বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০০১ সালে মানুষের শরীরে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ (Nipah virus infection) ধরা পড়ে। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ পর্যন্ত আমাদের দেশে সর্বমোট ৩৩৫ জন নিপাহ ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়েছে যার মধ্যে মৃত্যু বরণ করেছে ২৩৭ জন। অর্থাৎ মৃত্যুর হার প্রায় ৭১ শতাংশ। আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হলো নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের জন্য কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই এবং প্রতিরোধের জন্য কোনো টিকা (Vaccine) আবিষ্কার হয়নি।
নিপাহ ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়, মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হলে কি কি লক্ষণ দেখা যায়, সংক্রমণ নির্ণয়ের উপায়, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং প্রতিরোধের জন্য করণীয় বিষয়াবলী সম্পর্কে আজকের অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
নিপাহ ভাইরাস কি?
নিপাহ ভাইরাস হলো Zoonotic virus অর্থাৎ এটি প্রাণী থেকে মানুষ এবং মানুষ থেকে প্রাণীর দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
প্রাণীদের মধ্যে বাদুড় হলো এই রোগের প্রধান বাহক যা থেকে সাধারণত মানুষ ও শুকরের মাঝে নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও কুকুর, বিড়াল, ছাগল, গরু, ঘোড়া ইত্যাদি প্রাণির ক্ষেত্রে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে।
মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হলে মৃদু থেকে তীব্র প্রকৃতির লক্ষণ দেখা যায়। অর্থাৎ প্রাথমিক অবস্থায় তেমন কোনো জটিলতা দেখা যায় না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যখন মস্তিষ্কে ভাইরাসের সংক্রমণ হয় (Encephalitis) তখন তীব্র প্রকৃতির লক্ষণ দেখা যায়। এমনকি কখনো কখনো তা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
নিপাহ ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়?
সর্বপ্রথম ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ায় শুকরের খামারে কাজ করেন এমন ব্যক্তিদের মাঝে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায়। ধারণা করা হয় যে, শুকরের শরীর থেকে মানুষের মাঝে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। অতঃপর ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে অনেকগুলো শুকর মেরে ফেলা হয়। ১৯৯৯ সালের পরে মালয়েশিয়াতে আর নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায় নি। তবে সেই সময়ে মালয়েশিয়া হতে সিঙ্গাপুর হয়ে ভারত ও বাংলাদেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রাণী থেকে মানুষ এবং আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্যান্য সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ভাইরাস ছড়ানোর পদ্ধতি গুলো হলোঃ
- আক্রান্ত প্রাণীর সরাসরি সংস্পর্শ তথা প্রাণীর রক্ত, লালা, মলমূত্র ইত্যাদি মানুষের শরীরে প্রবেশ করা
- আক্রান্ত প্রাণির মাধ্যমে ফলমূল, খাবার অথবা পানি দূষিত হওয়া এবং তারপর সেই খাবার বা পানি মানুষ কর্তৃক খাওয়া বা পান করা
- একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে হাঁচি, কাশি, প্রস্রাব, পায়খানা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্যান্য সুস্থ ব্যক্তিদের শরীরের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে
- আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে রক্ত নিয়ে সুস্থ ব্যক্তিকে দেওয়া হলে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে
- অসুস্থ ব্যক্তির সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার (বীর্যের মাধ্যমে) ফলে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে।
বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সবচেয়ে কমন একটি মাধ্যম হলো খেজুর গাছের কাঁচা রস খাওয়া। মানুষ যেমন খেজুরের কাঁচা রস খেতে পছন্দ করে তেমনি বাদুড় খেজুরের রস পান করে। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত বাদুড় খেজুরের রস খেলে তা দূষিত হয়ে যায়। অতঃপর সেই কাঁচা রস মানুষ পান করলে নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে।
নিপাহ ভাইরাসের লক্ষণগুলো কী কী?
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, মানুষের শরীরে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের পর ৪ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বর ও মাথাব্যথা দেখা যায় যার স্থায়ীত্বকাল ৩ দিন থেকে সর্বোচ্চ ২ সপ্তাহ পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ের লক্ষণ গুলো হলোঃ (US Centers for Disease Control and Prevention, 2020)
- জ্বর
- মাথাব্যথা
- কাশি (Cough)
- গলা ব্যথা (Sore throat)
- শ্বাসকষ্ট (Difficulty breathing)
- বমি (Vomiting)
- শরীর ব্যথা ইত্যাদি
প্রাথমিক পর্যায়ে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ শ্বাসতন্ত্রে হয়ে থাকে। পরবর্তীতে মস্তিষ্কে সংক্রমণ হলে জটিল প্রকৃতির লক্ষণ দেখা যায়। যেমনঃ
- ঝিমুনি (Drowsiness)
- বিভ্রান্তি (Confusion)
- খিঁচুনি (Seizures)
এই পর্যায়ে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে এবং ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে রোগী কোমায় (Coma) চলে যায় অর্থাৎ বাইরের কোনো উদ্দীপনায় (যেমনঃ শব্দ, আলো, ব্যথা ইত্যাদিতে) সাড়া দিতে সক্ষম হয় না।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে?
নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা থেকে বোঝার উপায় নেই যে, এটি নিপাহ ভাইরাস জনিত লক্ষণ। অর্থাৎ জ্বর, মাথাব্যথা, কাশি, গলা ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলেই আপনার ক্ষেত্রে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে তা ধরে নেওয়া যায় না। কারণ সাধারণ জ্বর ঠান্ডার ক্ষেত্রেও এইসব লক্ষণ দেখা যেতে পারে। তাহলে মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, কিভাবে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বুঝতে পারবেন এবং কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে?
যখন কোনো এলাকায় নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে অথবা আশেপাশের কোনো ব্যক্তির মধ্যে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে সেই সময়টাতে আপনার ক্ষেত্রে জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা, মাথাব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে। অতঃপর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করার মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে জানা যাবে।
কিভাবে নিপাহ ভাইরাস নির্ণয় করা হয়?
নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা তথা রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হলে মৃত্যু হার অনেকটাই কমানো যায়। সেই সাথে অন্যান্য সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। যে দুটি টেস্ট নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ নির্ণয়ের জন্য করা হয়ে থাকে তা হলোঃ (Benisek, 2021)
RT-PCR (Real-time polymerase chain reaction)
শরীরে ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার পর যখন লক্ষণ দেখা যায় সেই সময়ে এই পরীক্ষা করার মাধ্যমে ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত ভাবে জানা সম্ভব হয়। এই পরীক্ষা সম্পন্ন করার জন্য রোগীর নাক, মুখ, অথবা গলার ভেতর থেকে শ্লেষ্মাকণা বা নমুনা (Swabs) সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। রক্ত, প্রস্রাব অথবা স্পাইনাল ফ্লুইডের (Cerebrospinal fluid) সাহায্যেও এই পরীক্ষা করা যেতে পারে।
ELISA (Enzyme-linked immunosorbent assay)
প্রাথমিক পর্যায়ে ভাইরাসের সংক্রমণ নির্ণয় করার জন্য নয়, বরং ভাইরাস সংক্রমণের শেষের দিকে বা রোগ ভালো হয়ে যাওয়ার পরে শরীরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি (Antibodies) তৈরি হয়েছে কিনা তা এই পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়। নমুনা হিসেবে রক্ত সংগ্রহ করে পরীক্ষাটি সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।
নিপাহ ভাইরাসের চিকিৎসা কি?
নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ দূর করার জন্য কার্যকরী কোনো ওষুধ নেই। এই রোগের চিকিৎসায় এন্টি বায়োটিক (Antibiotics) ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এন্টি বায়োটিক ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না। ভাইরাসকে ধ্বংস করার জন্য এন্টি ভাইরাল (Antiviral) ওষুধ প্রয়োজন। নিপাহ ভাইরাসের চিকিৎসার জন্য সুনির্দিষ্ট এন্টি ভাইরাল ওষুধ তৈরির বিষয়টি এখনো গবেষণাধীন রয়েছে।
নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ নিরাময়ের জন্য সহায়তা হিসেবে রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। এর পাশাপাশি শিরায় স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আর জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আইসিইউতে (ICU- Intensive Care Unit) ভর্তি করতে হবে।
কিভাবে নিপাহ ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধ করবেন?
নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য এখনো অবধি কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি। তবে কতিপয় নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। যেমনঃ
- কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া যাবে না। তবে খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে খেতে পারবেন এবং খেজুরের গুড় খাওয়া নিরাপদ হবে।
- বাদুড় বা অন্য কোনো প্রাণি ফলের খানিকটা খেয়ে ফেললে সেই ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- সবধরনের ফলমূল ও শাক-সবজি খাওয়ার আগে অবশ্যই ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
- নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।
- কোনো এলাকায় নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে বাইরে বের হলে মাস্ক পড়তে হবে।
- বাইরে থেকে ঘরে ফিরে সাবান দিয়ে দুই হাত ধুয়ে নিতে হবে।
- অসুস্থ ব্যক্তির জন্য মানুষজনের ভিড়ে যাওয়া যাবে না। কারণ এতে করে সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়।
References
Benisek, A. (2021 , September 09). Nipah Virus: What You Should Know. Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/a-to-z-guides/nipah-virus-what-to-know
US Centers for Disease Control and Prevention. (2020, October 6). Signs and Symptoms of Nipa Virus. Retrieved from CDC: https://www.cdc.gov/vhf/nipah/symptoms/index.html
Last Updated on June 4, 2023
Leave A Comment