নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের অভ্যাস বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায় বিশেষ করে হার্টের রোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি। দৈনিক খাদ্য তালিকায় এমন কিছু স্বাস্থ্যকর খাবার থাকা চাই যা পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালরি সরবরাহ করবে এবং সেই সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সহায়তা করবে। এই অনুচ্ছেদে ১০ টি স্বাস্থ্যকর খাবার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে যা সকলের খাওয়া উচিত। (Gunnars, 2022)
Table of Contents
১০ টি স্বাস্থ্যকর খাবার:
ফল (Fruits)
আমাদের দেশে সারাবছরই বিভিন্ন রকমের ফল পাওয়া যায় যা খেতে খুব সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় নূন্যতম ১.৫ থেকে ২ কাপ পরিমাণ ফল থাকা উচিত। ফল থেকে খুব কম পরিমাণ ক্যালরি কিন্তু প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, ভিটামিন, মিনারেলস এবং ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস পাওয়া যায়। বিশেষ করে ভিটামিন ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ফলের মধ্যে খুব সামান্য পরিমাণ ফ্যাট রয়েছে তবে কোনো ক্ষতিকর কোলেস্টেরল নেই। নিয়মিত ফল খেলে তাদের ক্ষেত্রে হার্টের রোগ যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদির ঝুঁকি কম থাকে। তবে মিষ্টি ফলগুলোতে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ থাকে যা ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। আর তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য পরিমিত পরিমাণে ফল খেতে হবে। এছাড়াও সবার জন্যই ফলের জুস বানিয়ে খাওয়ার চেয়ে সরাসরি ফল খাওয়া উত্তম।
শাক-সব্জি (Vegetables)
প্রতিবেলা খাবার প্লেটে অবশ্যই শাকসবজি রাখতে হবে যেন প্রতিদিন কমপক্ষে ২ থেকে ৩ কাপ পরিমাণ শাকসবজি খাওয়া হয়। শুধু একধরনের শাকসবজিতে সব পুষ্টিগুণ পাওয়া যায় না আর তাই বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শাকসবজিতে কম ক্যালরি, ফ্যাট ও প্রোটিন রয়েছে তবে অনেক বেশি পরিমাণে ফাইবার, ভিটামিন, মিনারেলস, এন্টি-অক্সিডেন্ট ইত্যাদি পাওয়া যায়। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি খাওয়ার ফলে হার্টের রোগের ঝুঁকি কমে যায়, ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে, চোখ ভালো রাখে, পরিপাকতন্ত্রের জন্য উপকারী ভূমিকা পালন করে এবং শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে। এছাড়াও শাকসবজি হলো ‘লো-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ফুড’ যা রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় না। রঙ্গিন ও সবুজ শাকসবজি পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে তবে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর জন্য আলু খেতে হবে পরিমিত পরিমাণে। কারণ তা রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।
বাদাম (Nuts)
বাদাম হলো সবধরনের পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি খাবার বিশেষ করে বাদামের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে উপকারী ফ্যাট, ক্যালরি, মিনারেলস ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস রয়েছে। বাদাম খাওয়ার মাধ্যমে যেসব উপকারিতা পাওয়া সম্ভব তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে করে, হার্টের রোগ প্রতিরোধ করে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে, ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে, পুরুষের যৌন সক্ষমতা বাড়ায় ইত্যাদি। বাদামের অসংখ্য ধরন ও প্রকরণ রয়েছে। যেমনঃ কাঠবাদাম, চিনা বাদাম, পেস্তা বাদাম, আখরোট, কাজুবাদাম এবং ব্রাজিল নাট। আমাদের দেশে সবচেয়ে সহজলভ্য বাদাম হলো চিনা বাদাম যা কাঁচা অবস্থায় এবং ভেঁজে খাওয়া যায়। আপনার পছন্দমতো যেকোনো ধরনের বাদাম দৈনিক ১০০ গ্রাম পরিমাণে খেলে উপকার পাওয়া যাবে। তবে কারো ক্ষেত্রে বাদাম খেলে এলার্জি দেখা দিলে তাদের জন্য বাদাম খাওয়া যাবে না।
ডিম (Eggs)
ডিম খেলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাবে এই ভয়ে অনেকেই হয়তো ডিম বর্জন করে থাকেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণায় দেখা গেছে যে, ডিম খাওয়া নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ভূমিকা রাখে। ডিম খেলে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি, প্রোটিন, ভিটামিন ডি, ফলেট, সেলেনিয়াম ইত্যাদি পাওয়া যায় যা শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখে। ডিমের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে কোলাইন (Choline) রয়েছে যা কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ সহ বয়স্কদের স্নায়ুবিক সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে। প্রতিদিন ১ থেকে ২ টি করে ডিম খেতে হবে এবং ডিম তেলে না ভেজে বরং সিদ্ধ করে খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী।
মাংস (Meats)
প্রোটিনের সবচেয়ে ভালো উৎস হলো মাংস আর প্রোটিন শরীরের ক্ষয় পূরণ ও বৃদ্ধি সাধনের জন্য অপরিহার্য উপাদান। মাংস থেকে প্রোটিন ছাড়াও আরো পাওয়া যায় আয়রন, জিংক, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, কোলাইন, ভিটামিন বি এবং ভিটামিন কে। গরু, মুরগি, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি মাংসের জোগান দিয়ে থাকে যার মধ্যে মুরগির মাংস সবচেয়ে সহজলভ্য এবং সবার জন্য উপযোগী। শরীরের শক্তি বাড়ানোর জন্য এবং যাদের রক্তস্বল্পতা রয়েছে তাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে মাংস খেতে হবে। দৈনিক একজন মানুষের জন্য ৫০ থেকে ৭০ গ্রাম মাংস খাওয়া যাবে। তবে যাদের রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি, হার্টের রোগে ভুগছেন অথবা কিডনিতে সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে পরিমিত পরিমাণে মাংস খেতে হবে।
মাছ এবং সামুদ্রিক খাবার (Fish and seafood)
মাছ একাধারে প্রোটিনের ভালো উৎস এবং হার্টের জন্য ক্ষতিকর নয়। বরং মাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় যা হার্টের জন্য খুব উপকারী। সামুদ্রিক খাবারে আয়োডিন সহ শরীরের জন্য উপকারী অনেক উপাদান রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা নিয়মিত সামুদ্রিক খাবার বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ খেয়ে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে হার্টের রোগ, ডিমেনশিয়া, বিষন্নতা সহ অনেক রোগের ঝুঁকি কমে যায় এবং দীর্ঘদিন বেঁচে থাকেন।
শস্য (Grains)
খাবার তালিকার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে শস্যদানা যা কার্বোহাইড্রেটের প্রধান উৎস। আমাদের দেশের প্রধান শস্যদানা হলো ভাত যা আমাদের শরীরের জন্য শক্তি সরবরাহ করে। অধিকাংশ মানুষ তিনবেলা সাদা ভাত খাওয়ার সাথে অভ্যস্ত যা মোটেও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয়। বরং সাদা ভাত হলো হাই-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ফুড যা রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। সাদা চালের ভাতের তুলনায় বাদামী চালের ভাত (Brown Rice) স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এছাড়াও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ, হার্টের রোগ প্রতিরোধ এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। তবে বাদামী চালের ভাত রান্না করতে একটু বেশি সময় লাগে এবং খেতে খুব বেশি সুস্বাদু নয়। ভাতের পরিবর্তে আরেকটি উপকারী শস্যদানা হিসেবে খাওয়া যেতে পারে ওটস (Oats) যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার ও মিনারেলস রয়েছে।
রুটি (Breads)
কার্বোহাইড্রেটের উৎস হিসেবে রুটি একটি জনপ্রিয় খাবার যা সবজি, মাংস অথবা জেলি সহকারে সকাল ও রাতের খাবারে পেতে পছন্দ করেন অনেকেই। স্বাস্থ্যকর রুটি হতে হবে কম ক্যালরি সম্পন্ন ও বেশি পরিমাণে ফাইবার সমৃদ্ধ। লাল আটার রুটি খেতে সুস্বাদু না হলেও শরীরের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী ভূমিকা রাখে। এই রুটি খাওয়ার ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যায় না। তবে বাজারে কিনতে পাওয়া পাউরুটিতে ফাইবার খুব কম থাকে এবং সুগারের মাত্রা বেশি থাকে যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। যারা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান তাদের জন্য দিনে ২ বেলা ভাতের পরিবর্তে আটার রুটি সবজি সহকারে খাওয়া উপকারী হবে। তবে রুটি যেহেতু প্রচুর ফাইবার সমৃদ্ধ একটি খাবার আর তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য (Dairy)
দুধ এবং দুগ্ধজাত বিভিন্ন পণ্য খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি শরীরের জন্য অনেক ক্যালরি সরবরাহ করে। সেই সাথে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম সহ বিভিন্ন খনিজ উপাদান যা শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখে। দুগ্ধজাত খাবার ইয়োগার্ট (Yogurt) মানুষের অন্ত্রে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়ার জন্য উপকারী ভূমিকা পালন করে। তবে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারে অতিরিক্ত পরিমাণে ফ্যাট রয়েছে বলে অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে।
ফ্যাট এবং ওয়েল (Fats and Oils)
ফ্যাট মানেই শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয় বরং ফ্যাটের রয়েছে তিনটি ধরন যার মধ্যে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরের জন্য বেশ উপকারী ভূমিকা রাখে। অলিভ অয়েল, সূর্যমুখী তেল, সরিষার তেল, সয়াবিন তেল সহ উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত ফ্যাট হলো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, দৈনিক ক্যালরি চাহিদার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ফ্যাট থেকে নেওয়া যাবে যার মধ্যে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ ১০ শতাংশের কম এবং ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম হতে হবে। প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবারে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্টফুড, কেক, পেস্ট্রি, মাখন ও পোড়া তেলে ভাজা খাবারে ট্র্যান্স ফ্যাট রয়েছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ পাবলিক হেলথ এর দেওয়া স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিবেলার খাবার প্লেটের অর্ধেক অংশ জুড়ে থাকতে হবে ফলমূল ও শাকসবজি, একচতুর্থাংশ জুড়ে শস্যদানা বা রুটি এবং বাকি অংশে প্রোটিন সহ সামান্য পরিমাণ ফ্যাট থাকবে। সেই সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে এবং সরল শর্করা, ট্র্যান্স ফ্যাট সহ চিনিযুক্ত খাবার যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে।
উপরুক্ত খাবার গুলো ছাড়াও, হার্টের রোগীদের আরো কিছু খাবার নিয়ে সচেতন থাকা উচিত।
References
Gunnars, K. (2022, February 18). 50 Foods That Are Super Healthy. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/50-super-healthy-foods
Last Updated on November 1, 2023
Leave A Comment