গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ এই সময়ে গর্ভবতী নারীর সুস্থতা এবং গর্ভস্থ শিশুর সঠিক বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজন হয়।
গর্ভবতী নারীদের জন্য যেসব খাবার উপকারী হিসেবে মনে করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো মাছ। তবে গর্ভাবস্থায় মাছ খাওয়ার ব্যাপারে কিছু নিয়ম ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যেই বিষয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
গর্ভবতী নারীদের জন্য মাছ খাওয়া কি কি উপকারিতা বয়ে আনতে পারে, নানা প্রজাতির মাছ রয়েছে যার মধ্যে কোনগুলো খাওয়া যাবে আর কোনগুলো বর্জন করতে হবে সেই বিষয়ে জানতে চাইলে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
মাছের পুষ্টিগত উপকারিতা
প্রোটিনের একটি ভালো উৎস হলো মাছ। কারণ ১০০ গ্রাম মাছ থেকে প্রায় ২০ গ্রাম পরিমাণ প্রোটিন পাওয়া যায়। তবে প্রজাতি ভেদে মাছের পুষ্টিগুণে কিছুটা পার্থক্য হতে পারে। প্রোটিন ছাড়াও মাছ থেকে আরো যেসব পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায় তা হলোঃ
- ফ্যাট বা চর্বি
- আয়োডিন
- সেলেনিয়াম
- ক্যালসিয়াম
- ভিটামিন এ
- ভিটামিন বি৩
- ভিটামিন বি৯
- ভিটামিন বি১২
- ভিটামিন ডি
- ফসফরাস
- কোলাইন
- আয়রন
- জিংক
গর্ভবতী নারীদের জন্য মাছ খাওয়া যেসব উপকারিতা বয়ে আনতে পারে তা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো। (Webster, 2021)
১। প্রোটিন সরবরাহ করে
গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো প্রোটিন। আর মাছ হলো প্রোটিন জাতীয় একটি খাবার। গর্ভস্থ শিশুর সঠিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য একজন গর্ভবতী নারীর দৈনিক কমপক্ষে ৭০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। তবে শুধুমাত্র মাছ থেকে নয়, বরং মুরগির মাংস, ডিম, দুধ, গরুর মাংস, ডাল ইত্যাদি থেকেও প্রোটিন নিতে হবে।
২। উপকারী ফ্যাট সমৃদ্ধ
একজন গর্ভবতী নারীর দৈনিক ক্যালরি চাহিদার ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ ফ্যাট থেকে গ্রহণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। মাছের প্রায় ১০ শতাংশ হলো ফ্যাট। তবে তৈলাক্ত মাছে ফ্যাটের পরিমাণ আরো বেশি থাকে।
গর্ভবতী নারীদের জন্য ফ্যাটের উৎস হিসেবে মাছ খাওয়া উত্তম। কারণ মাছে যে ফ্যাট রয়েছে তা হলো ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega-3 fatty acid) যা গর্ভস্থ বাচ্চার মস্তিষ্ক ও চোখের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও গর্ভকালীন সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ খাওয়া হলে গর্ভকালীন সময়ের আগেই বাচ্চা প্রসব হওয়া এবং কম ওজন নিয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করার ঝুঁকি কম থাকে।
৩। রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে
গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে রক্তস্বল্পতা একটি কমন সমস্যা যার ফলে দুর্বলতা, ক্লান্তি, ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। গর্ভকালীন সময়ে রক্তস্বল্পতা গর্ভস্থ শিশুর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে মাছ খাওয়া উপকারী হতে পারে। কারণ মাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ভিটামিন বি১২ পাওয়া যায় যা লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদনে সাহায্য করে অর্থাৎ রক্তস্বল্পতা দূর করে।
৪। বিষন্নতা দূর করে
গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে বিষন্নতায় ভোগার প্রবণতা দেখা যায়। অনেকের ক্ষেত্রে বাচ্চা প্রসবের পরে মারাত্মক প্রকৃতির বিষন্নতার সৃষ্টি হয় যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় Postpartum depression বলা হয়।
বিষন্নতার ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় এবং বাচ্চার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। নিয়মিত মাছ খাওয়ার অভ্যাস বিষন্নতা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৫। ফলেটের ভালো উৎস
গর্ভবতী মায়েদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো ফলেট (ভিটামিন বি৯) যার একটি ভালো উৎস হলো মাছ। গর্ভাবস্থায় ফোলেটের অভাব হলে গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডের গঠনগত ত্রুটি হতে পারে যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় Neural tube defects বলা হয়। জটিল এই রোগটি প্রতিরোধের জন্য গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলেট সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
গর্ভাবস্থায় শুধুমাত্র খাবার থেকে ফলেটের দৈনিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব না হলে সেক্ষেত্রে গাইনী ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
৬। কোলাইন রয়েছে
ফলেটের মতো কোলাইন স্নায়ুতন্ত্রের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাছ হলো কোলাইন সমৃদ্ধ একটি খাবার যা নিয়মিত খাওয়ার ফলে গর্ভস্থ শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের গঠনগত ত্রুটি হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। বিশেষ করে Spina bifida নামক স্পাইনাল কর্ডের গঠনগত সমস্যা এড়াতে কোলাইন সমৃদ্ধ খাবারের ভূমিকা অপরিসীম। Spina bifida বাচ্চার শরীর প্যারালাইসিসের মতো হয়। অর্থাৎ শিশু অচল ভাবে বেঁচে থাকে।
৭। জিংক সমৃদ্ধ
মাছে জিংক রয়েছে, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। গর্ভাবস্থায় জিংক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উপকারী হবে। কারণ জিংক গর্ভস্থ বাচ্চার কোষের DNA তৈরি ও মস্তিষ্কের গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও গর্ভবতী নারীর শরীরে জিংকের ঘাটতি থাকলে কম ওজন নিয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করার ঝুঁকি থাকে।
৮। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
গর্ভাবস্থায় রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে তা গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য ও গর্ভস্থ শিশুর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সুস্থ থাকার জন্য শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকা জরুরী।
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করার জন্য মাছ খাওয়া উপকারী হতে পারে। কারণ এতে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ও মিনারেলস যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে তোলে।
৯। থাইরয়েডের জন্য উপকারী
থাইরয়েড গ্রন্থি শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভূমিকা রাখে। যেমনঃ মেটাবলিসম, দেহের তাপমাত্রা, হার্টের কার্যক্রম ইত্যাদি। গর্ভাবস্থায় মা ও গর্ভস্থ শিশুর সুস্থতার জন্য থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্রম ভালোভাবে হওয়া জরুরী। মাছে রয়েছে আয়োডিন যা থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্রম ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১০। ভালো ঘুমের পক্ষে সহায়ক
একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য ভালো ঘুম হওয়া জরুরী। শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হলে রাতে ঘুমের সমস্যা হতে পারে। তাই ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণের জন্য মাঝেমাঝে সূর্যের তাপ সরাসরি ত্বকের লাগাতে হবে। তবে সূর্য ছাড়াও মাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।
গর্ভাবস্থায় কি কি মাছ খাওয়া যাবে?
গর্ভাবস্থায় সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন মাছ খাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। কি কি মাছ খাওয়া যাবে এই প্রশ্নের উত্তর হলো সবধরনের মাছ খাওয়া যাবে। অর্থাৎ গর্ভাবস্থায় সবধরনের মাছ খাওয়া নিরাপদ হবে।
মাছের জাত বা প্রজাতি ভেদে পুষ্টিগুণ ও স্বাদে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। তাই শুধু একধরনের মাছ খাওয়ার অভ্যাস না করে ছোট বড় সবধরনের মাছ খাওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থায় কি কি মাছ খাওয়া যাবে না?
আসলে মাছে কোনো সমস্যা নেই যদি না মাছ খুব বেশি পরিমাণে খাওয়া হয়। কারণ কোনো খাবার অতিরিক্ত খাওয়া ভালো না।
গর্ভাবস্থায় মাছ খাওয়া বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রকৃত কারণ হলো মাছে মার্কারী বা ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান থাকতে পারে। মার্কারী গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। সাধারণত সামুদ্রিক মাছে মার্কারী থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। আর তাই সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে গর্ভবতী নারীদের জন্য সামুদ্রিক মাছ খুব বেশি পরিমাণে না খাওয়া উত্তম। সপ্তাহে এক থেকে সর্বোচ্চ দুইদিন খাওয়া যেতে পারে। (Harvard T.H. Chan, School of Public Health)
আলোচনায় প্রতীয়মান যে, গর্ভাবস্থায় মাছ খাওয়া নিরাপদ ও স্বাস্থ্যের জন্য নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। তবে মাছ অবশ্যই ভালোভাবে সিদ্ধ বা রান্না করে খেতে হবে। অর্ধসিদ্ধ বা কাঁচা মাছ খেলে এতে থাকা ক্ষতিকর অণুজীব রোগ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া থাকে যা টাইফয়েড সৃষ্টি করে।
Bibliography
Harvard T.H. Chan, School of Public Health. (n.d.). Fish: Friend or Foe? Retrieved from Harvard: https://www.hsph.harvard.edu/nutritionsource/fish/
Webster, A. (2021, 02 8). So Long Seafood? Debunking Myths About Eating Fish During Pregnancy. Retrieved from the BUMP: https://www.thebump.com/a/fish-during-pregnancy-myths-recommendations
Last Updated on October 31, 2023
Leave A Comment