ঢেঁড়স অতি পরিচিত এবং অনেকের খুব পছন্দের সবজি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবজিটি খুবই সহজলভ্য। এছাড়াও এটি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং সুস্বাদু একটি সবজি। ডায়াবেটিসে ঢেঁড়স এর উপকারিতা সর্বজন স্বীকৃত। শুধু রান্না কিংবা খাওয়ার কাজে নয়, এই সবজিটি অনেক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রাকৃতিক সমাধানের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

তাহলে চলুন এই অনুচ্ছেদ থেকে ঢেঁড়সের ১০ টি বিষ্ময়কর উপকারিতা সম্পর্কে জানা যাক। এছাড়াও কাদের জন্য ঢেঁড়স খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা অনুচ্ছেদের শেষের দিকে তুলে ধরা হয়েছে।

ঢেঁড়স খাওয়ার উপকারিতা

ঢেঁড়সের মধ্যে শর্করা, ফাইবার, মিনারেলস, ভিটামিন, পানি ও সামান্য পরিমাণে প্রোটিন সহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক উপাদান (Phytochemicals) তথা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। নিয়মিত ঢেঁড়স খাওয়ার মাধ্যমে আপনার শরীরে যে সমস্ত উপকারিতা বয়ে আনতে পারে তা হলো:

১। ডায়াবেটিসে ঢেঁড়স এর উপকারিতা (Blood sugar কমায়)

Blood sugar কমায় বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে

‘জার্নাল অফ ফার্মাসি অ্যান্ড বায়োলিয়েড সায়েন্স’ এ প্রকাশিত সমীক্ষায় একটি এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে বলা হয়েছে, যেখানে ডায়াবেটিস আক্রান্ত কয়েকটি ইঁদুরকে ঢেঁড়স খেতে দেওয়া হয়েছিলো এবং লক্ষ্য করা গেল যে এতে ইঁদুরগুলোর রক্তে শর্করার মাত্রা এবং লিপিড প্রোফাইলের স্তরগুলি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল।

সুতরাং, এ থেকে বুঝা যায় যে, ঢেঁড়স ডায়াবেটিসের বিকল্প চিকিৎসা হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ইতিমধ্যেই বিকল্প ধারার বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতিতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ঢেঁড়সের ব্যবহার হচ্ছে। তবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ঢেঁড়সের নির্ভরযোগ্য ব্যবহারের জন্য আরো বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য ওষুধের পাশাপাশি সহায়ক উপাদান হিসেবে ঢেঁড়স বেশ উপকারি ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ এতে বিদ্যমান ফাইবার রক্তে সুগার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।  এবং সেই সাথে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার সাথে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকার বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করা হয়। (Watson, 2019)

২। ঢেঁড়স কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে 

কোষ্টকাঠিন্য খুবই বিরক্তিকর একটি সমস্যা যার ফলে যন্ত্রণাদায়ক পাইলস (Hemorrhoids) পর্যন্তও হতে পারে। অনেকেই কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ইসবগুলের ভুষি খেয়ে থাকেন যা বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে। কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রতিকার অথবা প্রতিরোধে ঢেঁড়স অনেকটাই ইসবগুলের ভুষির মতো কাজ করবে। কারণ এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ এবং mucilage নামক থকথকে জেলির মতো পদার্থ। আপনি হয়তো লক্ষ করে দেখে থাকবেন যে, ইসবগুলের ভুষি পানিতে ভিজিয়ে রাখলে যেমন থকথকে আঠালো পদার্থ জমা হয় তেমনি ঢেঁড়সের মধ্যেও এই পদার্থটি রয়েছে যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বিশেষ ভাবে সহায়তা করে থাকে।

৩। ঢেঁড়স শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করে 

ঢেঁড়স শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করে 

ঢেঁড়সের মধ্যে‌ বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকলেও ক্যালরির পরিমাণ খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্রের Department of Agriculture (USDA) এর তথ্য অনুযায়ী প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেঁড়স থেকে মাত্র ৩৩ ক্যালরি পাওয়া যায়। সুতরাং যারা ডায়েট কন্ট্রোল করছেন অর্থাৎ কম পরিমাণে ক্যালরি গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের ওজন কমাতে চাচ্ছেন তাদের জন্য খাদ্য তালিকায় ঢেঁড়স রাখা উচিত। সবজি বা সালাদ হিসেবে খেতে পারেন ঢেঁড়স যা দ্রুত পেট ভরতে সহায়তা করবে। এবং সেই সাথে এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকার দরুন অনেক্ষণ পর্যন্ত পেট ভরা মনে হবে। (Ware, 2019)

৪। ঢেঁড়সে রয়েছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট 

ঢেঁড়স অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এর খুব ভালো একটি উৎস। বিশেষত catechins এবং quercetin নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান গুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং শরীরে রোগ জীবাণুর সংক্রমণ হতে বাঁধা দেয়। সেই সাথে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

৫। ক্যান্সারের চিকিৎসায় ঢেঁড়স 

ঢেঁড়সে প্রচুর পরিমাণে ল্যাকটিন (lectin) থাকে। ল্যাকটিনের পরিমাণ বেশি থাকায় ঢেঁড়সের নির্যাস স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় ব্যবহৃত হয়েছিল। এই গবেষণায় চমৎকার ফলাফল পাওয়া যায় আর তা হলো এই ঢেঁড়সের নির্যাস ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ৬৩ শতাংশ হ্রাস করেছে এবং একই সাথে ৭২ শতাংশ ক্যান্সার কোষ মারা গিয়েছে।

ক্যান্সার চিকিৎসায় সহায়তা করা ছাড়াও ক্যান্সার প্রতিরোধেও ঢেঁড়স বিশেষ ভূমিকা রাখে। ঢেঁড়সে থাকা ফলেট (folate) স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে বলে মনে করা হয়। এছাড়াও ঢেঁড়সের মধ্যে বিদ্যমান প্রচুর পরিমাণে ফাইবার ও প্রদাহ নাশক গুণাবলী কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

৬। খারাপ কোলেস্টেরল কমায় এবং হার্ট ভালো রাখে

আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন এর তথ্য মতে, ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের ফলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL- low density lipoprotein) এর পরিমাণ কমে যায় যা হার্টের রোগের (উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক) ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। আর ঢেঁড়স হলো এমন একটি খাবার যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে এবং সেই সাথে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা কোলেস্টেরল কমায় এবং হার্ট ভালো রাখতে সহায়তা করে।

৭। ঢেঁড়স মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখে 

ঢেঁড়সে প্রচুর পরিমাণে থাকা ফেনোল এবং ফ্ল্যাভোনয়েড হতাশার বিরুদ্ধে লড়াই করে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখে। বর্তমান গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঢেঁড়সের বিচির নির্যাস অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও হতাশার জন্য অনেকটাই প্রতিষেধক ওষুধ হিসেবে কাজ করে। আর তাই হতাশা কাটিয়ে মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতে বেশি বেশি ঢেঁড়স খেতে পারেন।

৮। ঢেঁড়স ফোলেটের ভালো উৎস 

গর্ভাবস্থা এবং শিশুকে বুকের দুধ পান করান এমন মহিলাদের জন্য ফলেট সমৃদ্ধ খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়ার জন্য চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আর ঢেঁড়সের মধ্যে প্রতি ১০০ গ্রামে ৬০ মাইক্রোগ্রাম ফলেট পাওয়া যায় যা একজন গর্ভবতী নারীর দৈনিক চাহিদার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত পূরণ করে।

৯। হাড়ের রোগ (Osteoporosis) প্রতিরোধ করে 

ঢেঁড়সের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে পাওয়া যায় যা হাড়ের গঠন মজবুত করে এবং Osteoporosis এর ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও ঢেঁড়সের মধ্যে হাড়ের জন্য উপকারী অনেক উপাদান রয়েছে। যেমনঃ ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাস।

১০। ঢেঁড়স প্রোটিনের উৎস 

সবজি ও ফলমূল থেকে সাধারণত তেমন প্রোটিন পাওয়া যায় না। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে ঢেঁড়স থেকে পেতে পারেন বেশ ভালো পরিমাণের (প্রতি ১০০ গ্রামে রয়েছে ২ গ্রাম) প্রোটিন। বিশেষত প্রোটিনসমৃদ্ধ প্রাণিজ আমিষ যেখানে দুর্লভ সেখানে সস্তা এবং সহজলভ্য এই খাবারটি উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে।

ঢেঁড়স এর বৈজ্ঞানিক নাম

ঢেঁড়স এর ইংরেজি নাম Okra বা Lady’s finger. আসলে এটি দেখতে অনেকটা মেয়েদের আঙ্গুলের মতো আর তাই এটিকে lady’s fingers বলা হয়ে থাকে। তবে ঢেঁড়সের বৈজ্ঞানিক নাম হলো Abelmoschus esculentus. এই সবজিটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উষ্ণ জলবায়ুতে চাষ করা হয়। শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং বিশ্বের মোটামুটি সব দেশেই এটি পাওয়া যায় এবং খাওয়া হয়ে থাকে। উল্লেখ্য আমাদের দেশ এবং পার্শবর্তী ভারতে এটি ভেন্ডি নামেই বেশি পরিচিত।

ঢেঁড়স কিভাবে খাবেন এবং কাদের জন্য মানতে হবে সতর্কতা?

ঢেঁড়স কিভাবে খাবেন

ঢেঁড়স রোস্ট করে, ভেজে, সেদ্ধ করে এবং ভর্তা করে খাওয়া যায়। ঢেঁড়স কেটে রান্না করলে এটি থেকে একধরনের আঠালো পদার্থ বের হয় যা যেকোনো রেসিপিকে ঘন করে এবং এতে তরকারির স্বাদ বৃদ্ধি পায়। তবে আপনি যদি এই আঠালোভাব পছন্দ না করেন সেক্ষেত্রে এটি শুকিয়েও বিভিন্নভাবে খাওয়ার জন্য ব্যবহার করতে পারেন।

ঢেঁড়স খাওয়ার উপকারিতা জানার পর আবার অতিরিক্ত পরিমাণে ঢেঁড়স খাওয়া যাবে না। কারণ অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে এর মধ্যে থাকা fructans নামক উপাদানের ফলে পেটে গ্যাস, পেট ব্যথা ও ডায়রিয়া হতে পারে। এছাড়াও এতে রয়েছে solanine যা বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা ও প্রদাহ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সতর্কতা

উল্লেখ্য কিডনিতে পাথর হওয়ার ইতিহাস রয়েছে এমন রোগীদের ক্ষেত্রে ঢেঁড়স না‌ খাওয়াই উত্তম। কারণ এদের ক্ষেত্রে ঢেঁড়সে থাকা অক্সালেট (oxalates) কিডনিতে পাথর সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়াও স্ট্রোকের রোগী অথবা রক্তনালীতে অস্বাভাবিক ভাবে রক্ত যেন জমাট না বাঁধে এমন ওষুধ (warfarin, Coumadin) সেবন করেন,‌ তাদের জন্য ঢেঁড়স খাওয়া উচিত নয়। কারণ, ঢেঁড়সে প্রচুর পরিমাণে ‘ভিটামিন কে’ রয়েছে যা রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে।

আশা করা যায়, ঢেঁড়সের উপকারিতা জানার পর অনেকেই এটি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলবেন। তবে মনে রাখবেন, অবশ্যই তা অন্যান্য সবজির মতোই স্বাভাবিক পরিমাণে খেতে হবে। আপনি চাইলে শখের বসে আপনার বাসার ছাদে ঢেঁড়স গাছ লাগাতে পারেন যা আপনাকে পুষ্টিকর এই খাবারটি খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেবে।

 

 

References

Ware, M. (2019, 11 6). Benefits and uses of okra. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/311977

Watson, K. (2019, 5 11). Benefits of Okra for Diabetes. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/diabetes/okra

 

 

Last Updated on April 16, 2023