সারা বিশ্বে ১ বিলিয়নের বেশি মানুষ ভিটামিন ডি এর অভাব জনিত সমস্যায় আক্রান্ত যার মধ্যে বাচ্চারাও অন্তর্ভুক্ত। উন্নত ও অনুন্নত সকল দেশেই ভিটামিন ডি এর অভাব জনিত সমস্যা হয়ে থাকে যা সত্যিই একটি উদ্বেগজনক বিষয়। শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব হলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে।
বাচ্চাদের শরীরে ভিটামিন ডি এর দৈনিক চাহিদার পরিমাণ কত, কেন ঘাটতি হয়, অভাব জনিত লক্ষণ কি কি, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ভিটামিন ডি এর উৎস সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
ভিটামিন ডি
খাবারের মোট ৭টি উপাদান রয়েছে। যথাঃ প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ফাইবার, ভিটামিন, মিনারেল ও পানি। ভিটামিনের আবার অনেকগুলো ধরন রয়েছে যার মধ্যেকার একটির নাম হলো ভিটামিন ডি।
ভিটামিন ডি চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন অর্থাৎ শরীরের চর্বিতে সংরক্ষিত থাকে। ভিটামিন ডি সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হয় তবে শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
ভিটামিন ডি এর চাহিদা
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের তথ্য অনুযায়ী, একজন মানুষের জন্য দৈনিক ১৫ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে হবে। তবে যাদের বয়স ৭০ বছরের বেশি তাদের জন্য দৈনিক ২০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ডি গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। (Harvard Medical School, 2023)
বাচ্চাদের জন্য দৈনিক ১৫ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে হবে। তবে ১ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য দৈনিক ১০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ডি যথেষ্ট হবে।
১ মিলিগ্রামের ১ হাজার ভাগের ১ ভাগকে ১ মাইক্রোগ্রাম বলা হয়। ভিটামিন ডি IU (International unit) একক অনুযায়ীও লেখা হয়। ১ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ডি 40 IU এর সমান। IU একক অনুযায়ী বড়দের জন্য দৈনিক 600 IU ভিটামিন ডি এবং ১ বছরের কম বয়সীদের জন্য 400 IU ভিটামিন ডি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ভিটামিন ডি এর উৎস
সব ভিটামিনের উৎস হলো খাবার। তবে ভিটামিন ডি এর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। কারণ ভিটামিন ডি এর প্রধান উৎস হলো সূর্যের তাপ। অর্থাৎ ত্বকে সূর্যের তাপ বা অতিবেগুনি রশ্মি (ultraviolet ray) লাগলে শরীরে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয়।
এছাড়াও কতিপয় খাবার থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। যেমনঃ ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার (দই, পনির, ঘি, মাখন ইত্যাদি), মাছ, মাংস, কলিজা, মাশরুম, বাদাম ও শাকসবজিতে (খুব সামান্য পরিমাণে) ভিটামিন ডি রয়েছে।
শিশু ও কিশোরদের জন্য ভিটামিন ডি এর গুরুত্ব
শিশু ও কিশোরদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি এর গুরুত্ব অপরিসীম। হাড় ও দাঁতের গঠন মজবুত রাখার ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
হাড় ও দাঁতের গঠনের জন্য ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস দরকার হয়। এই উপাদান দুইটি খাবার থেকে শরীরে শোষণ হওয়ার জন্য ভিটামিন ডি প্রয়োজন। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ডি না থাকলে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষণ ব্যাহত হয় যার ফলে হাড় ও দাঁতের গঠনের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়।
ভিটামিন ডি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যা সুস্থ থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এছাড়াও শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি, পেশির গঠন এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ভালো রাখতে ভিটামিন ডি এর ভূমিকা রয়েছে।
ভিটামিন ডি এর অভাবের ঝুঁকিগুলো কি কি?
যেসব শিশু সূর্যের তাপ গায়ে লাগানোর সুযোগ খুব কম পায় তাদের ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি রয়েছে। এছাড়াও –
- কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এমন শিশুর শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
- কালো বর্ণের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শরীরে মেলানিনের পরিমাণ বেশি থাকে যা সূর্যরশ্মির প্রভাবে শরীরে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটায়।
- যেসব শিশু মায়ের বুকের দুধ ও ফর্মুলা মিল্ক খেতে চায় না তাদের ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে।
- এছাড়াও খিঁচুনি নিরাময়ের ওষুধ (Anticonvulsant) এবং কতিপয় জটিল রোগের (ক্রন’স ডিজিজ ও Cystic fibrosis) প্রভাবে শিশুর শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হতে পারে।
ভিটামিন ডি এর ঘাটতি লক্ষণ ও উপসর্গ
ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হলে যেসব লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় তা হলোঃ
- শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়
- খিটখিটে মেজাজ লক্ষ্য করা যায়
- খিঁচুনি হওয়া (রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণবশত)
- শিশু পেশিতে শক্তি পায় না (দূর্বল) এবং অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে
- রিকেটস রোগ (Rickets) হতে পারে যার লক্ষণ হলো পায়ের হাড় বেঁকে যাওয়া ও হাড়ে ব্যথা হওয়া
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে সহজেই রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
ভিটামিন ডি এর অভাব নির্ণয়
শুধুমাত্র লক্ষণ দেখে শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। মাত্র একটি রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব নির্ণয় করা যায়।
রক্তে ভিটামিন ডি এর মাত্রা ১ মিলিলিটারে ২০ ন্যানোগ্রাম (<20 ng/mL) এর কম হলে ভিটামিন ডি এর অভাব হয়েছে বলে ধরা হয়।
এই মাত্রা ২০ থেকে ২৯ এর মধ্যে (21-29 ng/mL) হলে অপর্যাপ্ত এবং ৩০ এর বেশি (>30 ng/mL) হলে স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করা হয়। (Kubala, 2022)
যেসব শিশুদের ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে তাদের জন্য মাঝেমধ্যে রক্ত পরীক্ষা করে ভিটামিন ডি এর মাত্রা জানা উচিত।
ভিটামিন ডি এর ঘাটতির চিকিৎসা
শিশুদের ভিটামিন ডি এর অভাব জনিত সমস্যার জন্য শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।
ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট
শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব দূর করার জন্য ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে। ক্যাপসুল, ট্যাবলেট, সিরাপ ও ইনজেকশন হিসেবে ভিটামিন ডি বাজারজাত করা হয়ে থাকে।
রোদ পোহানো
শিশুকে মাঝেমধ্যে রোদ পোহানোর সুযোগ দিতে হবে। প্রতিদিন সম্ভব না হলেও সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন কিছুক্ষণ সময় (১৫ থেকে ২০ মিনিট) রোদে থাকতে হবে।
রোদ পোহানোর সময় শরীর যতটা সম্ভব অনাবৃত রাখতে হবে এবং ত্বকে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা যাবে না। কারণ কাপড় দিয়ে শরীর ঢাকা থাকলে এবং সানস্ক্রিন ব্যবহার করলে ভিটামিন ডি উৎপাদন ব্যাহত হয়।
কালো বর্ণের বাচ্চাদের জন্য তুলনামূলক বেশি সময় রোদ পোহাতে হবে। কারণ ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ বেশি থাকলে গায়ের রং কালো হয় আর এই মেলানিন সূর্যরশ্মি ত্বকে প্রবেশ করতে বাঁধা দেয়।
ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার
শিশুর খাদ্যতালিকায় ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। বুকের দুধ পান করে এমন শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ খাওয়াতে হবে। আর ছয় মাসের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য দুধের পাশাপাশি ডিম, মাছ, মাংস, কলিজা, বাদাম ও শাকসবজি খেতে দিতে হবে।
অনেক শিশু ডিমের কুসুম না খেয়ে শুধু সাদা অংশ খেতে পছন্দ করে। এতে করে ভিটামিন ডি পাওয়া যাবে না। কারণ ডিমের সাদা অংশে প্রোটিন ব্যতীত অন্য কোনো পুষ্টি উপাদান নেই বললেই চলে। ভিটামিন ডি ডিমের কুসুম থেকে পাওয়া যায়। তাই শিশুদেরকে কুসুম সহ ডিম খেতে উৎসাহিত করতে হবে।
References
Harvard Medical School. (2023, March). Vitamin D. Retrieved from Harvard Medical School: https://www.hsph.harvard.edu/nutritionsource/vitamin-d/
Kubala, J. (2022, March 08). Vitamin D Deficiency in Kids: Signs, Symptoms, and More. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/vitamin-d-deficiency-in-kids-and-teens
Last Updated on January 1, 2024
Leave A Comment