গ্লুকোমা (Glaucoma) হলো চোখের রোগ যা অন্ধ হয়ে যাওয়ার দ্বিতীয় প্রধান কারণ। দুঃখ জনক বিষয় হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্লুকোমা রোগের লক্ষণ বোঝা যায় না এবং গ্লুকোমা জনিত অন্ধত্ব পুনরুদ্ধার করার কোনো উপায় নেই। গ্লুকোমা কি, গ্লুকোমা কত ধরনের হয়, কাদের ক্ষেত্রে গ্লুকোমা হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে, কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।‌ 

গ্লুকোমা কি?

চোখ মস্তিষ্কের সংযোগ সৃষ্টি কারী নার্ভের নাম হলো অপটিক নার্ভ (Optic Nerve) যা মিলিয়নের বেশি সুক্ষ্ম নার্ভ ফাইবার দিয়ে গঠিত। গ্লুকোমা হলো এমন একটি জটিল প্রকৃতির চক্ষু রোগ যেখানে অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে চোখের দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। 

চোখের ভেতরে একুয়াস হিউমার নামক একধরনের তরল পদার্থ থাকে যার কাজ হলো কর্ণিয়া লেন্সের জন্য পুষ্টি সরবরাহ করা এবং চোখের আকৃতি (Shape) ঠিক রাখা। এই তরল পদার্থটি চোখের ভেতরে আপনাআপনি তৈরি হয় আবার শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী চোখ থেকে সুক্ষ্ম নালীর মাধ্যমে (drainage angle) অপসারণ হয়ে যায়। মানুষের শরীরে যেমন স্বাভাবিক রক্তচাপ রয়েছে তেমনি ভাবে একুয়াস হিউমার চোখের ভেতর একধরনের চাপ সৃষ্টি করে থাকে যা চোখের প্রেশার (IOP- Intraocular Pressure) নামে পরিচিত। চোখের স্বাভাবিক প্রেশার হলো ১২ থেকে ২১ মিলিমিটার মার্কারি। কোনো কারণ বশত চোখে অতিরিক্ত তরল উৎপন্ন হলে অথবা তরল অপসারণে বাঁধার সৃষ্টির ফলে চোখের প্রেশার স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়। আর চোখের প্রেশার বেড়ে যাওয়ার ফলেই সাধারণত গ্লুকোমা হয়ে থাকে।

গ্লুকোমা কত ধরনের হয়?  

আমেরিকান একাডেমি অফ অপথালমোলজির (AAO) তথ্য অনুযায়ী গ্লুকোমা প্রধানত ধরনের হয়। যেমনঃ (Boyd, 2022)

Open-angle glaucoma: এটি সবচেয়ে কমন প্রকৃতির গ্লুকোমা যেখানে চোখের তরল পদার্থ যথাযথ ভাবে অপসারণ হতে পারে না। এটি একটি ক্রনিক অবস্থা অর্থাৎ খুব ধীরে ধীরে চোখের নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এক্ষেত্রে তেমন কোনো লক্ষণ বোঝা যায় না তবে সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে দৃষ্টি শক্তির পরিধি কমতে থাকে। 

Closed-angle glaucoma: সাধারণত এই ধরনের গ্লুকোমা একিউট (Acute attack) হয় অর্থাৎ হঠাৎ আক্রমণ ঘটে এবং খুব দ্রুত সমস্যা তীব্রতর হতে থাকে। চোখের আইরিস একুয়াস হিউমার অপসারণের পথ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে এই ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে যেখানে লক্ষণ হিসেবে দেখা যায়– 

  • হঠাৎ চোখে ঝাপসা দেখা
  • চোখে তীব্র ব্যথা অনুভব হওয়া
  • চোখ লাল হয়ে যাওয়া
  • মাথা ব্যথা থাকতে পারে  
  • বমি বমি ভাব বমি হওয়া
  • চোখে রংধনুর মত কালার দেখা 

এক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্র যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ চক্ষু হাসপাতাল বা একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। অনেকের ক্ষেত্রে Closed-angle glaucoma হঠাৎ না হয়ে বরং ধীরে ধীরে হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। গ্লুকোমার প্রধান এই দুইটি ধরন ছাড়াও আরো রয়েছে–  (Mayoclinic, 2022)

Normal-tension glaucoma: চোখের প্রেশার একদম স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। এই ধরনের গ্লুকোমা কেন হয় তার প্রকৃত কারণ জানা যায় নি তবে ধারণা করা হয় যে, অতিরিক্ত সংবেদনশীল অপটিক নার্ভ বা নার্ভে রক্ত সরবরাহকারী রক্ত নালীতে ফ্যাট জমে গিয়ে যথাযথ ভাবে রক্ত সঞ্চালন না হওয়ার ফলে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।   

Glaucoma in children: একটি শিশু গ্লুকোমা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করলে অথবা জন্মের কয়েক বছরের মধ্যে গ্লুকোমা হলে তাকে এই ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়। এক্ষেত্রে কারণ হিসেবে আঘাত, তরল অপসারণের নালীতে ব্লক অথবা অন্য কোনো রোগের প্রভাবে হতে পারে বলে মনে করা হয়। 

Pigmentary glaucoma: আইরিস থেকে ছোট ছোট পিগমেন্ট দানা ছিটকে পড়ে তরল নিষ্কাশনকারী নালী ব্লক করে দিলে চোখের প্রেশার বেড়ে যায়। পিগমেন্টারি গ্লুকোমার রোগীদের ক্ষেত্রে জগিং, বাস্কেটবল ভারী ব্যায়ামের ফলে পিগমেন্ট দানা আলোড়িত হয় এবং চোখে ঝাপসা দেখা যায়। 

কাদের ক্ষেত্রে গ্লুকোমার ঝুঁকি রয়েছে

নারী পুরুষ সহ যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে গ্লুকোমা হতে পারে। তবে কতিপয় বিষয়কে গ্লুকোমার রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অর্থাৎ যা গ্লুকোমা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নির্দেশ করে। যেমনঃ

  • ৪০ বছরের বেশী বয়স্ক মানুষ
  • পরিবারে গ্লুকোমা রোগের ইতিহাস
  • এশিয়া মহাদেশের মানুষ 
  • দূরদৃষ্টি নিকট দৃষ্টি সম্পন্ন চোখ অর্থাৎ যাদের চোখের পাওয়ার কম বা বেশি থাকে 
  • চোখে তাপ বা আঘাত লাগা
  • যাদের কর্ণিয়াতে সমস্যা রয়েছে  
  • দীর্ঘদিন ধরে স্টেরোয়েড জাতীয় ঔষধ সেবন করা
  • মাইগ্রেন বা মাথাব্যথা, ডায়াবেটিস উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তি

কখন ডাক্তার দেখাবেন? 

গ্লুকোমাকে বলা হয় দৃষ্টি শক্তির নীরব ঘাতক অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্লুকোমা বিশেষ কোনো লক্ষণ ছাড়াই অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত করে মানুষকে অন্ধ করে দেয়। অনুচ্ছেদে উল্লেখিত লক্ষণগুলো বিশেষ করে মাথাব্যথা, চোখ ব্যথা, চোখে ঝাপসা দৃষ্টি ইত্যাদি দেখা দিলে তখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এছাড়াও ৪০ বছর বয়সের পর থেকে সবার জন্য এবং যাদের পারিবারিক গ্লুকোমার ইতিহাস রয়েছে তাদের জন্য আরো আগে থেকেই নিয়মিত চোখের ডাক্তার দেখানো এবং ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক চোখের প্রেশার মাপা সহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা উচিত।  

References

Boyd, K. (2022, December 06). What Is Glaucoma? Symptoms, Causes, Diagnosis, Treatment. Retrieved from American Academy of Ophthalmology: https://www.aao.org/eye-health/diseases/what-is-glaucoma

Mayoclinic. (2022, September 30). Glaucoma. Retrieved from mayoclinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/glaucoma/symptoms-causes/syc-20372839

Last Updated on April 15, 2023