মেটাবলিজম (Metabolism) হলো খাবার থেকে ক্যালরি উৎপাদন হওয়ার প্রক্রিয়া। জেনেটিক ফ্যাক্টর, শরীরের গঠন, ওজন, বয়স, লিঙ্গ, খাদ্যাভ্যাস ও পরিশ্রমের ধরন অনুযায়ী মেটাবলিজম রেট কম-বেশি হয়ে থাকে। যেমনঃ মহিলাদের তুলনায় পুরুষ মানুষের মেটাবলিজম রেট বেশি থাকে। আবার বয়স্কদের ক্ষেত্রে শরীরের পেশি ক্ষয় হয়ে যাওয়ার ফলে মেটাবলিজম রেট কমে যায়। 

জেনেটিক ফ্যাক্টর, লিঙ্গ ও বয়স নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তবে খাদ্যাভ্যাস ও পরিশ্রমের ধরন পরিবর্তনের মাধ্যমে মেটাবলিজম রেট বাড়ানো সম্ভব। এই অনুচ্ছেদে মেটাবলিজম ত্বরান্বিত করার ৯টি সহজ উপায় বর্ণনা করা হয়েছে।  

কিভাবে মেটাবলিজম আপনার স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে? 

পরিশ্রম ছাড়াও বিশ্রামের সময় শরীরের কার্যক্রম (শ্বাস-প্রশ্বাস, হজম, সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, কোষ বিভাজন, হরমোন নিঃসরণ ইত্যাদি) পরিচালনার জন্য ক্যালরি ব্যয় হয় যাকে BMR (Basal Metabolic Rate) বলা হয়।  

মেটাবলিজম ধীর গতি সম্পন্ন হওয়া মানে কম ক্যালরি খরচ হওয়া যার ফলে শরীরে চর্বি জমা হতে থাকে তথা ওজন বেড়ে যায়। আবার মেটাবলিজম ত্বরান্বিত হলে প্রচুর ক্যালরি খরচ হয় যার ফলে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমা হতে পারে না।‌ 

অতিরিক্ত চর্বি তথা ওজন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে হার্টের রোগ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার সহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। 

মেটাবলিজম ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করা সহ সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।‌    

১। খাবারে প্রচুর প্রোটিন যোগ করুন

খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন জাতীয় খাবার রাখতে হবে যা মেটাবলিজম রেট বাড়িয়ে দেবে। এছাড়াও পেশির গঠন শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে প্রোটিনের ভূমিকা রয়েছে। আর শক্তিশালী পেশীবহুল শরীরে মেটাবলিজম রেট তুলনামূলক বেশি থাকে। (West, 2023) 

স্বাস্থ্যকর প্রোটিন জাতীয় খাবার বলতে মাছ, সামুদ্রিক খাবার (মাছ, চিংড়ি, ঝিনুক, শামুক, অক্টোপাস ইত্যাদি), ডিম, মুরগির মাংস, ডাল, বাদাম, মটরশুটি, শিমের বিচি ইত্যাদি বোঝানো হয়ে থাকে। 

গরুর মাংস প্রোটিন জাতীয় খাবার। তবে প্রচুর ফ্যাট সমৃদ্ধ আর তাই গরুর মাংস বর্জন করতে হবে।  

২। প্রচুর পানি পান করুন  

drink more water

শরীরে‌ পানির ঘাটতি হলে মেটাবলিজম রেট কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা দিনে ৮ গ্লাসের (২ লিটার) বেশি পানি পান করে তাদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি ক্যালরি খরচ হয় অর্থাৎ মেটাবলিজম রেট বেশি থাকে। (Mikstas, 2021) 

দিনে ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করতে হবে। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে। কারণ ফলমূল ও শাকসবজির বেশিরভাগ জুড়ে রয়েছে পানি। যেমনঃ শাকসবজির প্রায় ৯০ শতাংশ হলো পানি। ফলের ক্ষেত্রে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পানি থাকে। (ধরনভেদে পানির পরিমাণ কম-বেশি হয়ে থাকে) 

পানির চাহিদা পূরণের জন্য কোমল পানীয় পান করা যাবে না। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণ চিনি থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয়। এছাড়াও মদ্যপান ও বিয়ার খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করতে হবে। 

৩। হাই ইন্টেনসিটি ওয়ার্কআউট 

হাই ইন্টেনসিটি ওয়ার্কআউট বলতে এমন ধরনের ব্যায়াম বোঝানো হয় যা শরীরের পেশী ও হার্টের কার্যক্রম অনেক বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে মেটাবলিজম রেট বেড়ে যায় এবং প্রচুর ক্যালরি খরচ হতে থাকে। 

দৌড়াদৌড়ি ও সাইক্লিং করা হলো উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ট্রেডমিলে দৌড়ানো উত্তম আর সাইক্লিং এর জন্য বাইসাইকেল বা স্টেশনারি বাইক ব্যবহার করা যেতে পারে। 

হাই ইন্টেনসিটি ওয়ার্কআউট করার সময় নিরাপত্তার বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। শরীরে যেন আঘাত না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং স্পোর্টস জুতা পরিধান করতে হবে।

৪। ভারোত্তোলন ব্যায়াম

ভারোত্তোলন ব্যায়াম করার ফলে পেশির গঠন শক্তিশালী হয় যা মেটাবলিজম রেট বাড়িয়ে দিতে পারে। ভারোত্তোলন করার জন্য ডাম্বেল কিনে বাড়িতেই ব্যায়াম করা যেতে পারে। জিমে যাওয়া আবশ্যক নয়। 

প্রথমদিকে কম ওজন নিয়ে শুরু করতে হবে এবং ধীরে ধীরে ওজন বাড়াতে হবে। কারণ শুরুর দিকে বেশি ওজন নিলে এবং দীর্ঘসময় ধরে ব্যায়াম করলে পেশিতে ব্যথা সহ পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৫। মুভমেন্ট করতে হবে

যারা সারাক্ষণ শুয়ে বসে সময় কাটায় বা অফিসে দীর্ঘসময় ধরে বসে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে মেটাবলিজম রেট কমে যায়। যার ফলে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমা হয় এবং ওজন বেড়ে যেতে থাকে।

তাই মুভমেন্ট করতে হবে। অর্থাৎ কাজের ফাঁকে একটু হাঁটাহাঁটি করতে হবে। আর যারা বাসায় শুয়ে বসে অলস জীবন যাপন করেন তাদের জন্য কায়িক পরিশ্রম এবং নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস করতে হবে। 

৬। গ্রিন টি পান করুন 

গ্রিন টি প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ পানীয় যা পান করার ফলে মেটাবলিজম রেট বেড়ে যায় এবং শরীরে জমে থাকা চর্বি কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

প্রতিদিন ২ থেকে ৪ কাপ গ্রি টি পান করা যেতে পারে। তবে চায়ে চিনি মেশানো যাবে না। 

৭। পর্যাপ্ত ঘুম 

proper sleep

গবেষণায় দেখা গেছে যে, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মেটাবলিজম রেট কমে যায়। এছাড়াও রাতে ভালো ঘুম না হলে ক্ষুধার অনুভূতি বেড়ে যায় এবং অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের প্রবণতা সৃষ্টি হয়। (Nall, 2022) 

একজন মানুষের জন্য দৈনিক নূন্যতম ৭ ঘন্টা ঘুমানো জরুরী। ভালো ঘুম নিশ্চিত করার জন্য প্রতিদিন একই সময়ে বিছানায় যেতে হবে।

৮। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ 

মানসিক চাপের ফলে অতিরিক্ত পরিমাণে কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ হয়। যার ফলে ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া সহ শরীরে চর্বি জমা হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। 

মানসিক চাপ মেটাবলিজম রেট কমানো বা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা রাখে না। তবে ক্ষুধা বাড়ানো ও ঘুমের সমস্যা সৃষ্টির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে মেটাবলিজমের গতি বিঘ্নিত করে। (Nall, 2022)

তাই মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে। ইয়োগা ও মেডিটেশন মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সহায়তা করে। এছাড়াও সাইকোলজিস্টের পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে। 

৯। থাইরয়েডের চিকিৎসা

থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণের মাত্রা কমে গেলে তাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয় যার ফলে মেটাবলিজম রেট কমে যায়। 

হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণগুলো হলোঃ

  • অল্প পরিশ্রমেই ক্লান্তি বোধ  
  • খুব সহজেই ঠান্ডা লাগার প্রবণতা 
  • ত্বক ও চুল রুক্ষ প্রকৃতির হয়ে যায় 
  • ঘুমের সমস্যা হয় অর্থাৎ ভালো ঘুম হয় না
  • মহিলাদের মাসিক অনিয়মিত হয়  

সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তি ও মহিলাদের ক্ষেত্রে থাইরয়েডের সমস্যা হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।  

রক্ত পরীক্ষা (TSH, T4) করার মাধ্যমে হাইপোথাইরয়েডিজম সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানা যায়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য হরমোন বিশেষজ্ঞের নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। 

২টি ইন্টারেস্টিং বিষয়

১। সিগারেট 

সিগারেটে নিকোটিন (Nicotine) থাকে যা মেটাবলিজম রেট কিছুটা বাড়িয়ে দেয়।‌ অর্থাৎ ধুমপান করার ফলে মেটাবলিজম রেট বেড়ে যায়। 

তবে ধুমপানের ক্ষতিকর প্রভাবে হার্টের রোগ, ফুসফুসের রোগ, ইরেকটাইল ডিসফাংশন ও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই মেটাবলিজম রেট‌ বাড়াতে গিয়ে ধুমপান করা যাবে না। 

২। ঝাল খাবার 

ঝাল খাবার খাওয়ার ফলে মেটাবলিজম রেট বেড়ে যায়। আর চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার খেলে মেটাবলিজম রেট কমে যায়। 

ঝাল খাওয়ার তেমন কোনো ক্ষতিকর দিক নেই বললেই চলে। তাই ঝাল যুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে। সালাদের সাথে কাঁচা মরিচ যোগ করা যেতে পারে। 

References

Mikstas, C. (2021, November 04). Slideshow: 10 Ways to Boost Your Metabolism. Retrieved from webMD: https://www.webmd.com/diet/ss/slideshow-boost-your-metabolism

Nall, R. (2022, December 09). How to increase your metabolism. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/323328#reducing-stress

West, H. (2023, July 28). 9 Ways That May Speed Up Your Metabolism. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/10-ways-to-boost-metabolism

Last Updated on January 3, 2024