ভিটামিন সি ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, কিন্তু বেশিরভাগ গবেষণাই এটাকে সমর্থন করে না।
৩. চোখের সমস্যা দূর করে
অনেকেই মনে করে থাকেন ভিটামিন সি চোখের ছানি রোগের ভাল ওষুধ। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা বলে চোখের সমস্যা দূর করতে ভিটামিন সি এর কোন ভূমিকা নেই বরং ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট চোখের ক্ষতি করতে পারে।
৪. ক্ষতিকারক সীসার (Lead) পরিমাণ কমায়
ভিটামিন সি শরীরে বিদ্যমান ক্ষতিকারক সীসার পরিমাণ কমায়। তবে এটি সীসার ক্ষতিকারক প্রভাব কমাতে পারে এমন কোন প্রমান নেই।
প্রতিদিন কি পরিমাণ ভিটামিন সি গ্রহন করা উচিত?
একজন সুস্থ মানুষের প্রতিদিন গড়ে ৯০ মিগ্রা করে ভিটামিন সি খাওয়া উচিত। তবে বয়স এবং লিঙ্গ ভেদে এর পার্থক্য আছে।
বয়স | পরিমাণ (প্রতিদিন) |
বাচ্চা (১-৩ বছর) | ১৫ মিগ্রা |
বাচ্চা (৪-৮ বছর) | ২৫ মিগ্রা |
বাচ্চা (৯-১৩ বছর) | ৪৫ মিগ্রা |
মেয়ে (১৪-১৮ বছর) | ৬৫ মিগ্রা |
ছেলে (১৪-১৮) | ৭৫ মিগ্রা |
মহিলা (১৮ বছরের বেশি) | ৭৫ মিগ্রা |
পুরুষ (১৮ বছরের বেশি) | ৯০ মিগ্রা |
মহিলা (গর্ভকালীন সময়) | ৮৫ মিগ্রা |
মহিলা (বাচ্চা বুকের দুধ খায়) | ১২০ মিগ্রা |
ভিটামিন সি এর ঘাটতির লক্ষণ
- পেশী ব্যথা বা দুর্বলতা
- ক্লান্তি
- জ্বর
- ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা
- মাড়ি থেকে রক্তপাত বা ফোলা
- মুখে ঘা
- সারা শরীরে লাল লাল ফুসকুড়ি উঠা
ভিটামিন সি ঘাটতি হলে কি কি সমস্যা হতে পারে?
- রুক্ষ ত্বক
- মাড়ি ফুলে যায় এবং রক্তক্ষরণ হয়
- ক্ষতস্থান সহজে শুকাতে চায় না
- হাড়ের সংযোগ স্থান ফুলে যায়, ব্যাথা করে
- হাড় দুর্বল হয়ে যায়
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়
- যাদের শরীরে ভিটামিন-সি-এর অভাব রয়েছে, তারা খুব সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। শরীরে শক্তি কমে যায়, অবসন্ন হয়ে পড়েন। অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পায়।
- নাক দিয়ে রক্ত পরে
- বিরক্তিভাব দেখা দেয়। মেজাজ খিটখিটে থাকে।
অতিরিক্ত ভিটামিন সি খেলে কি কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে?
ভিটামিন সি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান, যা ফল এবং সবজিতে প্রচুর পরিমাণে থাকে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, ক্ষত নিরাময়ে, হাড়কে শক্তিশালী রাখতে এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এর উপকারিতা বেশি পাওয়ার আশায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভিটামিন খেতে হবে এমন কোন কথা নেই। মজার বিষয় হচ্ছে অনেকেই দাবি করেন যে, প্রাকৃতিক Vitamin C থেকে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট বেশ কার্যকরী। সাধারণ সর্দি-কাশি নিরাময়ের জন্য অনেকেই এই সাপ্লিমেন্ট নিয়ে থাকেন। তবে এসব সাপ্লিমেন্ট ব্যাবহারের ফলে নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হতে পারে।
যেমন-
– হজমে সমস্যা করে
সবচেয়ে পরিচিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল হজমে সমস্যা। ভিটামিন সি জাতীয় খাবার এর তুলনায় সাপ্লিমেন্ট গ্রহনের কারনে এই সমস্যা বেশি হয়। দিনে ২০০০ মিগ্রা এর বেশি এই ভিটামিন গ্রহন করলে হজমে সমস্যার শুরু হয় (Elliott, 2019)। প্রথমেই যেই সমস্যাগুলো বেশি হয় তা হল ডায়রিয়া এবং বমি। যদি আপনি এই ভিটামিন অত্যধিক গ্রহণের ফলে হজমজনিত সমস্যায় পড়ে থাকেন তবে আপনার Vitamin C সাপ্লিমেন্ট গ্রহন বন্ধ করে দিন, পরিবর্তন আপনি নিজেই দেখতে পাবেন।
– আয়রনের উপর ভিটামিন সি এর প্রভাব
আমরা জানি যে Vitamin C আয়রনের শোষণ বৃদ্ধি করে। উদ্ভিদ/সবজি থেকে আমরা যে আয়রন নিয়ে থাকি তাকে নন-হিম আয়রন বলে। অপরদিকে প্রানীর যে আয়রন আমরা গ্রহন করে থাকি তাকে বলে হিম আয়রন। নন-হিম আয়রনকে শরীর হিম আয়রনের তুলনায় কম পরিমাণে শোষণ করে। আর Vitamin C নন-হিম আয়রনের (non-heme iron) সাথে যুক্ত হয়ে এর শোষণকে সহজ করে দেয়। একটি গবেষণায় দেখা যায়, যারা প্রতিদিন ১০০ মিগ্রা Vitamin C গ্রহন করে তাদের আয়রনের শোষণ হার ৬৭% বেশি ।
কিন্তু যখন আপনি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণ এই ভিটামিন গ্রহন করবেন, তখন আয়রনের শোষণও অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাবে, এই পরিস্থিতিকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় আয়রণ ওভারলোড (Iron overload) । আর এই আয়রন ওভারলোডে লিভার ও কিডনির ক্ষতি করে।
– অতিরিক্ত ভিটামিন সি গ্রহনের ফলে কিডনিতে পাথর হয়
শরীরের শোষণের পরেও যে অরিরিক্ত ভিটামিন সি থেকে যায়, তা শরীর থেকে অক্সালেট (Oxalate) হিসাবে বের হয়ে যায়। অক্সালেট সাধারণত প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়। তবে, কিছু পরিস্থিতিতে অক্সালেট শরীরে থেকে বিভিন্ন খনিজ উপাদানের সাথে যুক্ত হয়ে কিডনিতে পাথর তৈরী করে।
বেশি পরিমাণে Vitamin C গ্রহণের ফলে আপনার প্রস্রাবে অক্সালেটের পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে, ফলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে। একটি গবেষণায় দেখা যায় যারা প্রতিদিন ২০০০ মিগ্রা এর চেয়ে বেশি Vitamin C গ্রহন করে, তাদের অক্সালেট উৎপাদন ২০% বৃদ্ধি পায়, (Elliott, 2019) যার ফলে কিডনি ফেইলিউর এর সম্ভাবনা থাকে।
ভিটামিন সি সিরাম কি?
এটি হল Vitamin C দ্বারা তৈরী একধরনের প্রসাধনী সামগ্রী। এটি তরল বা জেল রূপে পাওয়া যায়। এটি বাজারের অন্যতম সেরা এন্টি-এজিং (Anti-aging) উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয় – এবং এটি মসৃণ ও উজ্জ্বল ত্বকের চাবিকাঠি।
ভিটামিন সি সিরাম এর উপকারিতা
- এটি নিয়মিত ব্যবহারের ফলে বয়সের ছাপ পরে না বা শরীরের চামড়া কুচকিয়ে যায় না।
- কোলাজেন (Collagen) উৎপাদন বাড়ায়।
- ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করে
- সূর্যের ক্ষতির হাত থেকে ত্বককে রক্ষা করতে সহায়তা করে
- হাইপারপিগমেন্টেশন (Hyperpigmentation) হ্রাস করে। মানে ত্বকের কিছু অংশ, আশেপাশের অংশ থেকে কালো হয়ে যাওয়া।
- ত্বক উজ্জ্বল করতে এবং ভালো রাখতে সহায়তা করে।
- ত্বক ও বাইরের পরিবেশের সাথে বেষ্টনি হিসেবে কাজ করে।
ভিটামিন সি সিরামের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
জ্বালা পোড়া হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকলেও ত্বকে প্রয়োগের আগে আপনার সর্বদা প্যাচ পরীক্ষা (Patch test) করা উচিত। ত্বকে প্রয়োগ করা বিভিন্ন পদার্থের কোনটিতে অ্যালার্জি রয়েছে কিনা তা বের করার জন্য এই প্যাচ পরীক্ষা করা হয়। আপনার ত্বক কীভাবে Vitamin C Serum প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা নির্ধারণ করার এটিই একমাত্র পরীক্ষা।
কীভাবে সি সিরাম ব্যবহার করবেন?
সি সিরাম যেহেতু আপনাকে ধুলাবালি, সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করে, তাই দিনের বেলা ব্যবহার করাই ভাল।
- প্রথমে ভাল করে আপনার মুখমণ্ডল এবং ত্বক ধুয়ে নিন
- ত্বকের যে অংশে প্রয়োজন সেসব অংশে ভাল করে প্রয়োগ করুন
- ২৪ ঘন্টা পর্যবেক্ষণ করুন
- যদি কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না ঘটে তাহলে, প্রতিদিন ১/২ বারএইভাবে ব্যবহার করব
সি সিরাম ব্যবহার করার কিছু নিয়ম আছে, যেমন থাম্ব রুলস। থাম্ব রুলস (Thumb Rules) নিয়ম অনুসারে প্রথমে ত্বক ভালমত পরিষ্কার করে নিতে হবে, এর পর টোনার (Toner) দিতে হবে, Vitamin C সিরাম প্রয়োগ করে তারপরে ময়শ্চারাইজ করতে হবে।
এটি অন্যান্য উপাদানের সাথে নিরাপদে ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন – নিয়াসিয়ামাইড। নিয়াসিয়ামাইড হল একধরনের ভিটামিন বি কমপ্লেক্স যা ভিটামিন বি ৩ এ পাওয়া যায়। যদিও নিয়াসিনামাইড (niacinamide) সি সিরামের পাশাপাশি ব্যবহার করলে এর কার্যক্ষমতা কমে যেতে পারে।
ব্যবহারের আগে যে বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে
গঠন
ভিটামিন সি সিরামের উপাদানগুলো বিভিন্ন নামে বাজারে দেখতে পাওয়া যায়। এর ভেতর থেকে আপনাকে এল-অ্যাস্করবিক এসিড (L-ascorbic acid) উপাদানটি খুঁজে বের করতে হবে, কারণ এটি সবচেয়ে ভালো কাজ করে।
ঘনত্ব
সর্বোচ্চ ১০-২০% ঘনত্বের সি সিরাম ব্যবহার উচিত। ভাল ফলাফলের জন্য অবশ্যই ৮% এর বেশি ব্যবহার করতে হয়। তবে ২০% বেশি ঘনত্বের সিরাম ব্যবহার করলে জ্বালাপোড়া করতে পারে।
উপাদান
উপাদান তালিকায় যথাক্রমে Vitamin C এবং E, বা এল-অ্যাসকরবিক অ্যাসিড এবং টোকোফেরল (tocopherol) উপাদানগুলো আছে কিনা দেখে নিন। এই উপাদানগুলো একত্রে বেশি কার্যকরী।
পেকেজিং
বায়ু, এবং তাপের সংস্পর্শ সিরামের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই কেনার আগে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে নিন প্যাকেটে কোন ছোট ছোট ছিদ্র আছে কিনা। কৌটার ক্ষেত্রে দেখে নিন ভাল করে কৌটার মুখ লাগানো আছে কিনা।
সি সিরাম সাধারণত হলুদ রঙের হয়ে থাকে। যদি এর রঙের পরিবর্তন হয়ে কমলা বা গাড় বাদামি হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে এটি মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
সবচেয়ে ভাল মানের ভিটামিন সি সিরাম
বিভিন্ন ফার্মেসি বা প্রসাধনী সামগ্রীর দোকানগুলোতে গেলেই দেখতে পারবেন শত শত ব্র্যান্ডের সি সিরাম পাওয়া যাচ্ছে। এতো এতো প্রোডাক্ট থেকে ভাল জিনিস খুঁজে বের করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এখানে কিছু নির্ভরযোগ্য সি সিরাম কোম্পানির নাম দেয়া হল-
- Paula’s Choice C-15 Super Booster
- Peter Thomas Roth Potent-C Power Serum
- Seoul Ceuticals Day Glow Serum
- Sunday Riley C.E.O> 15% Vitamin C Brightening Serum
- La Roche-Posay Vitamin C Face Serum
- Skinceuticals C E Ferulic Vitamin C Serum
ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্ট এর সাথে অন্যান্য ওষুধের বিক্রিয়া
কিছু ওষুধ আছে যেগুলোর সাথে Vitamin C সাপ্লিমেন্ট নেয়া উচিত নয়, নিলে সেসব ওষুধের সাথে বিক্রিয়া করে এর কার্যকরী ক্ষমতা কমিয়ে বা অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে। যেসব ওষুধের সাথে Vitamin C সাপ্লিমেন্ট বিক্রিয়া করে-
- বারবিচুরেট (Barbiturates)
- অ্যাসপিরিন (Aspirin)
- অ্যাসিটামিনোফেন (Acetaminophen)
- ওয়ারফেরিন (Warfarin)
- এন্টাসিড (Antacid)
- ফ্লুফেনাজাইন (Fluphenazine)
ভিটামিন সি ফ্লাশ কি?
Vitamin C অ্যাসকরবেট ক্লিঞ্জ (ascorbate cleanse) নামেও পরিচিত। এটা এক ধরনের সাপ্লিমেন্ট। এটি শরীরের থাকা বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদানগুলোকে বের করে দিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে।
সি ফ্লাশ এর উপকারিতা
- দেহকে সতেজ এবং শক্তিশালী করে তোলে
- শরীরে থাকা খনিজ পদার্থ শোষণে সহায়তা করে
- বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থেকে শরীরকে রক্ষা করে
- সংক্রমণ বন্ধে সাহায্য করে।
সি ফ্লাশ কখন ব্যবহার করা হয়?
পুষ্টিবিদদের মতে সি ফ্লাশ ব্যবহারের কারণ হল Vitamin C এর ঘাটতি পূরন এবং স্কার্ভি প্রতিরোধ করা।
সতর্কতা
যদিও Vitamin C ফ্লাশ করার কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ নেই তবে স্বাস্থ্যকর প্রাপ্তবয়স্কদের পক্ষে এটি করা নিরাপদ। Vitamin C ফ্লাশ করার আগে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের সাথে আগে কথা বলে নিন।
এবং নিম্নোক্ত বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন:
- Vitamin C ফ্লাশ চলাকালীন আপনি সব ধরনের খাবারই খেতে পারবেন।
- সি ফ্লাশ ঘরে বসে করবেন, যাতে প্রয়োজনে সহজেই বাথরুমে যেতে পারেন।
- ভিটামিন সি ফ্ল্যাশ নিলে যদি হজমে সমস্যা হয়, তাহলে ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম যুক্ত ফ্ল্যাশ নিন।
- বেশি বেশি পানি পান করুন
সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ঝুঁকি
ফ্লাশের সময় যে সমস্যাগুলো হতে পারে –
- পেট ফাঁপ দেয়া
- পেট ফুলে যাওয়া
- বুক জ্বালাপোড়া করা
ডাক্তারের তত্ত্বাবধান ছাড়া Vitamin C ফ্লাশ কখনই করা উচিত নয়। অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ এবং হঠাৎ বন্ধ হওয়া মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক ডায়রিয়া এবং ডিহাড্রেশন হতে পারে। তাই শিশু, গর্ভবতী মহিলা এবং ৬৫ বছর বয়সের বেশি প্রাপ্তবয়স্কদের কখনও Vitamin C ফ্লাশ চেষ্টা করা উচিত নয়।
যে সমস্যাগুলো থাকলে ফ্ল্যাশ করা উচিত নয়
- হিমোক্রোমাটোসিস (Hemochromatosis)
- গিলবার্ট রোগ (Gilbert Diease)
- প্রদাহজনক পেটের সমস্যা
- হেপাটাইটিস (Hepatitis)
- কিডনি সমস্যা
Vitamin C আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় ভিটামিনগুলোর মধ্য অন্যতম। পুষ্টি ও গুনগত দিক দিয়ে এটি সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। সুস্থ সবল দেহের জন্য চাই নিয়মিত ভিটামিন সি জাতীয় খাবার। তাই এই ভিটামিন নিয়ে আপনাদের মধ্যে সচেতনা সৃষ্টি করতে Vitamin C যুক্ত খাবার, এর উপকারিতা সহ আরো নানা বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা দেয়ার চেষ্টা আমরা এই লেখার মাধ্যমে করেছি। এর পরেও যদি আপনাদের আরো কোন জিজ্ঞাসা বা জানার থাকে, তাহলে আমদের তা জানান। আমরা চেষ্টা করব একটি সুন্দর সমাধান দেয়ার।
Last Updated on November 21, 2023
Leave A Comment