পুষ্টিকর বিভিন্ন ধরনের ড্রাই ফুডের মধ্যে বাদাম অন্যতম। আর বিভিন্ন প্রকার বাদামের মধ্যে কাঠবাদাম (Almonds) বেশ জনপ্রিয় কেননা ড্রাই ফুডগুলোর মধ্যে এটির পুষ্টিগুণ সবচেয়ে বেশি। কাঠবাদামে রয়েছে আঁশ বা ফাইবার, উপকারী ফ্যাট, প্রোটিন, মিনারেলস ও ভিটামিন সহ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
নিয়মিত কাঠবাদাম খেলে তা শরীরের জন্য কি কি উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে সেই বিষয়ে এই অনুচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে। সেই সাথে কাঠবাদাম খাওয়ার সঠিক নিয়ম এবং কখন তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে সেই সম্পর্কে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
কাঠবাদামের পুষ্টিগুণ
যুক্তরাষ্ট্রের FoodData Central (fdc) এর তথ্য অনুযায়ী প্রতি ১ আউন্স (২৮.৪ গ্রাম) পরিমাণ কাঠবাদামের মধ্যে খাবারের কোন পুষ্টি উপাদানটি কতটুকু পরিমাণে রয়েছে তা ছকের মাধ্যমে তুলে ধরা হলো: (Brazier, 2019)
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ |
শক্তি (Energy) | ১৬৪ ক্যালরি |
শর্করা | ৬.১ গ্রাম |
আঁশ | ৩.৫ গ্রাম |
আমিষ | ৬ গ্রাম |
ফ্যাট বা চর্বি | ১৪.২ গ্রাম |
ক্যালসিয়াম | ৭৬.৩ মিলিগ্রাম |
আয়রন | ১ মিলিগ্রাম |
ম্যাগনেসিয়াম | ৭৬.৫ মিলিগ্রাম |
ফসফরাস | ১৩৬ মিলিগ্রাম |
পটাশিয়াম | ২০৮ মিলিগ্রাম |
জিংক | ০.৯ মিলিগ্রাম |
কপার | ০.৩ মিলিগ্রাম |
ম্যাঙ্গানিজ | ০.৬ মিলিগ্রাম |
সেলেনিয়াম | ১.২ মাইক্রোগ্রাম |
ফলিক এসিড | ১২.৫ মাইক্রোগ্রাম |
ভিটামিন ই | ৭.২ মিলিগ্রাম |
কাঠবাদামের উপকারিতা
ছকে উল্লেখিত উপাদান গুলো সহ কাঠবাদামের মধ্যে আরো বিভিন্ন রকমের পুষ্টিগুণ রয়েছে যা বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে। যেমন: এন্টি-অক্সিডেন্ট, ফাইটোকেমিক্যাল তথা ফ্ল্যাভোনয়েড (Flavonoids), Plant sterols, phenolic acids ইত্যাদি। এই পর্যায়ে কাঠবাদামের ৩৫ টি উপকারিতা ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হলো।
১. কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়
মানুষের রক্তে দুই ধরনের কোলেস্টেরল রয়েছে যার মধ্যে HDL (high density lipoprotein) উপকারী এবং LDL (low density lipoprotein) খারাপ কোলেস্টেরল হিসেবে বিবেচিত। রক্তে HDL এর মাত্রা কম এবং LDL এর মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সাথে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। বেশি মাত্রার LDL কোলেস্টেরল সর্বোপরি স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ একটি সমস্যা।
কাঠবাদামে প্রচুর পরিমাণে মনো আনস্যাচুরেটেড ও পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট রয়েছে যা খারাপ কোলেস্টেরল বা LDL এর পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। সেই সাথে প্রতিদিন নিয়ম করে কাঠবাদাম খেলে ভালো কোলেস্টেরল বা HDL এর পরিমাণ বাড়তে থাকে। এই ব্যাপারে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা নিয়মিত ৫০ গ্রাম পরিমাণে কাঠবাদাম খেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে LDL এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে এবং HDL এর সঠিক ভারসাম্য বজায় রয়েছে। সেই সাথে আরেকটি বিশেষ উপকারিতা লক্ষ্য করা গেছে আর তা হলো পেটের মেদ কমে যাওয়া। অর্থাৎ কোলেস্টেরলের সাথে সাথে কাঠবাদাম পেটের মেদ কমাতেও সহায়তা করে থাকে। (Leech, 2018)
২. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে
উচ্চ রক্তচাপের (Hypertension) ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক (Stroke) এবং কিডনি ফেইলিউর এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর উচ্চ রক্তচাপের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো রক্তে অতিরিক্ত মাত্রায় LDL কোলেস্টেরলের উপস্থিতি। কাঠবাদাম রক্তে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে।
এছাড়াও কাঠবাদামের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়াম রয়েছে যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সেই সাথে কাঠবাদামে বিদ্যমান ভিটামিন ই (আলফা টোকোফেরল) উচ্চ রক্তচাপ কমাতে পারে।
৩. হৃদরোগ প্রতিরোধ করে
হৃদরোগ (heart diseases) অত্যন্ত বিপজ্জনক এ কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। বর্তমানে করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনেক মানুষ এই রোগে অকালে মারা যাচ্ছে। কাঠবাদামে থাকা পুষ্টি উপাদানগুলো বিভিন্ন উপায়ে হৃদপিন্ড (Heart) ভালো রাখতে সাহায্য করে। যেমনঃ
- রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের (LDL) মাত্রা কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরলের (HDL) পরিমাণ বৃদ্ধি করে। রক্তে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য বজায় থাকলে হার্টের রোগের ঝুঁকি কমে যায়
- গবেষণায় দেখা গেছে যে কাঠবাদামে বিদ্যমান এন্টি-অক্সিডেন্ট রক্ত প্রবাহ সুস্থিত রাখতে এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে
- কাঠবাদামে থাকা ভিটামিন ই এবং ফাইবার হার্টের জন্য উপকারী
৪. ওজন কমাতে সাহায্য করে
কাঠবাদামে রয়েছে চর্বি যা খেলে মানুষ সহজেই মোটা হয়ে যায়- এটি একটি ভুল ধারণা। কারণ কাঠবাদামে যে চর্বি রয়েছে তা স্বাস্থ্যসম্মত চর্বি (Healthy Fats) এবং সেই সাথে কাঠবাদামে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে কিন্তু তুলনামূলক কম কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrates) রয়েছে। আর মানুষের শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার জন্য প্রধানত দায়ী হলো কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার।
স্ন্যাকস বা হালকা নাস্তা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিবর্তে কাঠবাদাম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কারণ ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবারে অনেক ক্যালরি রয়েছে, পক্ষান্তরে কাঠবাদামে তুলনামূলক কম ক্যালরি রয়েছে কিন্তু অধিক পরিমাণে ফাইবার থাকার দরুন সহজেই পেট ভরে যায়। ১৩৭ জন ব্যক্তির উপর ৪ সপ্তাহ সময় ধরে চালানো একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রত্যেক দিন ৪৩ গ্রাম কাঠবাদাম খাওয়ার ফলে ক্ষুধা বোধ ও খাওয়ার ইচ্ছা কমে যায়। এছাড়াও আরো কিছু গবেষণার মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করে বলেছেন যে কাঠবাদাম ক্ষুধা কমিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা (hunger fighting effects) রয়েছে। (Leech, 2018)
৫. ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
কাঠবাদাম হলো Low glycemic index সমৃদ্ধ খাবার অর্থাৎ এতে খুবই কম পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা রয়েছে যা খুব সহজেই রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় না। পক্ষান্তরে এর মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত চর্বি, ভালো মানের আমিষ ও প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা ক্ষুধা ও ক্যালরির চাহিদা মেটাতে পারে কিন্তু তাতে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যায় না।
এছাড়াও টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীদের ক্ষেত্রেই শরীরে ম্যাগনেসিয়াম এর ঘাটতি দেখা যায়। আর চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতামত অনুযায়ী শরীরে ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি হওয়ার সাথে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বা ডায়াবেটিস হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। ২০১১ সালে ২০ জন টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর উপর ১২ সপ্তাহ ধরে একটি গবেষণা চালানো হয়। এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি প্রত্যেকদিন ৬০ গ্রাম পরিমাণ কাঠবাদাম খেতে দেওয়ার পর ফলাফল হিসেবে দেখতে পাওয়া যায় যে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এছাড়াও আরো কিছু গবেষণার ভিত্তিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে নিয়মিত কাঠবাদাম সেবন করা টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৬. ষ্ট্রোক প্রতিরোধে সাহায্য করে
কোনো কারণবশত মস্তিষ্কের রক্ত নালীতে রক্ত জমাট বেঁধে অথবা রক্ত নালী ছিঁড়ে যাওয়ার দরুন মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটলে তাকে স্ট্রোক (Stroke) বলা হয় যা একটি প্রাণঘাতী ব্যাধি। স্ট্রোকের কারণ গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি যেমন অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাঠবাদাম বিশেষ ভূমিকা পালন করে যা ইতিমধ্যেই উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও স্ট্রোকের আরেকটি কারণ হলো রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL- low density lipoprotein) এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট (Trans fat) রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে আর কাঠবাদামের মধ্যে স্যাচুরেটেড ফ্যাট খুবই সামান্য মাত্রায় রয়েছে এবং ট্র্যান্স ফ্যাট একদম ই নেই। উপরন্তু কাঠবাদামে থাকা মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড রক্তে স্বাস্থ্যকর লিপিড প্রোফাইল তৈরি করে যা করোনারী আর্টারি ডিজিজ এবং ষ্ট্রোক প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কোন ধরনের খাদ্যের মধ্যে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট রয়েছে তা জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
৭. হজম শক্তি বাড়ায়
কাঠবাদামের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা হজমের সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে। এছাড়াও যাদের ক্ষেত্রে দুধ খেলে হজমের সমস্যা হয় তাদের ক্ষেত্রে কাঠবাদামের দুধ (Almonds milk) উপকারী হতে পারে। এর কারণ হলো দুধের মধ্যে ল্যাকটোজ (Lactose) নামক একটি উপাদান রয়েছে যা অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই হজমের সমস্যা সৃষ্টি করে যাকে মেডিকেলের ভাষায় Lactose intolerance বলা হয়। কাঠবাদামের দুধে প্রাকৃতিক ভাবেই ল্যাকটোজ থাকে না ফলে Lactose Intolerance এর রোগীদের জন্য কাঠবাদামের দুধ নির্দেশিত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য বাজারে ল্যাকটোজ ফ্রি দুধ কিনতে পাওয়া যায় যা কৃত্রিম উপায়ে ল্যাকটোজ মুক্তভাবে তৈরি করা হয়ে থাকে।
৮. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) একটি কমন স্বাস্থ্য সমস্যা যা একাধারে যন্ত্রণাদায়ক এবং দীর্ঘমেয়াদী কোষ্ঠকাঠিন্য নানাবিধ রোগ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে যেমন পাইলস। কাঠবাদামে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ যা খাবার সঠিকভাবে হজমে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। সেই সাথে নিয়মিত আঁশ জাতীয় খাবার গ্রহণ করার ফলে পাইলস (Hemorrhoids) হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।
৯. ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে
কাঠবাদামে প্রচুর পরিমাণে আঁশ (Fiber) রয়েছে যা কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে বাদাম খাওয়ার সাথে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যাওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী মহিলাদের মধ্যে যারা নিয়মিত বাদাম খেয়েছেন তাদের বেলায় সাধারণ মহিলাদের তুলনায় স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম দেখা গেছে। এর কারণ হিসেবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে কাঠবাদামে থাকা ভিটামিন ই, ফ্লাভিনয়েড, polyphenols, এন্টি-অক্সিডেন্ট ইত্যাদি স্তন ক্যানসার (Breast cancer) প্রতিরোধে সাহায্য করে থাকে। (Brazier, 2019)
আপনার ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কতটুকু ঝুঁকি রয়েছে তা জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
১০. হাড় মজবুত করে
কাঠবাদামে থাকা প্রোটিন, মিনারেলস যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, কপার, জিংক ইত্যাদি হাড়ের গঠনে সহায়তা করে। ফসফরাস দাঁত মজবুত করতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও কাঠবাদামে সামান্য পরিমাণে ভিটামিন ডি পাওয়া যায় যা ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী হাড়ের গঠন ও ঘনত্ব ঠিক রাখার জন্য যে সমস্ত পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন তা কাঠবাদাম থেকে পাওয়া যায়। আর তাই হাড়ের সুরক্ষায় নিয়মিত কাঠবাদাম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
১১. ‘অ্যানিমিয়া’ প্রতিরোধে সাহায্য করে
‘অ্যানিমিয়া’ (Anemia) শব্দটির সাথে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিতি। অ্যানিমিয়া শব্দের অর্থ হলো ‘রক্ত স্বল্পতা’। রক্তস্বল্পতা/অ্যানিমিয়া বলতে মূলত রক্তে হিমোগ্লোবিন (Hemoglobin) এর অভাব কে বুঝানো হয়। যাদের রক্তস্বল্পতা আছে তারা কাঠবাদাম খেয়ে এই সমস্যা দূর করতে পারে। কেননা কাঠবাদামে রয়েছে কপার, আয়রন এবং ভিটামিন যা রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে, ফলে রক্তস্বল্পতা দূর হয়ে যায়।
১২. গর্ভাবস্থায় কাঠবাদামের উপকারিতা
গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত কাঠবাদাম খেলে গর্ভস্থ সন্তানের জন্মগত ত্রুটি (বার্থ ডিফেক্ট) হওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়। কারণ কাঠবাদামে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ‘ফলিক অ্যাসিড’ এবং ‘ভিটামিন বি’ যার অভাবে গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটি হয়ে থাকে। আর তাই শিশুর বার্থ ডিফেক্ট প্রতিরোধে গর্ভধারণের কয়েক মাস আগে থেকে শুরু করে গর্ভকালীন সময়ে ভিটামিন বি বিশেষত ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে।
এছাড়াও গর্ভকালীন সময়ের একটি কমন সমস্যা হলো এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা আর আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছি যে কাঠবাদাম রক্তস্বল্পতা দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। গর্ভকালীন সময়ে রক্তস্বল্পতা দূর করতে আয়রন ট্যাবলেট (Iron supplement) গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয় তবে তা কোষ্ঠকাঠিন্য সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে কাঠবাদামে আয়রন রয়েছে যা রক্তস্বল্পতা দূর করে এবং সেই সাথে প্রচুর ফাইবার থাকার দরুন কোষ্টকাঠিন্য সৃষ্টি করে না। যদিও কাঠবাদাম একটি প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত নিরাপদ প্রকৃতির খাবার তবে গর্ভকালীন সময়ে রক্তস্বল্পতা দূর করতে খুব বেশি মাত্রায় খেতে চাইলে সেক্ষেত্রে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ (Gynecologist) চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
১৩. স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে
কাঠবাদামে থাকা প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি এবং মিনারেলস মস্তিষ্কের কোষগুলোকে শক্তিশালী করে স্মৃতিশক্তি প্রখর করে তোলে। এছাড়াও ১ আউন্স পরিমাণ কাঠবাদাম থেকে যে পরিমাণ ভিটামিন ই পাওয়া যায় তা দৈনিক চাহিদার অর্ধেকর বেশি অংশ পূরণ করতে পারে। আর গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত ভিটামিন ই গ্রহণের ফলে Alzheimer’s রোগের ঝুঁকি কমে যায়। (Leech, 2018) উল্লেখ্য Alzheimer’s হলো এমন একধরনের রোগ যেখানে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায় তথা স্মৃতি শক্তি এবং চিন্তা করার সক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
১৪. ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে
কাঠবাদাম এক ধরণের ময়েশ্চারাইজার হিসেবেও কাজ করে। এটি মুখের ব্ল্যাক হেডস এবং ব্রণ দূর করতে সাহায্য করে। যাদের ত্বক তৈলাক্ত তারা ময়েশ্চারাইজারের পরিবর্তে কাঠবাদামের তেল ব্যবহার করতে পারেন। (Jain, n.d.)
১৫. ত্বকের স্ক্রাবার হিসেবে কাজ করে
এটি স্ক্রাব হিসেবেও কাজ করে। কাঠবাদামের আধা ভাঙা দানার সঙ্গে মধু ও টক দই মিশিয়ে মুখে আলতো করে ম্যাসাজ করুন। এটি প্রাকৃতিক স্ক্রাবের কাজ করে। ‘ভিটামিন ই’ সমৃদ্ধ এই স্ক্রাব ত্বকের ডেড সেল বা মৃত কোষ দূর করে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
১৬. ত্বকের বলিরেখা দূর করে বয়সের ছাপ কমায়
কাঠবাদাম ত্বকের বলিরেখা দূর করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন কাঠবাদামের তেল দিয়ে ত্বক ম্যাসাজ করলে, ত্বকের বলিরেখা কমে যাবে। এছাড়া মধু, লেবু ও কাঠবাদামের তেল একসাথে মিশিয়ে মুখে মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করলে ত্বক হয়ে উঠবে দীপ্তিময় এবং উজ্জ্বল । এভাবে এটি বয়সের ছাপ কমাতে যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
১৭. তারুণ্যের রহস্য হিসেবে কাজ করে
এন্টিএজিং (Anti-aging) হিসেবে কাঠবাদাম তেলের তুলনা হয় না। রাতে ঘুমানোর আগে কয়েক ফোঁটা তেল মুখে মেখে ঘুমান এবং সকালে ধুয়ে ফেলুন। এটি নিয়মিত করলে ত্বকের তারুণ্য থাকবে অনেকদিন।
১৮. ত্বক উজ্জ্বল করে
কাঠবাদামের তেলে রয়েছে ‘ভিটামিন ই’। ‘ভিটামিন ই’ ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা ও সানবার্ন (Sunburn) রোধ করে। নিয়মিত এই তেল দ্বারা ম্যাসাজ করলে ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, ফলে ত্বক সতেজ থাকে।
১৯. ত্বক পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে
কাঠবাদামের তেল ত্বক পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। কয়েকটি কাঠ বাদাম ভিজিয়ে রাখুন এবং কিছু সময় পর পেস্ট তৈরি করুন। বাদামের পেস্টের সাথে ১ চামচ মধু এবং ১ চামচ টক দই মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করুন। মিশ্রণটি দিয়ে মুখ কিছু সময় ম্যাসেজ করুন এবং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত মিশ্রণটি ব্যবহার করলে ত্বক পরিষ্কার থাকবে।
২০. মেকআপ তুলতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে
কাঠবাদামের তেল মেকআপ তুলতে সাহায্য করে। কিছু পরিমাণ তুলা নিয়ে তা বাদাম তেলে ভিজিয়ে নিন। তুলা দিয়ে হালকা করে তেল মুখে লাগান। অতঃপর টিস্যু অথবা তুলা দিয়ে মুখ মুছে ফেলুন। মুখ থেকে মেকআপ তোলার জন্য আর যুদ্ধ করতে হবেনা বরং খুব সহজেই উঠে যাবে এই ফর্মুলা ব্যবহার করার মাধ্যমে।
২১. ত্বকের দাগ দূর করে
ত্বকের দাগ দূর করতে যাদুর মত কাজ করে কাঠবাদামের তেল। হাতের তালুতে তেল নিয়ে বৃত্তাকারে দাগের জায়গাতে তেল লাগান। প্রতিদিন ২ বার তেল ব্যবহার করলে কয়েক দিনের মধ্যে ভাল ফল পাবেন।
২২. চোখের নীচের কালো দাগ দূর করে
কাঠবাদামের তেল চোখের নীচে কালো দাগ দূর করে। তাছাড়া কাঠবাদাম বেটে পেস্ট তৈরি করে তা রাতে ঘুমানোর সময় চোখের নিচে ত্বকে দিয়ে ঘুমালে চোখের নীচের কালো দাগ চলে যায় এবং চোখের বলিরেখা ও চোখ ফোলা ভাব কমে যায়। তবে ব্যবহারের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেনো তা চোখের মধ্যে প্রবেশ না করে।
২৩. ত্বক, নখ এবং চুলের যত্নে
বাদামের তেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই ও বিটা ক্যারোটিন। এন্টি-অক্সিডেন্ট ত্বককে আর্টিফিশিয়াল কেমিক্যাল থেকে রক্ষা করে। কাঠবাদাম বাটা অথবা কাঠবাদামের তেল ত্বকে, চুলে, হাতে এবং নখে নিয়মিত ব্যবহার করলে ত্বক উজ্জ্বল ও মসৃণ হয়ে উঠবে এবং চুল ঝলমলে হবে।
২৪. চুল পড়া রোধে সাহায্য করে
চুল পড়া, চুলের রুক্ষতা এবং মাথার ত্বকের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় কাঠবাদামের তেলের জুড়ি নেই। এতে রয়েছে ভিটামিন ডি ও ম্যাগনেসিয়াম যা চুল পড়া রোধ করে এবং মাথার ত্বককে সবল করে তোলে। চুলে সরাসরি এই তেল লাগিয়ে কয়েক ঘণ্টা রেখে চুল ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত কিছুদিন ব্যবহার করে নিজেই এর ফলাফল দেখে অবাক হবেন।
২৫. চুল মজবুত ও আকর্ষণীয় করে
কাঠবাদামে রয়েছে পলিআনস্যাচুরেটেড অয়েল, ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন এ, ডি, বি-১, বি-২ এবং বি-৬ যা চুলকে মজবুত এবং আকর্ষণীয় করে তোলে। ফ্যাটি এসিড চুলকে প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দেয় এবং চুলকে করে তোলে মসৃণ ও মজবুত।
২৬. দ্রুত চুল লম্বা করতে সাহায্য করে
অনেকেই লম্বা চুল পছন্দ করেন কিন্তু চুল ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে চুল লম্বা রাখতে পারেন না। ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে চুল ভেঙ্গে ভেঙে পড়তে থাকে। কাঠবাদামের তেলে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম থাকে যা চুল ভেঙ্গে যাওয়া রোধ করে এবং চুলকে দ্রুত লম্বা হতে সাহায্য করে। নিয়মিত কাঠ বাদামের তেল ব্যবহার এবং সেই সাথে কাঠবাদাম খেলে লম্বা চুলের স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব।
২৭. খুশকি দূর করে
শীতকালে অনেকেই খুশকির সমস্যায় ভোগেন। খুশকির কারণে চুল পড়াও বেড়ে যায় এবং ত্বকের নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। কাঠবাদামের তেল ব্যবহারের ফলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সমপরিমাণ কাঠবাদামের তেল এবং নিমের তেল রাতে ঘুমানোর আগে মাথার ত্বকে ভালোভাবে মালিশ করুন। এভাবে সারা রাত রাখুন। সকালে ঘুম থেকে উঠে শ্যাম্পু করুন। নিয়মিত ব্যবহার করলে খুশকির সমস্যা দূর হবে।
২৮. কোঁকড়া চুল সোজা করে
অনেকেই কোঁকড়া চুল নিয়ে অনেক চিন্তিত। কাঠবাদামের তেল কোঁকড়া চুলকে সোজা করতে সাহায্য করে। কাঠবাদামের তেলে থাকা ‘ভিটামিন ই’ চুলকে মসৃণ করে এবং অনিয়ন্ত্রিত কোঁকড়া চুলের সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।
২৯. মাথার ত্বকের জ্বালাপোড়া প্রতিরোধ করে
প্রতিদিনের ধুলা, ময়লা এবং দূষণের ফলে মাথার ত্বকে ময়লা জমে। এসব কারণে অনেক সময় মাথার ত্বকে ছত্রাক আক্রমণ করে। এতে করে অনেকের মাথার ত্বকে প্রদাহ হয়। নিয়মিত কাঠবাদামের তেল ব্যবহার করলে ত্বকে ছত্রাকের সংক্রমণ এবং প্রদাহ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৩০. নতুন চুল গজাতে/ চুল ঘন করতে সাহায্য করে
অনেকের চুল যে পরিমাণ পড়ে সে পরিমাণে গজায় না ফলে চুল পাতলা হয়ে যায়। কাঠবাদামের তেল নতুন করে চুল গজাতে সাহায্য করে। ৩ টেবিল চামচ বাদামের তেলের সাথে ২ টেবিল চামচ ক্যাস্টর অয়েল (castor oil) এবং ১ টি জবা ফুলের রস একসাথে মিশিয়ে নিন। মিশ্রণটি কিছু সময় গরম করুন এবং চুলা থেকে নামিয়ে ঠাণ্ডা করুন। ঠাণ্ডা হলে মাথার ত্বকে মালিশ করুন এবং ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এরপর একটি তোয়ালে গরম পানিতে ভিজিয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। অতঃপর তোয়ালেটি মাথায় ১ ঘণ্টা পেচিয়ে রাখুন। ১ ঘণ্টা পর শ্যাম্পু করুন। নিয়মিত ব্যবহার করলে পার্থক্য নিজেই বুঝতে পারবেন।
৩১. পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ায়
কাঠবাদামে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানগুলো যেমন মিনারেলস, উপকারী ফ্যাট এবং ভিটামিন ই এর প্রভাবে পুরুষের শুক্রাণুর পরিমাণ এবং গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। সেই সাথে পুরুষের যৌন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে কাঠবাদাম।
তবে রাস্তা ঘাটে হকাররা অনেক সময় চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কাঠবাদামের উপকারিতা এমনভাবে উপস্থাপন করেন যেনো তা পুরুষের যৌন সমস্যা দূর করার অন্যতম একটি ওষুধ। মনে রাখবেন এটি কোনো ওষুধ নয় বরং পুষ্টিকর খাবার যা শরীরের জন্য উপকারী এবং সেই সাথে কিছু কিছু রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
পক্ষান্তরে পুরুষের যৌন অক্ষমতা একটি রোগ যাকে মেডিকেলের ভাষায় ইরেকটাইল ডিসফাংশন (Erectile dysfunction, ED) বলা হয়। এই সমস্যা প্রতিকারে অবশ্যই একজন যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে চিকিৎসার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার হিসেবে কাঠবাদাম খাওয়া যেতে পারে।
ইরেকটাইল ডিসফাংশন (ED) কেন হয় সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
৩২. মেনোপজকালীন সমস্যা দূর করে
৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে নারীদের পিরিয়ড সাইকেল স্থায়ী ভাবে বন্ধ হয়ে যায় যাকে মেডিকেলের ভাষায় মেনোপজ (Menopause) বলা হয়। মেনোপজের সময় মহিলাদের শারীরিক ও মানসিক কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। যেমন: মেজাজ খিটখিটে হওয়া, শারীরিক দুর্বলতা, জ্বালাপোড়া ইত্যাদি। এই সময়ে কাঠবাদাম খাওয়ার মাধ্যমে কাঠবাদামে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানগুলোর সহায়তায় মেনোপজের সমস্যা কিছুটা কমে যায়।
এছাড়াও মেনোপজের সময় নারীদের শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের ফলে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায় যার ফলে অনেকের বেলায় হাড় ক্ষয় (Osteoporosis) রোগ হয়ে থাকে। এই সমস্যা প্রতিরোধে কাঠবাদাম বিশেষ ভূমিকা পালন করে কারণ কাঠবাদামে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে যা হাড়ের ঘনত্ব ঠিক রাখতে সহায়তা করে।
৩৩. জ্বর কমাতে সাহায্য করে
জ্বর কমাতে কিছু বিশেষ প্রকৃতির তেল যেমন: Cinnamon, Ginger, Tea tree, Eucalyptus, Lavender ইত্যাদি তেল শরীরে মালিশ করলে তা শরীরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এই সমস্ত তেলের সাথে মিশ্রণ তৈরির জন্য সহায়ক হিসেবে কাঠবাদামের তেল ব্যবহার করতে হয়। তবে জ্বর খুব বেশি হলে কোন ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে সেই ব্যাপারে নির্দেশনা হলো:
- শিশুর বয়স ৩ মাসের কম হলে সেক্ষেত্রে জ্বর ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি
- ২ বছর বয়সের শিশুদের জন্য জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি
- বয়স্কদের জন্য ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি জ্বর
- একটানা ৩ দিনের বেশি সময় ধরে জ্বর এবং তা ক্রমাগত বাড়তে থাকা
- জ্বরের সাথে শরীর ব্যথা, গলা ব্যথা, কাশি বা অন্য কোনো উপসর্গ
৩৪. শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে
তিনবেলা খাবার গ্রহণ করার ফাঁকে সকালে ও সন্ধ্যায় আমরা চা নাস্তা খেয়ে থাকি। এই সময়ের নাস্তায় কাঠবাদাম রাখা হলে তা যেমন অন্যান্য ক্ষতিকর ফাস্টফুড খাওয়া প্রতিরোধ করে তেমনি ভাবে কাঠবাদামে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান গুলো শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করে।
৩৫. রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে
কাঠবাদামে থাকা এন্টি-অক্সিডেন্ট ও ফাইটোকেমিক্যাল সমূহ সর্বোপরি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ ও জীবাণুর সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
কাঠবাদামের উপকারিতা ও অপকারিতা
কাঠবাদাম যেমন নানাবিধ উপকারিতা সম্পন্ন একটি খাবার তেমনি ভাবে এর কিছু অপকারিতাও রয়েছে। অনেকের ক্ষেত্রেই কাঠবাদাম খাওয়ার ফলে এলার্জিক রিয়েকশান হতে পারে যার লক্ষণ হিসেবে দেখা যায় ত্বকের উপরিভাগে লাল চাকা, চোখ মুখ ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। যাদের ক্ষেত্রে এলার্জি দেখা দেয় তাদের জন্য কাঠবাদাম না খাওয়াই ভালো।
এছাড়াও কাঠবাদামের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে অক্সালেট (oxalate) রয়েছে যা কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। আর তাই অতিরিক্ত পরিমাণে কাঠবাদাম খাওয়া উচিত হবে না। সেই সাথে যাদের ইতিপূর্বে কিডনিতে পাথর হয়েছিল অথবা বংশগত ভাবে কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা রয়েছে তাদের জন্য চিকিৎসকেরা কাঠবাদাম খেতে নিরুৎসাহিত করে থাকেন। (Brown, 2022)
কাঠবাদাম খাওয়ার সঠিক নিয়ম
কাঠবাদাম কাঁচা, শুকনো, ভাজা (Roasted) অথবা পানিতে ভিজিয়ে রেখে খাওয়া যায়। তবে কিভাবে খেলে সবচেয়ে বেশি উপকারিতা পাওয়া যাবে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদিও এই বিষয়টি নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে তবে এই পর্যায়ে আমরা চেষ্টা করবো কাঠবাদাম খাওয়ার নিয়মের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে।
একদম কাচা কাঠবাদামের মধ্যে যে পরিমাণ পানি রয়েছে তা শুকনো অথবা ভাজা বাদাম থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। ভাজা বাদামের মধ্যে পানির পরিমাণ খুবই কম থাকে এবং সেই সাথে কিছু কিছু পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। যেমন: ভিটামিন বি ও সি তাপের প্রতি সংবেদনশীল অর্থাৎ আগুনের তাপে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তবে কাঁচা খাওয়ার চেয়ে ভাজা কাঠবাদাম অনেকের কাছেই সুস্বাদু মনে হতে পারে। কাঠবাদাম সালাদ, ওটমিল, পাস্তার সাথে মিশিয়ে অথবা শুধু হালকা ভেঁজেও খাওয়া যায়।
কাঠবাদাম ভিজিয়ে খাওয়ার নিয়ম
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে কাঠবাদাম পানিতে ভিজিয়ে রেখে খাওয়ার ফলে সবচেয়ে বেশি উপকারিতা পাওয়া যায়। ভিজিয়ে রাখার ফলে কেনো উপকারিতা বেড়ে যায় এবং কিভাবে ভিজিয়ে রাখতে হবে সেই বিষয়গুলো নিচে উপস্থাপন করা হলো। (McGrane, 2016)
✓ ভিজিয়ে রাখা হলে খেতে নরম মনে হয় এবং তা সহজেই হজম হতে পারে। অর্থাৎ পাকস্থলীতে প্রবেশের পর বিভিন্ন এনজাইমের সহায়তায় হজম হতে সুবিধা হয়।
✓ কাঠবাদামের মধ্যে কিছু উপাদান (phytic acid) রয়েছে যা অন্ত্রে বিভিন্ন খনিজ যেমন আয়রন, জিংক, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি শোষণের ক্ষেত্রে বাঁধার সৃষ্টি করে থাকে। তবে কাঠবাদাম ভিজিয়ে রাখা হলে তাতে Phytic acid এর পরিমাণ কমে যায় এবং যার মাধ্যমে খনিজ শোষণে সমস্যা হয় না।
✓ কাঠবাদামের আস্তরণে ট্যানিন (tannins) নামক একটি উপাদান থাকে যার ফলে খেতে কিছুটা কম সুস্বাদু মনে হয় এবং সেই সাথে অতিরিক্ত পরিমাণের ট্যানিন শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে মজার বিষয় হলো ভিজিয়ে রাখার ফলে কাঠবাদামে থাকা ট্যানিন এর পরিমাণ উল্ল্যেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়।
✓ ভিজিয়ে রেখে উপরের আস্তরণ তুলে ফেলা হলে ট্যানিন সহ polyphenols দূর হয়ে যায়। যদিও ট্যানিন এবং polyphenols বিভিন্ন প্রকারের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে তবে তা অতিরিক্ত মাত্রায় ক্ষতিকর। আর তাই যারা প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে কাঠবাদাম খেয়ে থাকেন তাদের জন্য উপরের আস্তরণ তুলে ফেলাই ভালো।
কিভাবে এবং কতক্ষণ সময় ধরে কাঠবাদাম ভিজিয়ে রাখতে হবে?
গবেষণায় দেখা গেছে যে ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হলে তাতে কাঠবাদামে থাকা Phytic acid এর পরিমাণ হ্রাস পায়। তবে এতো বেশি সময় ভিজিয়ে রেখে খাওয়া অনেকের কাছেই ঝামেলা মনে হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো পানিতে ভেজানোর সময় তাতে ১ চা চামচ পরিমাণ খাবার লবণ মেশাতে হবে। আর তাতে করে ৮ থেকে ১২ ঘন্টা ভেজানো হলেই যথেষ্ট হবে। ভিজিয়ে রাখার ধাপ গুলো নিম্নরূপ:
- ১ টি বাটিতে ৫০ গ্রাম কাঠবাদাম নিয়ে তাতে পর্যাপ্ত পানি এবং ১/২ চা চামচ পরিমাণ লবণ দিয়ে ভিজিয়ে রাখুন
- ৮ থেকে ১২ ঘন্টা পরে পানি ফেলে দিয়ে কাঠবাদাম গুলো সাথে সাথেই খেয়ে নিন
- ভিজিয়ে রাখার পর সংরক্ষণ করতে চাইলে অবশ্যই পলিথিন অথবা ঢাকনা যুক্ত বাটিতে করে ফ্রিজে রেখে দিতে হবে
খালি পেটে কাঠবাদাম খাওয়ার উপকারিতা
সারারাত ধরে ভিজিয়ে রেখে সকাল বেলা খালি পেটে কাঠবাদাম খাওয়া একটি সহজ ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। এই পদ্ধতিতে খাওয়ার ফলে উপরে কাঠবাদামের যে সমস্ত উপকারিতা সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলো পাওয়া যায়। উপরন্তু যাদের ক্ষেত্রে পাকস্থলী ও হজম সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এটি বেশি উপযোগী হয়ে থাকে। সেই সাথে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে থাকে।
কাঠবাদাম নিঃসন্দেহে একটি পুষ্টিকর খাবার যা শরীরের জন্য নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনে এবং সেই সাথে কাঠবাদামের তেল চুল ও ত্বকের যত্নে ব্যবহারের মাধ্যমে সুফল পাওয়া যায়। আর তাই নিয়মিত কাঠবাদাম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন এবং নিজেকে সুস্থ রাখুন।
References
Brazier, Y. (2019, December 12). The health benefits of almonds. From Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/269468#_noHeaderPrefixedContent
Brown, S. (2022, January 27). Can What You Eat Give You Kidney Stones? From WebMD: https://www.webmd.com/kidney-stones/kidney-stones-food-causes
Jain, D. (n.d.). 21 Healthy Benefits Of Almonds: Facts And FAQs. From Pharmeasy: https://pharmeasy.in/blog/20-healthy-benefits-of-almonds-facts-and-faqs/amp/
Leech, J. (2018, September 06). 9 Evidence-Based Health Benefits of Almonds. From Healthline: https://www.healthline.com/nutrition/9-proven-benefits-of-almonds#TOC_TITLE_HDR_5
McGrane, K. (2016, August 19). Should You Soak Almonds Before Eating Them? From Healthline: https://www.healthline.com/nutrition/soaking-almonds
Last Updated on May 27, 2023
Leave A Comment