স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। কিন্তু বয়স এবং উচ্চতা অনুযায়ী আমাদের শরীরের ওজন যখন কিছুটা বেশী হয়ে যায় তখন নানা দূর্ভোগ পোহাতে হয়। এ বাড়তি মেদ আমাদের স্বাভাবিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনার পাশাপাশি ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এর মতো বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তখন আমরা এই বাড়তি মেদ বা দ্রুত চিকন হওয়ার উপায় খুঁজি। অনেকে দ্রুত ওজন কমাতে গিয়ে সঠিকভাবে না জেনেই বিভিন্ন ভুল পদ্ধতি অনুসরণ করেন, যা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।

 

৭ দিনে ওজন কমানোর ডায়েট চার্ট

 

দ্রুত চিকন হওয়ার উপায় – শসা খেয়ে ওজন কমানোর উপায় আমাদের দেশে বেশ সুপরিচিত। কিন্তু আমরা অনেক সময় সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এই পদ্ধতিতে ওজন কমানোর চেষ্টা করে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে ফেলি। আপনি কি জানেন? স্বাস্থ্যসম্মতভাবে একটি সঠিক ডায়েট চার্ট মেনে চলে মাত্র ৭-১৪ দিনেই ৭-১০ কেজি ওজন কমানো সম্ভব। তাই এই আর্টিকেলে আমরা কিউকাম্বার ডায়েটের সকল দিক বিশদভাবে আলোচনা করব এবং ৭ দিনের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ পুষ্টিসমৃদ্ধ ডায়েট চার্ট প্রদান করব।

কিউকাম্বার ডায়েট কি?

শসা একটি অতি প্রচলিত সবজি যার রয়েছে চর্বি কমানোর প্রয়োজনীয় সকল গুণাগুণ। এ কারণেই কিউকাম্বার ডায়েট দ্রুত ওজন কমানোর একটি উপায় যার ফলে মাত্র ৭ দিনেই ৭-১০ কেজি ওজন হ্রাস করা সম্ভব। এই ডায়েটের প্রধান উপকরণ হলো শসা যা প্রতিবেলার খাদ্য তালিকায় অন্যান্য খাবারের সাথে (বিশেষ করে প্রোটিন সমৃদ্ধ) অন্তর্ভুক্ত থাকে।

ওজন কমানোর খাদ্য তালিকায় বেশিরভাগ খাবারের পরিবর্তে শসা রাখা হয়, সেই সাথে উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্যসহ (মাছ, মাংস, ডিম, বিভিন্ন বাদাম/বীজ ইত্যাদি), ভিটামিন, খনিজের মত অন্যান্য খাদ্য উপাদান সীমিত পরিমাণে রাখা হয়। বলা যায়, একটা নির্দিষ্ট খাদ্য তালিকা মেনে চলে খুব দ্রুত চিকন হওয়ার উপায় হলো এই কিউকাম্বার ডায়েট।

ডায়েটের নিয়ম

ডায়েট শব্দটি শুনলে আমাদের অনেকের মাথায় আসে, না খেয়ে ওজন কমানো। কিন্তু এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। না খেয়ে কখনই স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ওজন কমানো সম্ভব নয় বরং সঠিক ও পরিমিত খাদ্যাভ্যাস ওজন কমাতে অধিক সহায়ক।

এই ডায়েটের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই তবে বয়স, ওজন ও পুষ্টি চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সার্বজনীন কিছু বিষয় লক্ষণীয়। যখনই আপনি ক্ষুধার্ত অনুভব করবেন তখনই শসা খেয়ে নিতে পারেন। যেহেতু শসা অতি কম ক্যালরিযুক্ত, তাই যত ইচ্ছা তত খাওয়া যাবে। তবে ক্যালরি কম হওয়ার সাথে সাথে এর পুষ্টিমানও অনেক কম।

শসায় প্রোটিন ও ফাইবারের পরিমাণ অত্যন্ত কম যা দেহের গঠন (চামড়া, পেশি, হাঁড়, চুল) ও হজমের প্রধান সহায়ক। তাই প্রতিবেলার খাবারে ডিম, মুরগি, মাছ, শাক-সবজি ও কম কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার পরিপূরক হিসেবে রাখতে হবে।

  • শসার পুষ্টিমান

মাঝারি আকারের একটি শসায় প্রায় ৩০ ক্যালরি রয়েছে। এতে রয়েছে কিছু ভিটামিন, খনিজ, ৯৫% পানি ও বিশেষ কিছু ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট (উদ্ভিদের রাসায়নিক পদার্থ) যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 

ক্যালরি হিসাবঃ প্রতি ১০০ গ্রামে

  • কার্বোহাইড্রেট: ২.২%
  • প্রোটিন: ০.৬%
  •  ফ্যাট: ০.১%
  • আঁশ (ফাইবার): ০.৭ গ্রাম
  • থায়ামিন: ০.০৩১ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন সি: ৩.২ মিলিগ্রাম
  •  ভিটামিন কে: ৭২ মিলিগ্রাম
  • পটাসিয়াম: ১২% (প্রতিদিনের চাহিদার)
  •  ম্যাগনেসিয়াম: ৯% (প্রতিদিনের চাহিদার)
  • ম্যাঙ্গানিজ: ৯% (প্রতিদিনের চাহিদার)

ওজন কমাতে কিউকাম্বার ডায়েট কতটা কার্যকরী?

শরীরের বাড়তি মেদ তথা ওজন কমাতে পানির কোনো বিকল্প নেই। শুধু তাই নয় কতগুলো ভিটামিন, খনিজ লবণও দ্রুত ওজন কমানোর পুষ্টি উপাদান হিসেবে পরিক্ষিত।

ওজন কমানোর ডায়েট চার্ট এর পুষ্টি উপাদান (কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট) সীমিত করার মাধ্যমে ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে আনা; কিউকাম্বার ডায়েটও ঠিক এই নীতির আওতাভুক্ত।

এই ডায়েটের বেশিরভাগ অংশই পানি। শসার সাথে আরো খাদ্য উপাদান যুক্ত করে এই ওজন কমানোর খাদ্য তালিকা তৈরি করা হয়, তাই এতে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় ভিটামিন যেমন ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি, ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, নায়াসিন), খনিজ লবণ (ম্যাগনেসিয়াম, জিংক), ডায়েটারি ফাইবার ইত্যাদি থাকে।

স্থূল মানুষের দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির (১২০০ ক্যালরি) তুলনায় এই খাদ্য তালিকা অনেক কম ক্যালরি প্রদান করে যার ফলে ওজন দ্রুত হ্রাস পায়। প্রায় ৩০০ গ্রাম শসা থেকে মাত্র ৪৫ ক্যালরি পাওয়া যায়। এরকম ৬-১০ টি শসা একদিনে সর্বোচ্চ ২৭০-৪৫০ ক্যালরি প্রদান করে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিদিন ৮০০ ক্যালরির নিচে গ্রহণ করা স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী নয়।

সুতরাং ব্যক্তিভেদে ৭ দিনে ৭-১০ কেজি ওজন কমানোর উপায় বলে বিবেচিত এই কিউকাম্বার ডায়েট অধিক কার্যকরী বলেই প্রমাণিত।

 

Cucumber Diet

কিউকাম্বার ডায়েট কিভাবে ওজন কমায়

দেহের অতিরিক্ত ক্যালরি পোড়ানোর মাধ্যমেই মূলত এই ডায়েট কাজ করে। শসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পানি যা খাদ্য হজমে সহায়তা করে দেহে চর্বি জমতে দেয়না। এছাড়া পানি ১০০% ওজন কমাতে সহায়ক।

এছাড়াও কম ক্যালরি গ্রহণের ফলে দেহে চর্বি আকারে জমাকৃত ক্যালরি খরচ হতে থাকে। যেহেতু এই ডায়েটে প্রধান ৩ টি খাদ্য উপাদান কম তাই প্রচুর শসা খাওয়ার পরেও ক্যালরি ঘাটতি রয়ে যায়, যার ফলে দ্রুত ওজন কমতে থাকে।

  • পর্যাপ্ত হাইড্রেশন

শসায় অধিক পরিমাণ পানি এবং বিভিন্ন খনিজ লবণ থাকার কারনে কায়িক শ্রম, ব্যায়াম কিংবা উষ্ণ আবহাওয়ায় আমাদের পানিশূন্যতা (dehydrated) হওয়া থেকে প্রতিরোধ করে।

  • দ্রুত চর্বি কমায়

শসায় কোনো ফ্যাট নেই, অল্প পরিমাণ ক্যালরি থাকে বলে এটি খুব তাড়াতাড়ি চিকন হওয়ার উপায় হিসেবে বিবেচিত। তাই শসার সাথে একটি নির্দিষ্ট খাদ্যাভাস অনুসরণ করে মাত্র ৭ দিনেই শরীরের অতিরিক্ত চর্বির অনেকটা কমিয়ে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়।

  • কম ক্যালরীযুক্ত

বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ অনুযায়ী ৫০০-৭৫০ ক্যালরির ডায়েট চর্বি কমানোর উপায় হিসেবে উপযোগী। এই ডায়েটের ক্যালরির পরিমাণও খুব কম হওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি ওজন হ্রাস পায়।

  • এন্টিঅক্সিডেন্ট এর খোরাক

শসায় বিভিন্ন ধরনের এন্টিঅক্সিডেন্ট যেমনঃ ট্যানিনস (Tannins), ফ্লেভোনয়েডস (Flavonoids) থাকে। এ সকল এন্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে ক্ষতিকারক ফ্রির‍্যাডিক্যাল অপসারন করে এবং দীর্ঘমেয়াদী রোগ যেমনঃ ক্যান্সার, হৃদযন্ত্র এবং কিডনীর রোগের ঝুঁকি কমায়।

  • প্রয়োজনীয় ভিটামিন যোগায়

শসায় বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি যেমন ভিটামিন এ, ডি, কে এবং ভিটামিন ই ইত্যাদি থাকে। এই ভিটামিনগুলো আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যার একটা বড় অংশ শসা খেয়ে যোগান দেওয়া সম্ভব।

  • দূষিত পদার্থ দূর করে

আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে প্রতিদিন ই নানা ধরনের দূষিত পদার্থ বাহিরে থেকে প্রবেশ করে কিংবা ভেতরে তৈরি হয়। এই ডায়েট অনুসরণ করে এই সকল দূষিত পদার্থ শরীর থেকে কমিয়ে আনা সম্ভব।

কিউকাম্বার ডায়েটের অসুবিধা

এই ডায়েট অনুসরণ করার পূর্বে কিছু নেতিবাচক দিক আপনাকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। সব জেনে-শুনে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সিন্ধান্ত নিতে হবে এই কিউকাম্বার ডায়েট আপনার জন্য উপযোগী হবে কিনা।

  • একচেটিয়া খাদ্যাভ্যাস

এই পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে আপনি একটি নতুন খাদ্যাভাসে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। আপনার এই খাদ্য তালিকা পরিবর্তনের কারণে অন্য খাবার গুলোর প্রতি অনীহা ও সবসময় ক্ষুধার্ত অনুভব করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও এই ওজন কমানোর খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন একইরকম খাবার বারবার খেতে হয় বলে অনেকে বেশিদিন এই ডায়েট মেনে চলতে পারেন না।

  • কম পুষ্টিমান সম্পন্ন

কিউকাম্বার ডায়েট পযার্প্ত পানির যোগান দিলেও এতে প্রোটিনের পরিমাণ খুবই কম। আমাদের প্রতিদিন ই প্রোটিন ও ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। কারণ এই প্রোটিন আমাদের শরীরে এনজাইম, হরমোন, ত্বক ও পেশীর গাঠনিক অবস্থা ঠিক রাখতে সহায়তা করে।

অন্যদিকে ফ্যাট দেহের স্নায়বিক কাজ সচল রাখে, ব্রেইনের কর্মক্ষমতা ঠিক রাখে এবং বিভিন্ন ভিটামিন (এ, ডি, ই, কে) এর চাহিদা পূরণ করে। তাই কিউকাম্বার ডায়েটে শসার সাথে অবশ্যই পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার রাখা উচিত। ব্যাক্তিভেদে এর পরিমাণের কিছুটা তারতম্য হতে পারে।

  • অস্থায়ী সমাধান

কিউকাম্বার ডায়েট চিকন হওয়ার একটি অন্যতম উপায় হলেও, এই ডায়েট ২ সপ্তাহের বেশি চালিয়ে যাওয়া উচিত নয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা স্বল্প ক্যালরির ডায়েট থেকে পুনরায় পূর্বের খাদ্যাভ্যাসে ফিরে আসেন, তারা তাদের কমিয়ে ফেলা ওজন ফিরে পেতে শুরু করেন।

মনে রাখতে হবে, ওজন কমানোর পর পরিবর্তিত ওজন ধরে রাখা অনেক জরুরি। এই ডায়েট দ্রুত ওজন কমানোর উপায় হলেও, এটি ওজন নিয়ন্ত্রণের কোনো স্থায়ী সমাধান নয়।

কিউকাম্বার ডায়েটে যা খাওয়া যাবে

এই ডায়েট চলাকালীন সময়ে প্রতিবেলার খাবার ও নাস্তায় শসা আবশ্যক। যে কোনো সালাদ অথবা ফ্রেশ পানীয় তৈরি করেও খেতে পারেন। শসা যেহেতু খুব কম ক্যালরি সম্পন্ন, তাই প্রয়োজনীয় ম্যাক্রো ও মাইক্রো উপাদানগুলোর যোগান দিতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের উৎস যোগ করতে হবে।

নিচে এর একটি তালিকা দেওয়া হলো-

  • প্রোটিনঃ মুরগী, ডিম, চর্বিহীন গরুর মাংস, মাছ, কম ফ্যাটযুক্ত পনির (Cottage cheese, Cheddar cheese, Ricotta, Mozzarella etc), টকদই, বাদাম, বীজ।
  • কার্বোহাইড্রেটঃ ব্রাউন রাইস, আলু, আটার রুটি।
  • ফ্যাটঃ অলিভ অয়েল, ক্যানোলা তেল।
  • ভিটামিন ও খনিজঃ শসা, পালংশাক, টমেটো, পাথুনি শাক (Celery), বাঁধাকপি, কিউই (Kiwi), সবুজ আপেল ও অন্যান্য কম ক্যালরিযুক্ত শাক-সবজী ও ফল।
  • পানীয়ঃ গ্রীণ টি, পানি।

 

কিউকাম্বার ডায়েটে যা পরিহার করতে হবে

যদিও এই ডায়েটে কি কি খেতে পারবেন না এমন কোনো বাধা-ধরা নিয়ম নেই, তবে কিছু নির্দিষ্ট খাবার পরিহার করে সল্প সময়ে অধিক ফলাফল পেতে পারেনঃ

  • ফলঃ ফল খাওয়া আগের তুলনায় যতটুকু পারা যায় কমাতে হবে। একদম বাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
  • ফাস্টফুড কিংবা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যঃ এসব খাবার এমনিতেই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এই ডায়েটের সময় পারলে এইসব খাবার পুরোপুরি বর্জন করুন।
  • বেশী চিনিযুক্ত খাবারঃ মিষ্টি, বিভিন্ন ধরনের ডেজার্ট আপাতত পরিহার করাই উত্তম।

 

আপনি যদি কিভাবে ওজন কমানো যায় এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন এবং খুব তাড়াতাড়ি এই সমস্যার সমাধান পেতে চান, তবে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কিউকাম্বার ডায়েট অনুসরণ করতে পারেন। যদিও এই ডায়েট স্থায়ী সমাধান নয়, তবুও মাত্র ৭ দিনে দ্রুত চিকন হওয়ার উপায় হিসেবে এই পদ্ধতি খুবই ফলপ্রসু। শরীরের যেকোনো জটিলতা এড়াতে বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ গ্রহণ করার পরামর্শ রইল।

 

 

তথ্য সূত্র

EMEDICINE HEALTH 

HEALTH LINE

WebMD

FITNESS HEALTH FOREVER

BETTER ME

Last Updated on May 24, 2023

Was this article helpful?
YesNo