খুশকি (Dandruff) অতি পরিচিত একটি সমস্যা। খুব কম মানুষই আছেন, যারা খুশকি নিয়ে চিন্তিত নয়। খুশকি থেকে নিস্তার পেতে বাজারে নানারকম ক্যামিকেল যুক্ত পণ্য পাওয়া যায়। কিন্তু এর ফলাফল সবসময় খুব একটা আশানুরূপ হয় না বরং এতে চুল ও মাথার ত্বকের ক্ষতি হতে পারে।

এই অনুচ্ছেদে খুশকি দূর করার ঘরোয়া উপায় এবং প্রাকৃতিক উপাদান সমূহের গুণাগুণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে যা ব্যবহার করে দ্রুত খুশকির প্রতিকার সম্ভব। এছাড়াও খুশকি কেন হয়, খুশকি দূর করার শ্যাম্পু এবং ওষুধ সম্পর্কে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

খুশকি কি? (What is dandruff?)

খুশকি সাধারণত মাথার ত্বকে হয়ে থাকে তবে শরীরের যে সমস্ত জায়গায় চুল রয়েছে সেখানেও হতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় খুশকি ‘সেবোরোয়িক ডারমাটাইটিস’ (seborrheic dermatitis) নামে পরিচিত। (Bhargava, 2020)

খুশকি কেন হয়? (What Causes dandruff)

খুশকি হওয়ার পেছনে অনেক গুলো কারণ রয়েছে। তবে প্রধান কারণ গুলোর মধ্যে অতিরিক্ত শুষ্ক বা তৈলাক্ত ত্বক, মাথার ত্বকে ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের সংক্রমণ এবং প্রদাহ অন্যতম। এছাড়াও সোরিয়াসিস এবং একজিমাসহ বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগের ফলে খুশকি হতে পারে।

খুশকি হলে কি হয়?

অতিরিক্ত খুশকি হওয়ার ফলে চুলকানির সৃষ্টি হয় এবং মাথার ত্বকে শুকনো চামড়ার স্তর জমে যেতে পারে। এছাড়াও খুশকির ফলে চুল পড়ে (Hair fall) যায়।

dandruff treatment

খুশকি দূর করার উপায় কি?

সাধারণত খুশকি শীতকালে বেশি হয়ে থাকে। তবে এর জন্য বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ কোনো প্রকার চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা ব্যতীত ঘরোয়া পদ্ধতিতে আপনি খুশকি থেকে মুক্তি পেতে পারেন। চলুন এই পর্যায়ে খুশকি দূর করার উপায় নিয়ে কথা বলা যাক।

১। ভিনেগার দিয়ে খুশকি দূর করার উপায়

ভিনেগার একটি পরিচিত এবং সহজলভ্য বস্তু যা খুশকি দূর করার প্রাকৃতিক ও কার্যকারী উপাদান হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এটি ব্যবহার করে আমরা সহজেই খুশকির সমস্যা থেকে প্রতিকার পেতে পারি।

ভিনেগার চুলকানি এবং ত্বকের শুষ্কভাব দূর করে, ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস ধ্বংস করে। এছাড়াও ভিনেগারে থাকা এসিড মাথার ত্বকে শুকনো চামড়ার স্তর জমতে বাঁধার সৃষ্টি করে।

ব্যবহারের নিয়ম:

সম পরিমাণ পানি এবং সাদা ভিনেগার নিয়ে মিশ্রণ তৈরী করতে হবে। মিশ্রণটি মাথায় ৩০ মিনিট রাখার পর ভালোভাবে মাথা ধুয়ে ফেলতে হবে। এই নিয়মে সপ্তাহে দুই দিন ব্যবহার করুন যা আপনাকে দেবে খুশকি মুক্ত ঝলমলে চুল।

২। বেকিং সোডা দিয়ে খুশকি দূর করার উপায়

স্ক্রাব হিসেবে বেকিং সোডা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। খুশকি হওয়ার ফলে আমাদের মাথার ত্বকে যে শুকনো চামড়ার স্তর জমে যায়, বেকিং সোডা ব্যবহারের মাধ্যমে এই স্তর এবং ত্বকের মরা চামড়াগুলো অতি সহজেই তুলে ফেলা যায়।

ব্যবহারের নিয়ম:

চুলে শ্যাম্পু করার সময় ব্যবহৃত শ্যাম্পুর সাথে সামান্য পরিমাণ সোডা মিশিয়ে নিয়ে চুল পরিষ্কার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

৩। নিম দিয়ে খুশকি দূর করার উপায়

নিমের ওষুধি গুণের কথা কে না জানে? অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগের বিরুদ্ধে নিমের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। খুশকি প্রতিরোধেও নিম অপরিহার্য। কারণ, নিমে রয়েছে কিছু বিশেষ উপাদান যা আমাদের ত্বকের ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া ও ফাঙ্গাস নির্মূলে অনেক কার্যকারী ভূমিকা পালন করে।

ব্যবহারের নিয়ম:

‘নিম পাতা সেদ্ধ পানি’ মাথার ত্বকে ব্যবহার করে খুশকি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এছাড়া এটি খুশকিজনিত চুলকানি দূর করতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৪। ‘টি ট্রি অয়েল’ বা চা গাছের তেল 

এই তেলে রয়েছে কিছু জাদুকরী গুণ যার কারণে প্রায় সব ধরনের ফাঙ্গাস এবং ব্রণরোধী ওষুধে এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। খুশকি দূর করতেও এর জুড়ি মেলা ভার।

ব্যবহারের নিয়ম:

এই তেলের কার্যকারিতা পেতে শ্যাম্পুর সাথে ১ থেকে ২ ফোঁটা মিশিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত ব্যবহারে এটি খুব দ্রুত খুশকি নির্মূল করে।

৫। রসুন

প্রাকৃতিকভাবে ফাঙ্গাস প্রতিরোধে রসুন অনেক কার্যকারী। একটি থেতলানো রসুনে ফাঙ্গাসরোধী যে গুণ রয়েছে তা আর কোন বস্তুতে নেই!

ব্যবহারের নিয়ম:

১-২ টি রসুনের কোয়া থেতলে পানির সাথে মিশিয়ে মাথার ত্বকে ব্যবহার করুন। ১৫ মিনিট পর মাথা ধুয়ে ফেলুন। আর খুব দ্রুতই দেখতে পাবেন এর কার্যকারীতা!

সতর্কতা:

রসুন-পানি ব্যবহারের ফলে চুল থেকে রসুনের ঝাঁঝালো গন্ধ আসতে পারে। গন্ধ দূর করতে পানির সাথে অল্প পরিমাণে মধু এবং আদা মিশিয়ে নিতে পারেন।

৬। এলোভেরা দিয়ে খুশকি দূর করার উপায়

এলোভেরা এটি একটি ঔষুধী গাছ। এর ঔষুধী গুণের সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। এটি ব্যবহারের ফলে ত্বকে শুধু ঠাণ্ডা ভাবই আসে না, বরং এর রয়েছে ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসরোধী বিশেষ গুণ। চুলের গোড়া শক্ত করতে এলোভেরার সাথে লেবুর রস ও কেস্টর অয়েলঃ এই প্যাকটি আমাদের মাথায় বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ দূর করে দেবে। আর চর্মরোগ থেকে খুশকি হয় আর অতিরিক্ত চর্মরোগ এবং খুশকি আমাদের চুলের বৃদ্ধি ব্যাহত করে এবং চুলের গোড়া নরম করে চুল ঝরা শুরু করে।

ব্যবহারের নিয়ম:

সঠিক কার্যকারিতা পেতে সরাসরি মাথার ত্বকে এলোভেরার জেলী ব্যবহার করাই ভালো। ব্যবহারের পর চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।

৭। সামুদ্রিক লবণ

সামুদ্রিক লবণে আছে অনেক পুষ্টিগুণ এবং মিনারেলস। সব খাবার লবণই সামুদ্রিক লবণ হয় না। আর এক্ষেত্রে সামুদ্রিক লবণ ব্যাবহারে আপনি ভাল ফলাফল পাবেন। খুশকি সমস্যা ছাড়াও সর্বোপরি ভাল চুলের জন্যও লবণ ব্যাবহার করা যেতে পারে। চলুন দেখা যাক, চুলের যত্নে কিভাবে লবণ ব্যবহার করবেন!

সামুদ্রিক লবণ

সামুদ্রিক লবণ

খুশকি সমস্যা সমাধানেঃ

১ থেকে ২ চা চামচ লবণ নিন। চুলকে ২ ভাগ করুন অথবা আপনার সুবিধা অনুযায়ী চুল গুছিয়ে নিন। এবার আঙ্গুলের মাথার সাহায্যে আলতোভাবে স্কাল্পে ম্যাসাজ করুন। এভাবে ৮ থেকে ১০ মিনিট ম্যাসাজ করুন। এরপর ধুয়ে ফেলুন।

এই ফর্মুলাটি মাথার খুশকি দূর করবে গভীর থেকে। স্কাল্প থেকে খুশকির পরদসহ উঠিয়ে নিয়ে আসবে।

তৈলাক্ত ভাব কমাতে এবং পাতলা চুল ঘন করতেঃ 

লবণ দিয়ে ভেজা চুলে ১৫ মিনিট আলতোভাবে ম্যাসাজ করুন এবং ধুয়ে ফেলুন। মাসে ২ বার ব্যবহার করুন।

লবণ স্কাল্পের অতিরিক্ত তৈলাক্ত ভাব দূর করে। এতে করে স্কাল্পের স্যাঁতস্যাঁতে ভাব দূর হবে এবং চুলের আঁশটে গন্ধও দূর হবে। তেলতেলে ভাব থেকে অনেকের মাথায় ফাংগাস হয়। এই সমস্যারও সমাধান হবে।

এই সামুদ্রিক লবণ নতুন চুল গজাতেও সাহায্য করে। লবণ ব্যবহারে স্কাল্পের ব্লাড সারকুলেশন ভাল থাকে। যার ফলে নতুন চুল গজায়। এই নিয়মে যাদের পাতলা চুলের সমস্যা আছে তাদের চুল ঘন হয়।

৮। কমলার খোসা ও লেবুর রস বা লেবু দিয়ে খুশকি দূর করার উপায়

কমলার খোসা ও লেবুর রস ব্যবহার আপনার মাথায় খুশকি দূর করতে সহায়তা করবে। তবে লেবুর রস মাথায় ব্যবহারের পর রোদে যাওয়া যাবে না। কারণ তা আপনার চুলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

ব্যবহারের নিয়ম:

কমলার খোসা ব্লেন্ডারে পিষে এর সাথে খানিকটা লেবুর রস মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। অতঃপর মাথার ত্বকে পেস্টের প্রলেপ দিয়ে ৩০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ৩০ মিনিট পর পরিষ্কার পানি অথবা শ্যাম্পু দিয়ে মাথা ভালোভাবে ধুয়ে নিন। ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য সপ্তাহে তিন দিন এই নিয়ম ফলো করুন।

৯। মেহেদী 

বহুকাল আগে থেকেই রূপচর্চায় প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে মেহেদীর ব্যবহার সমাদৃত। মাথার চুলের যত্নে এবং খুশকি দূর করতে মেহেদী ব্যবহার বেশ উপকারী ভূমিকা রাখে।

ব্যবহারের নিয়ম: 

সরাসরি মেহেদী পাতা বেঁটে মাথায় লাগিয়ে রাখুন। ১ ঘন্টা পর মাথা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন। সহায়ক উপাদান হিসেবে মেহেদীর সাথে লেবুর রস যোগ করতে পারেন। এতে আরো ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।

১০। ডিমের কুসুম 

ডিমের কুসুমে রয়েছে বায়োটিন নামক একটি উপাদান যা খুশকি দূর করে এবং মাথার ত্বকে পুষ্টি জোগায়। এটি প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে এবং চুল ভালো রাখে।

ব্যবহারের নিয়ম:

ডিমের সাদা অংশ বাদ দিয়ে শুধু কুসুম ব্যবহার করতে হবে। মাথার ত্বকে লাগিয়ে ১ ঘন্টা রাখুন। অতঃপর শ্যাম্পু দিয়ে মাথা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে সর্বোচ্চ তিন দিন এই পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন।

সতর্কতা:

ডিমের কুসুম ব্যবহারের ফলে মাথায় দুর্গন্ধ বোধ হতে পারে। এই সমস্যা সমাধানে সুগন্ধি যুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন।

খুশকি দূর করার শ্যাম্পু 

খুশকির চিকিৎসা হিসেবে বাজারে অনেক মেডিকেটেড শ্যাম্পু পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ

  • Ketoconazole
  • Salicylic acid
  • Pyrithione zinc
  • Coal tar preparations
  • Selenium sulfide ইত্যাদি

মেডিকেটেড শ্যাম্পু একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ (Dermatologist) এর পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা উত্তম। সাধারণত এটি সপ্তাহে সর্বোচ্চ একদিন ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। (Bhargava, 2020)

খুশকি দূর করার তেল 

Dandruff oil

খুশকি দূর করার তেল

খুশকি দূর করার জন্য নিয়মিত ভাবে নারিকেল তেল অথবা অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। কারণ এই তেলে রয়েছে ফাংগাস প্রতিরোধ করার ক্ষমতা যা খুশকি দূর করতে সহায়তা করবে।‌ (Bhargava, 2020)

খুশকি দূর করার হোমিও ঔষধ

হোমিওপ্যাথি একটি প্রাকৃতিক ও বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে খুশকির ওষুধ হিসেবে রয়েছে-

  • Ambra grisea
  • Calcarea sulph
  • Kali sulph
  • Natrum mur
  • Thuja occ
  • Syphilinum etc.

এই ওষুধ গুলো খুশকির কারণ ও লক্ষণের উপর ভিত্তি করে সেবনের মাধ্যমে বেশ কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যায়। তবে মনে রাখবেন, ওষুধ সেবনের জন্য অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

খুশকি হলে তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই! এই সমস্যার সমাধানের জন্য উপরের যে কোনো একটি টিপস কাজে লাগিয়ে মাথার ত্বককে রাখুন খুশকি মুক্ত এবং চুলকে করুন স্বাস্থ্যোজ্জল। তবে মনে রাখবেন, বেশ কয়েকদিন ধরে ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমেও খুশকি দূর না হলে সেক্ষেত্রে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন।

 

 

References

Bhargava, H. D. (2020, August 25). Dandruff Treatment. Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/skin-problems-and-treatments/understanding-dandruff-treatment

 

 

Last Updated on April 16, 2023