কফি (Coffee) অভিজাত একটি পানীয় যা সারাবিশ্বে বেশ জনপ্রিয়তার সাথে পান করা হয়ে থাকে। কফির মূল উপাদান হলো ক্যাফেইন (Caffeine) যা স্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্ন উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। আবার অতিরিক্ত পরিমাণে কফি পান করা হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলা সহ ক্যাফেইন আসক্তি (Caffeine addiction) সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কফি কিভাবে মস্তিষ্কের উপর প্রভাব ফেলে, কফি পান কি কি উপকারিতা বয়ে আনতে পারে, কেন ক্যাফেইন আসক্তি হয়, কতটুকু পরিমাণে কফি খাওয়া নিরাপদ ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
কফিতে ক্যাফেইন থাকে
কফির উপকারিতা ও আসক্তির মূল কারণ হলো ক্যাফেইন। কফি ছাড়াও আরো যেসব খাবারে ক্যাফেইন থাকে তা হলো চকলেট, চা, কোমল পানীয় ইত্যাদি। তবে কফিতেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ক্যাফেইন থাকে।
এক কাপ (৮ আউন্স বা ২৪০ মিলিলিটার পরিমাণ) কফিতে ১০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। বিভিন্ন ধরনের কফি রয়েছে এবং কফির ধরন অনুযায়ী ক্যাফেইনের পরিমাণ কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে।
কফি খাওয়ার ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টার মধ্যে রক্তে ক্যাফেইনের মাত্রা সর্বোচ্চ হয়ে যায়। ব্যক্তিভেদে ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৯ ঘন্টা পর্যন্ত শরীরে ক্যাফেইনের প্রভাব থাকে। (Petre, 2017)
আপনার মস্তিষ্কে ক্যাফেইনের প্রভাব
কফি পান করার পর অন্ত্রের (Intestines) মাধ্যমে শোষণ হয়ে রক্তে প্রবাহিত হয়। অতঃপর মস্তিষ্কে পৌঁছালে ক্যাফেইনের প্রভাব শুরু হয়। ক্যাফেইন মূলত কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের উপর কাজ করে থাকে।
পরিশ্রমের (বিশেষ করে মানসিক পরিশ্রম) ফলে মস্তিষ্কে অ্যাডিনোসাইন (Adenosine) নামক উপাদান নিঃসৃত হয় যা ক্লান্তি অনুভূতি সৃষ্টি করে তথা বিশ্রাম নেওয়ার নির্দেশনা প্রধান করে।
কফি খাওয়ার ফলে ক্যাফেইন মস্তিষ্কের অ্যাডিনোসাইনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় তথা ক্লান্তি অনুভূতি প্রতিরোধ করে। সেই সাথে ডোপামিন সহ অন্যান্য আরো কিছু রাসায়নিক উপাদান নিঃসরণ হয় যা নতুন উদ্যমে কাজ করার অনুপ্রেরণা জোগায়।
কফি খাওয়ার ফলে ক্লান্তি দূর হয়, কাজের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি পায়, মেটাবলিক রেট (বিপাক প্রক্রিয়া) বেড়ে যায়, এনার্জি বৃদ্ধি হয় এবং কাজের পারফর্মেন্স বেড়ে যায়।
ক্যাফেইন আসক্তির কারণ
দীর্ঘদিন ধরে কফি খাওয়ার ফলে মস্তিষ্কে অ্যাডিনোসাইন নিঃসরণ বেড়ে যায়। কারণ ক্যাফেইন দ্বারা বার বার অ্যাডিনোসাইনের কার্যকারিতা প্রতিহত হওয়ার ফলে ক্লান্তি অনুভূতি সৃষ্টির জন্য মস্তিষ্ক আরো বেশি অ্যাডিনোসাইন নিঃসরণ করে।
বেশি পরিমাণের অ্যাডিনোসাইন প্রতিহত করার মাধ্যমে ক্লান্তি দূর করার জন্য কফি খাওয়া তথা ক্যাফেইন গ্রহণের চাহিদা বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় কফি পান করা না হলে অতিরিক্ত অ্যাডিনোসাইনের প্রভাবে ক্লান্তি অনেক বেশি অনুভব হয় এবং সেই সাথে আরো কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যায় যাকে ক্যাফেইন আসক্তি বলা হয়। যেমনঃ
- মাথাব্যথা
- ঝিমুনি ভাব
- খিটখিটে মেজাজ
- কাজে মনোযোগ দিতে না পারা
- কোনো কাজ করতে ইচ্ছা না হওয়া
কাজের ফাঁকে কফি খাওয়া হলে কাজের প্রতি মনোযোগ বেড়ে যায়। কাজের গতি বৃদ্ধির তাড়না থেকেও কফির প্রতি আসক্তি হতে পারে।
শুরুর দিকে অল্প পরিমাণে কফি খেয়ে ক্লান্তি দূর করা সম্ভব হলেও সময়ের সাথে সাথে কফি পান করার পরিমাণ বেড়ে যায়। এর কারণ হলো কফি বা ক্যাফেইনের প্রতি ধীরে ধীরে সংবেদনশীলতা কমে যাওয়া।
কখন ক্যাফেইন আসক্তি হয়ে ওঠে?
ঠিক কতটুকু পরিমাণে এবং কতদিন ধরে কফি পান করলে ক্যাফেইন আসক্তি হতে পারে এই বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।
নিয়মিত কফি পান করেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হঠাৎ করে কফি খাওয়া বন্ধ করে দিলে (১২ থেকে ২৪ ঘন্টা পর) যদি অস্বাভাবিক লক্ষণ (মাথাব্যথা, ঝিমুনি ভাব, খিটখিটে মেজাজ, মনোযোগের অভাব ইত্যাদি) দেখা যায় তবে বুঝতে হবে যে ক্যাফেইন আসক্তি হয়েছে।
ক্যাফেইন আসক্তির লক্ষণগুলো কফি না খাওয়ার প্রথম দিকে তীব্র প্রকৃতির হয়ে থাকে। তবে সময়ের সাথে সাথে কমে যায়।
ক্যাফেইন আসক্তি থেকে বাঁচার উপায়
ক্যাফেইন আসক্তি থেকে বাঁচতে নিচে উল্লেখিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। (Brusie, 2017)
- কাজের টেবিলে পানির বোতল ও সুন্দর গ্লাস রাখতে হবে যেন ইচ্ছা হলেই পানি পান করা যায়।
- ক্লান্তি দূর করার জন্য কাজের ফাঁকে একটু হাঁটাহাঁটি করা যেতে পারে বা বিশ্রাম নিতে হবে।
- কফির পরিবর্তে গ্রিন টি খাওয়া যাবে। গ্রিন টিতে প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট থাকে এবং অতি অল্প পরিমাণে ক্যাফেইন থাকে।
- স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস (বাদাম, সূর্যমুখী বীজ ও ফলমূল) খাওয়া কফি আসক্তি দূর করতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে যার ফলে সহজে ক্লান্তি সৃষ্টি হবে না।
কফির স্বাস্থ্য উপকারিতা
পরিমিত পরিমাণে কফি পান করার মাধ্যমে যেসব স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায় তা হলোঃ
- ক্লান্তি দূর করার মাধ্যমে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে।
- মস্তিষ্কের রোগে (আলজেইমার্স ও পারকিনসন ডিজিজ) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে।
- মেটাবলিক রেট বাড়ানোর মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
- হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদির ঝুঁকি হ্রাস করে থাকে।
- শরীরের এনার্জি বুস্ট করে অর্থাৎ কাজের জন্য এনার্জি বেড়ে যায়।
- লিভারের কার্যক্রম ভালো রাখে এবং লিভারের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
- উদ্বিগ্নতা ও বিষন্নতা কমায় এবং মানসিক স্বাস্থ্য (মন) ভালো রাখে।
অতিরিক্ত পরিমাণে কফি পান করার ফলে উপকার না হয়ে বরং অপকার হতে পারে। যেমনঃ ক্ষুধা কমে যাওয়া, হজমের সমস্যা, অনিদ্রা (রাতে ঘুম না পাওয়া) ইত্যাদি।
কফি পান সীমিত হতে হবে
ক্যাফেইন আসক্তি প্রতিরোধ এবং কফির অপকারিতা থেকে বাঁচার জন্য পরিমিত পরিমাণে কফি পান করতে হবে।
দৈনিক ২০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন গ্রহণ করা একদম নিরাপদ হবে। এক কাপ (২৪০ মিলিলিটার পরিমাণ) কফিতে প্রায় ১০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। সেই হিসেবে দিনে ২ কাপ পর্যন্ত কফি পান করা যেতে পারে।
দিনে সর্বোচ্চ ৪০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন (৪ থেকে সর্বোচ্চ ৫ কাপ কফি) গ্রহণ করা যেতে পারে।
গর্ভবতী নারী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য দিনে সর্বোচ্চ ২ কাপের বেশি কফি পান করা যাবে না।
কাদের জন্য কফি খাওয়া যাবে না?
যেসব উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের কফি পান করার অভ্যাস নেই তাদের জন্য কফি খাওয়ার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। তবে নিয়মিত কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তাদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ বেড়ে যায় না।
যাদের রাতে সহজে ঘুম পায় না (অনিদ্রার রোগী) তাদের জন্য কফি খাওয়া যাবে না। একান্তই খেতে চাইলে দিনের বেলায় খেতে হবে। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া যাবে না।
এন্টি-বায়োটিক ওষুধ, থাইরয়েডের সমস্যা দূর করার ওষুধ ও মানসিক রোগ নিরাময়ের ওষুধ সেবন করছেন এমন ব্যক্তিদের জন্য কফি খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কারণ এতে ওষুধের কার্যকারিতা বিঘ্নিত হতে পারে। উল্লেখ্য ভরাপেটে কফি না খেয়ে বরং খাবার খাওয়ার নূন্যতম ৩০ মিনিট পর কফি খেতে হবে।
ক্যাফেইন আসক্তি মারাত্মক কোনো সমস্যা নয়। বরং পরিমিত পরিমাণে কফি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তবে অতিরিক্ত কফি খাওয়া যাবে না। ক্যাফেইন আসক্তি দূর করার জন্য অনুচ্ছেদে উল্লেখিত পদ্ধতিগুলো মেনে চললে উপকার পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
References
Brusie, C. (2017, July 15). What Happens After I Cut Off Caffeine? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/caffeine-withdrawal
Petre, A. (2017, February 19). Can Drinking Coffee Lead to Caffeine Addiction? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/caffeine-addiction
Last Updated on December 21, 2023
Leave A Comment