একজন সচেতন মা হিসেবে শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টিকর খাবার বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা দরকার। শিশুর খাদ্যতালিকায় মাছ রাখার ব্যাপারে মায়েদের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। 

শিশুদের জন্য মাছ খাওয়া কি কি স্বাস্থ্য উপকারিতা বয়ে আনতে পারে, কত বয়স থেকে শিশুদের মাছ খেতে দিতে হবে, কোন কোন মাছ শিশুদের জন্য নিরাপদ হিসেবে গণ্য হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো সহ শিশুদের মাছ খাওয়ানোর ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।   

শিশুকে মাছের সাথে কখন পরিচয় করিয়ে দেবেন? 

জন্মের পর থেকে পরবর্তী ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধ শিশুর সকল পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। যেসব শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণে মায়ের বুকের দুধ খেতে পায় না তাদের জন্য ফর্মুলা দুধ দিতে হয়।

ছয় মাস বয়সের পর থেকে শিশুকে দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার দেওয়া শুরু করতে হবে। অর্থাৎ ছয় মাস বয়সের পর থেকেই শিশুকে মাছ খাওয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে।

প্রথম দিকে শিশু মাছ খেতে অনীহা প্রকাশ করতে পারে। তাই বলে জোরাজুরি করা যাবে না বরং ধীরে ধীরে অল্প পরিমাণে মাছ খেতে দিতে হবে। শিশুর পছন্দ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মাছ দেওয়া যেতে পারে। 

অনেক মায়েদের দেখা যায় শিশুদের ডিম ও মাংস খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন কিন্তু মাছ অবহেলিত থেকে যায়। এটা ঠিক নয় বরং শিশুদেরকে ছোট বেলা থেকেই মাছ খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।  

শিশুদের জন্য মাছের উপকারিতা  

fish-health-benefits-for-kids

মাছ হলো ভালো মানের প্রোটিন ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ফ্যাটের (ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড) একটি দারুন উৎস। এছাড়াও মাছ থেকে বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলস পাওয়া যায়। শিশুদের জন্য মাছ খাওয়ার অভ্যাস যেসব উপকারিতা বয়ে আনতে পারে তা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো। (Landes, 2021)

প্রোটিন সরবরাহ করে

বড়দের তুলনায় শিশুদের ক্ষেত্রে শরীরের ওজন অনুপাতে বেশি প্রোটিন প্রয়োজন হয়।‌ শিশুদের শরীরের গঠন ও বৃদ্ধিতে প্রোটিন জাতীয় খাবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাছ, মাংস, ডিম, ডাল ইত্যাদি হলো প্রোটিন জাতীয় খাবার।  

মস্তিষ্কের জন্য উপকারী 

মাছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে যা শিশুর মস্তিষ্কের গঠন ও বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমনকি শিশু জন্মের আগে থেকেই গর্ভবতী মায়েদের জন্য মাছ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় যেন গর্ভস্থ সন্তানের মস্তিষ্কের গঠন ভালোভাবে হয়। 

দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে 

দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে এবং রাতকানা রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাছ থেকে ভিটামিন এ পাওয়া যায়। তাই শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে খাদ্যতালিকায় মাছ যোগ করতে হবে। 

ভিটামিন ডি এর উৎস 

হাড়ের গঠনের জন্য ক্যালসিয়াম প্রয়োজন হয় যা দুধ থেকে পাওয়া যায়। আর শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য ভিটামিন ডি লাগে।

মাছ থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। এছাড়াও মাঝেমধ্যে শিশুর ত্বকে রোদ (মৃদু রোদ) লাগাতে হবে যেন শরীরে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হতে পারে।   

মিনারেলস সমৃদ্ধ 

মাছে বিভিন্ন ধরনের মিনারেলস (আয়রন, জিংক, আয়োডিন ও সেলিনিয়াম) রয়েছে। এইসব উপাদান শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে। যেমনঃ আয়োডিন থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্রম ভালো রাখে।  

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

মাছে বিদ্যমান ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ও মিনারেলস শিশুর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং সহজে রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেকটাই কমিয়ে দেয়।   

শিশুদের জন্য নিরাপদ মাছ 

শিশুদের জন্য সবধরনের মাছ নিরাপদ খাবার হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ নদী, পুকুর ও সমুদ্রে পাওয়া প্রায় সবধরনের মাছ (ছোট হোক অথবা বড়) শিশুকে খাওয়ানো যাবে।  

সামুদ্রিক মাছে মার্কারী থাকতে পারে যার ফলে শিশুদের জন্য সামুদ্রিক মাছ নিরাপদ বলে মনে করেন না অনেকেই। মার্কারী স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই । 

তবে মাছে থাকা মার্কারীর পরিমাণ খুবই কম। বরং সামুদ্রিক মাছ এতো বেশি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হয়ে থাকে যা মার্কারীর ভয়ে বাদ দেওয়া ঠিক হবে না। (Harvard T.H. Chan, School of Public Health, n.d.) 

সামুদ্রিক মাছ শিশুকে খাওয়ানোর ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই। তবে নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় অতিরিক্ত পরিমাণে খেতে দেওয়া যাবে না। সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২ দিন শিশুকে সামুদ্রিক মাছ খেতে দেওয়া যেতে পারে।

যে মাছ বর্জন করতে হবে 

fishes-to-avoid-for-childern

শিশুদের জন্য বিশেষ কোনো ধরনের মাছ বর্জন করা জরুরী নয়।

তবে কৌটায় রাখা (Canned fish) মাছ না খাওয়ানোই উত্তম। শিশুকে কোনো মাছ খাওয়ানোর ফলে এলার্জি দেখা দিলে সেই মাছ বর্জন করতে হবে।

এলার্জি বোঝার উপায় হলো মাছ খাওয়ানোর পর শিশুর মুখমণ্ডল (ঠোঁট ও জিহ্বা) ফুলে যাওয়া, ত্বকে র‌্যাশ হওয়া, ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, বমি ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।  

সতর্কতা 

মাছ পরিষ্কার করে ধুয়ে ভালোভাবে রান্না করতে হবে। কখনো শিশুকে অর্ধসিদ্ধ মাছ খেতে দেওয়া যাবে না। 

উত্তম ভাবে মাছ রান্না করা না হলে ক্ষতিকর অণুজীব থেকে যেতে পারে যা বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। যেমনঃ টাইফয়েড, কৃমির সংক্রমণ, ডায়রিয়া ইত্যাদি।  

১। রান্না করা মাছ পানিতে ধুয়ে নিলে পুষ্টিগুণ কমে যাবে কি? 

বড়দের জন্য রান্না করা মাছ শিশুকে দিতে চাইলে সেক্ষেত্রে মাছ পানিতে ধুয়ে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কারণ শিশুরা ঝাল খেতে পারে না। তবে পানিতে ধুয়ে নেওয়ার ফলে মাছের পুষ্টিগুণ কমে যায় না। 

২। শিশুকে একই রকমের মাছ বার বার খাওয়ানো যাবে কি?  

শিশুর পছন্দ অনুযায়ী একই রকমের মাছ বার বার খাওয়ানো যাবে। তবে মাছের ধরনভেদে পুষ্টিগুণের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। তাই বৈচিত্র্যময় মাছ (বিভিন্ন ধরনের) খাওয়াতে পারলে ভালো।  

৩। একবারে কতটুকু পরিমাণে মাছ খাওয়াতে হবে? 

শিশু‌ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নিয়ে যতটুকু মাছ খেতে পছন্দ করে ততটুকু খাওয়ানোই উত্তম। একবারে ১ আউন্স (২৮ গ্রাম) মাছ খেতে দেওয়া আদর্শ পরিমাণ হিসেবে ধরা হয়। 

শেষ কথা 

শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত চিপস, কোমল পানীয়, ফাস্টফুড ইত্যাদি খাওয়ার প্রতি ঝোঁক বেশি থাকে। কারণ তারা স্বাস্থ্যকর খাবার কোনটি সেই সম্পর্কে জানে না। বরং দেখতে লোভনীয় বা খেতে মজাদার খাবার খেতে পছন্দ করে। শিশুকে ছোটবেলা থেকেই স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। 

References

Harvard T.H. Chan, School of Public Health. (n.d.). Fish: Friend or Foe? Retrieved from Harvard: https://www.hsph.harvard.edu/nutritionsource/fish/

Landes, E. (2021, August 27). Everything You Need to Know About Introducing Your Baby to Fish. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/fish-for-babies

Last Updated on December 23, 2023