কোনো ব্যক্তির শরীরের ওজন (Weight) বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী স্বাভাবিকের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কম হলে তাকে কম ওজনের অধিকারী (Underweight) বলে। কম ওজনের মানুষের বিএমআই মান ১৮.৫ এর কম হয়ে থাকে। শরীরের স্বাভাবিক ওজন অর্জন করার জন্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ শরীরের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধি সাধনের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এই অনুচ্ছেদে ১৭ টি স্বাস্থ্যকর খাবার যা খেলে দ্রুত ওজন বাড়ে সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও ওজন বাড়ানোর কয়েকটি টিপস জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

স্বাস্থ্যকর খাবার যা খেলে দ্রুত ওজন বাড়ে

১. ঘরে তৈরি প্রোটিন স্মুদি

প্রোটিন স্মুদি (Protein smoothies) খুব পুষ্টিকর খাবার এবং দ্রুত ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। বিভিন্ন ফল, বাদাম, দুধ ও চকলেটের মিশ্রণে স্মুদি তৈরি হয়। যেমনঃ (Mawer, 2020) 

  • চকলেট, কলা ও বাদামের স্মুদি: ১টি পাকা কলা, ১ টেবিল চামচ চকলেট, ১ টেবিল চামচ পিনাট বাটার (Peanut butter)
  • আপেল, টক দই ও চিনির স্মুদি: ১ টি আপেল, ১ কাপ দই, ১ চা চামচ পরিমাণ চিনি বা মধু
  • চকলেট, দুধ ও অ্যাভোকাডোর স্মুদি: ১ টেবিল চামচ চকলেট, ১ কাপ দুধ, ১ টি অ্যাভোকাডো
  • আঙ্গুর, টক দই, দুধ ও চিনি স্মুদি: ১ কাপ আঙ্গুর, ১ কাপ দই, ১ কাপ দুধ, ১ চা চামচ চিনি বা মধু 

২. ভাত 

আমাদের দেশের প্রধান খাদ্য হলো ভাত যা মূলত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার। ভাত খাওয়ার পরে শরীরে দ্রুত ক্যালরি সরবরাহ হয়। তরকারি, ডাল, সবজি ও ডিম সহকারে ভাত খাওয়া অথবা চাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া হলে তা দ্রুত শরীরের ওজন বাড়াতে সাহায্য করবে। 

ডায়াবেটিস আক্রান্ত না হলে তাদের জন্য ওজন বাড়াতে প্রচুর পরিমাণে ভাত খাওয়া যেতে পারে। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বেশি ভাত খাওয়া যাবে না। কারণ এতে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যাবে।

৩. আলু 

সবচেয়ে সহজলভ্য একটি সবজি হচ্ছে আলু যা বিভিন্ন তরকারিতে যোগ করা ছাড়াও সহজেই ভর্তা বানিয়ে খাওয়া যায়। আলু থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট সহ শরীরের জন্য উপকারী ফাইবার ও মিনারেলস পাওয়া যায়।

আলুর আরেকটি ধরন রয়েছে যা তরকারি হিসেবে নয় বরং সিদ্ধ করে সরাসরি খাওয়া যায়। এটিকে মিষ্টি আলু (Sweet potato) বলা হয় যা প্রচুর পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট সহ বিভিন্ন পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হয়ে থাকে। মিষ্টি আলু শরীরের ওজন বাড়াতে এবং বিভিন্ন জটিল রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে থাকে।

৪. ফল

ওজন বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার হচ্ছে ফল ও ফলের রস। ফলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফ্রুক্টোজ (Fructose) থাকে যা দ্রুত ক্যালরি সরবরাহ করে এবং ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। ফল খেতে পছন্দ না করলে ফলের জুস বানিয়ে খাওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্যালরি সম্পন্ন ফল হলো পাকা কলা, অ্যাভোকাডো, নারিকেল, আম, আঙ্গুর, আপেল, খেজুর, কিসমিস ইত্যাদি। 

৫. দুধ

দুধ খুব পুষ্টিকর একটি খাবার যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি রয়েছে। শরীরের ওজন বাড়াতে বিশেষ করে পেশি বৃদ্ধিতে দুধ পান করা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন সকালে অথবা রাতে ১-২ কাপ দুধ পানের অভ্যাস করা ভালো। এক কাপ দুধে ১৫৯ ক্যালরি থাকে।

দুধ খেলে যাদের পেটে সমস্যা হয় অর্থাৎ ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সআইবিএস রোগীদের জন্য দুধ পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে বাজারে পাওয়া ল্যাকটোজ ফ্রি (Lactose free) দুধ পান করা যাবে।

৬. পনির (Cheese)

ওজন বাড়ানোর জন্য পনির বেশ কার্যকর। পনিরে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ফ্যাট ও ক্যালসিয়াম রয়েছে। ১ আউন্স (২৮ গ্রাম) পনির থেকে ১১০ ক্যালরি পাওয়া যায়। 

যাদের উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও হার্টের রোগের ঝুঁকি রয়েছে তাদের জন্য পনির খাওয়া উচিত নয়। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট রয়েছে যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।

৭. ডিম

ডিম খুব সহজলভ্য এবং পছন্দের একটি খাবার যার মধ্যে ভালো মানের প্রোটিন, ভিটামিন ডি, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড ইত্যাদি রয়েছে। ডিম সিদ্ধ করে খেলে সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৭ টি পর্যন্ত ডিম খাওয়া যাবে এবং এতে হার্টের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। 

৮. দই

দই খুব পুষ্টিকর খাবার যা থেকে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি পাওয়া যায়। দই খাওয়ার ফলে পরিপাকতন্ত্রে থাকা শরীরের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে যায়। তাই প্রতিদিনের খাবার তালিকায় দই রাখা ভালো।

৯. বাদাম ও বাদামের মাখন 

বাদাম সবচেয়ে পুষ্টিকর খাবার যার মধ্যে উপকারী ফ্যাট (মনোআনস্যাচুরেটেড ও পলিআনস্যাচুরেটেড), এন্টি অক্সিডেন্ট, ভিটামিন ই, ফাইবার ইত্যাদি রয়েছে। বাদামের অনেক ধরন রয়েছে। যেমনঃ চিনা বাদাম, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, আখরোট ইত্যাদি। সবধরনের বাদাম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন তবে সবচেয়ে সহজলভ্য হলো চিনা বাদাম। 

কাঠবাদামের অসাধারণ ৩৫ টি উপকারিতা জানতে পড়ুন

দোকানে বাদামের মাখন কিনতে পাওয়া যায়। চাইলে চিনা বাদাম পিষে পেস্ট বানানো যায়। প্রতিদিন খাবারের তালিকায় বাদাম অথবা বাদামের মাখন রাখলে ওজন বৃদ্ধি পাবে। 

 

১০. লাল মাংস 

লাল মাংস প্রোটিনের খুব ভালো উৎস যা শরীরের ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। আর চর্বিযুক্ত মাংস থেকে সবচেয়ে বেশি ক্যালরি পাওয়া যায়। 

হার্টের রোগের ঝুঁকি না থাকলে তাদের ক্ষেত্রে শরীরের ওজন বাড়াতে মাংস খাওয়া যেতে পারে। তবে বয়স্কদের জন্য লাল মাংস ও চর্বি যতটা সম্ভব কম খেতে হবে।

মুরগির মাংস খাওয়া প্রায় সবার জন্যই নিরাপদ হবে। প্রতি ১০০ গ্রাম মুরগির মাংসে ১৬৫ ক্যালরি রয়েছে যা শরীরের ওজন বাড়াতে সাহায্য করবে। 

১১. মাছ

স্বাস্থ্যকর প্রোটিন ও শরীরের জন্য উপকারী ফ্যাট তথা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিডের খুব ভালো একটি উৎস হলো মাছ। এছাড়াও মাছ থেকে ভিটামিন ও‌ মিনারেলস পাওয়া যায় যা শরীরের জন্য খুব উপকারী ভূমিকা রাখে। মাছের ধরন অনুযায়ী ক্যালোরির পরিমাণ ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমনঃ ১০০ গ্রাম টুনা মাছ থেকে ১০৯ ক্যালোরি পাওয়া যায়। আবার চর্বিযুক্ত মাছে তুলনামূলক বেশি ক্যালোরি থাকে।

যাদের নিয়মিত মাছ খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। আর তাই সপ্তাহে অন্তত ২ দিন মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। 

১২. অ্যাভোকেডো (Avocado)

অ্যাভোকাডোতে প্রচুর পরিমাণে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট রয়েছে আর ফ্যাট থেকে সবচেয়ে বেশি ক্যালরি পাওয়া যায়। প্রতি ১ গ্রাম ফ্যাট ৯ ক্যালরি সরবরাহ করে। একটি বড় সাইজের অ্যাভোকাডোতে ৩২২ ক্যালরি রয়েছে। এছাড়াও এতে শরীরের জন্য উপকারী বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলস রয়েছে।

১৩. কালো চকলেট

ডার্ক চকোলেট উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত একটি খাবার যার প্রতি ১০০ গ্রামে ৬০০ ক্যালরি রয়েছে। তবে প্রতিদিন এতো বেশি পরিমাণে ডার্ক চকোলেট খাওয়া যাবে না।‌ বরং শরীরের ওজন বাড়াতে স্ন্যাকস হিসেবে অল্প পরিমাণে ডার্ক চকোলেট খেতে হবে। ক্যালরি ছাড়াও এতে প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট (Antioxidants) রয়েছে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। 

১৪. হোলগ্রেইন ব্রেড (Whole Grain Bread)

হোল গ্রেইন বলতে আস্ত শস্যদানা বোঝানো হয়। যেমনঃ গম, ভুট্টা ইত্যাদি। এগুলো খেতে খুব বেশি সুস্বাদু না হলেও শরীরের জন্য উপকারী। কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার সমৃদ্ধ হোল গ্রেইন ব্রেড এর সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি, মাংস, ডিম, পনির ইত্যাদি খেলে তা শরীরের ওজন বাড়াতে সহায়তা করবে।

১৫. স্বাস্থ্যকর সিরিয়াল 

ওটস, ওটমিল ইত্যাদি দুধ এবং বিভিন্ন ফলের সাথে খাওয়া যায় যা দেহের ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। প্রতিদিন সকাল বা বিকালের নাস্তায় এটি রাখা যেতে পারে। 

১৬. প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট 

বাজারে বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট কিনতে পাওয়া যায় যা শরীরের ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তবে স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় একজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত।

১৭. স্বাস্থ্যকর চর্বি ও তেল

নারিকেল তেল, অ্যাভোকাডো তেল, এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে চর্বি রয়েছে। চর্বি হলো ক্যালোরির সবচেয়ে ভালো উৎস। প্রতিদিন খাবারে তেল ব্যবহার করলে দ্রুত ওজন বৃদ্ধি পাবে।

ওজন বাড়ানোর টিপস  

খাবারের পাশাপাশি কিছু কৌশল অবলম্বন করা উচিত যা শরীরের ওজন বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। যেমনঃ (Gunnars, 2022) 

  • প্রয়োজনের চেয়ে কিছুটা বেশি ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। 
  • একবারে বেশি খাবার খেতে না চাইলে দিনে ৫-৬ বার খাবার খান।
  • খাবারে বেশি পরিমাণে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য রাখবেন।
  • ব্যায়াম করতে হবে। ব্যায়াম করলে ক্ষুধা পাবে এবং হজমে সাহায্য করে।
  • খাবার খাওয়ার আগে পানি পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। 
  • স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস খাওয়া যাবে তবে ফাস্টফুড বর্জন করতে হবে।
  • ধুমপানের অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে।
  • প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে। 

শরীরের ওজন কম থাকার সাথে কোনো রোগ (ইটিং ডিজঅর্ডার, থাইরয়েডের রোগ, ইনফেকশন, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি) সম্পর্কিত থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী।

References

Gunnars K. (2022,7 June) How to Gain Weight Fast: Tips to Be Safe and Healthy. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/how-to-gain-weight

Mawer, R. (2020, November 05). The 18 Best Healthy Foods to Gain Weight Fast. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/18-foods-to-gain-weight

Last Updated on October 16, 2023