রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের (এলডিএল ও ট্রাইগ্লিসারাইড) মাত্রা বেশি থাকলে উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও কিডনির সমস্যা সহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করার মাধ্যমে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়।

লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করার মাধ্যমে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা জানা যায়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা খুব বেশি হলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ সেবন করতে হবে।

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর ১০টি প্রাকৃতিক উপায় জানতে অনুচ্ছেদটি পড়তে থাকুন। 

খাদ্য ও রক্তের কোলেস্টেরলের মধ্যে সম্পর্ক 

কোলেস্টেরল প্রধানত লিভার থেকে উৎপন্ন হয় আবার খাবার থেকেও পাওয়া যায়। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, ডিমের কুসুম, কলিজা, গরুর মাংস, খাসির মাংস, চিংড়ি ইত্যাদি খাবার থেকে কোলেস্টেরল পাওয়া যায়।

শর্করা জাতীয় খাবার (ভাত, রুটি, বিস্কুট, পাউরুটি, নুডুলস ও পাস্তা)‌ শরীরে ক্যালরি সরবরাহ করে। দৈনিক ক্যালরি চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণ করা হলে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যায় যা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল‌ হিসেবে বিবেচিত।  

স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এইচডিএল নামক কোলেস্টেরল বিভিন্ন খাবার গ্রহণের মাধ্যমে বেড়ে যায়। বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট জাতীয় খাবার। যেমনঃ বাদাম, শস্যদানা, অলিভ অয়েল, মাছ, শাকসবজি ইত্যাদি। 

সুতরাং খাবারের সাথে কোলেস্টেরলের যোগসূত্র রয়েছে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবে খাবার ছাড়াও আরো কিছু বিষয়ের সাথে রক্তের কোলেস্টেরল কমা ও বাড়ার সম্পর্ক রয়েছে। যেমনঃ পরিশ্রম, ধুমপান, বয়স, লিঙ্গ, শরীরের ওজন, পারিবারিক ইতিহাস বা জিনগত প্রভাব, বিভিন্ন রোগ ইত্যাদি। 

১। অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট এড়িয়ে চলুন

রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট (স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট) সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ।  

খাদ্যতালিকা থেকে স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার যতটা সম্ভব কমাতে হবে। মুরগির চামড়া, গরুর মাংস, খাসির মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, পাম অয়েল ও নারিকেল তেল হলো স্যাচুরেটেড ফ্যাটের উদাহরণ।  

চিপস, কুকিজ, পোড়া তেলে ভাজা খাবার, মাখন, ফাস্টফুড ইত্যাদি হলো ট্র্যান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার যা একদম বর্জন করা উচিত। 

২। স্বাস্থ্যকর ফ্যাট গ্রহণ করুন 

avoid fast food

ফ্যাট মানেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় এবং খাদ্যতালিকা থেকে ফ্যাট একদম বাদ দেওয়া যাবে না। বরং রক্তে উপকারী কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্যকর ফ্যাট জাতীয় (মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট) খাবার খেতে হবে।

মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট জাতীয় খাবার হলো বিভিন্ন ধরনের বাদাম, অ্যাভোকাডো, তিসি, চিয়া বীজ, অলিভ অয়েল, সূর্যমুখী তেল, সয়াবিন তেল ইত্যাদি।  

ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হলো একটি পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যা মূলত মাছ থেকে পাওয়া যায়। অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের মাছ হলো ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের সবচেয়ে ভালো উৎস। তাই সপ্তাহে অন্তত দুই দিন মাছ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

৩। ফাইবার জাতীয় খাবার খেতে হবে

প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ফাইবার জাতীয় খাবার রাখতে হবে। প্রচুর পরিমাণ ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার হলো লাল আটার রুটি, ওটস, বাদামী চালের ভাত, ফলমূল, শাকসবজি, যবের ছাতু ইত্যাদি। 

সাদা চালের ভাত ও ময়দার তৈরি খাবার যতটা সম্ভব কম খেতে হবে। কারণ এগুলো রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

৪। ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে

ফলমূল ও‌ শাকসবজি থেকে প্রচুর ফাইবার ও এন্টি-অক্সিডেন্ট (Antioxidants) পাওয়া যায় যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ফলমূল ও শাকসবজি রাখতে হবে। 

ফলমূল জুস বানিয়ে না‌ খেয়ে বরং আস্ত খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য মিষ্টিজাতীয় (আম, কাঁঠাল, তরমুজ, আনারস, কলা ও খেজুর) ফল পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে।

শাকসবজি কম সময় রান্না করতে হবে। কারণ অধিক তাপে এন্টি-অক্সিডেন্ট কমে যায়। এছাড়াও শশা, গাজর, টমেটো, কাঁচা পেঁপে, লেটুসপাতা ইত্যাদি সালাদ হিসেবে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। 

৫। নিয়মিত ব্যায়াম করুন 

নিয়মিত ব্যায়াম করার ফলে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায় এবং সেই সাথে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। 

আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্দেশনা হলো রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য সপ্তাহে ১৫০ মিনিট বা প্রতিদিন ৩০ মিনিট সময় (সপ্তাহে ২ দিন বিশ্রাম) ব্যায়াম করতে হবে। (Thorpe, 2023)

হাঁটাহাঁটি করা, দৌড়াদৌড়ি, সাঁতার কাটা, সিঁড়ি বেয়ে উঠা, দড়ি লাফানো, সাইকেল চালানো, ভারোত্তোলন সহ আপনার পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো ধরনের ব্যায়াম করতে পারেন। 

৬। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

healthy food

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রার সাথে শরীরের ওজনের যোগসূত্র রয়েছে। যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি দেখা যায়। তাই শরীরের ওজন কমাতে হবে।

শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য দৈনিক ক্যালরি চাহিদা অনুযায়ী পরিমিত খাবার খেতে হবে। অলস জীবন যাপন পরিহার করতে হবে। অর্থাৎ নিয়মিত ব্যায়াম অথবা কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। 

৭। ধূমপান ও মদ্যপান বর্জন করুন

ধুমপায়ী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হার্টের রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। কারণ ধুমপানের অভ্যাস রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং উপকারী কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। তাই ধুমপানের অভ্যাস বাদ দিতে হবে। 

মদ্যপান রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করতে হবে।

এছাড়াও কোমল পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ কোমল পানীয় রক্তে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

৮। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন

অতিরিক্ত মানসিক চাপ রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে।

ইয়োগা ও মেডিটেশন করা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৯। ভালো ঘুম হওয়া জরুরী

ঘুমের সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের যোগসূত্র রয়েছে। অর্থাৎ ভালো ঘুম না হলে মানসিক চাপ বেড়ে যায়। এছাড়াও রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি এবং উপকারী কোলেস্টেরল কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঘুমের ভূমিকা রয়েছে। 

প্রতিদিন রাতে ৭ থেকে ৯ ঘন্টা ঘুমাতে হবে। ভালো ঘুমের জন্য বিছানা, বালিশ ও ঘরের পরিবেশ আরামদায়ক হতে হবে। যাদের অনিদ্রা সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য রাতে চা ও কফি পান করা যাবে না।

১০। সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন 

রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস এবং ভালো কোলেস্টেরল বৃদ্ধির জন্য সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ইসবগুলের ভুসি অথবা চিয়া বীজ খাওয়া যেতে পারে। (Cleveland Clinic, 2022) 

এই জাতীয় সাপ্লিমেন্ট আমাদের দেশে খুব সহজলভ্য এবং খাওয়ার ফলে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রতিদিন সকালে ও রাতে এক গ্লাস পানিতে ১ থেকে ২ চা চামচ পরিমাণ ইসবগুলের ভুসি অথবা চিয়া বীজ গুলিয়ে খেতে হবে। স্বাদ বৃদ্ধির জন্য চিনি বা মধু যোগ করা যাবে না।

শেষ কথা

কোলেস্টেরলের সঠিক মাত্রা বজায় রাখার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, পরিমিত প্রোটিন ও শর্করা, পর্যাপ্ত ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার ইত্যাদি খেতে হবে। এছাড়াও ধুমপান ও মদ্যপান বর্জন, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। 

Bibliography

Cleveland Clinic. (2022, March 08). How to Naturally Lower Your Cholesterol. Retrieved from Cleveland Clinic: https://health.clevelandclinic.org/from-fiber-to-fish-oil-natural-ways-to-lower-your-cholesterol/

Thorpe, M. (2023, July 13). 10 Natural Ways to Lower Your Cholesterol Levels. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/how-to-lower-cholesterol

Last Updated on January 4, 2024