মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস (Myasthenia Gravis, সংক্ষেপে MG) একটি বিরল প্রকৃতির রোগ। অর্থাৎ সচরাচর এই রোগের আক্রমণ তেমন দেখা যায় না। দুঃখজনক বিষয় হলো আমাদের দেশেও বিরল এই রোগের (মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস) দেখা পাওয়া গেছে। 

আমাদের দেশেই মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের চিকিৎসা রয়েছে। তবে সচেতনতার অভাবে যথাসময়ে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা গ্রহণ সম্ভব হয় না। এই অনুচ্ছেদে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগের কারণ, লক্ষণ সমূহ, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং জটিলতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।  

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস কি?

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস একটি নিউরোমাস্কুলার ডিজিজ অর্থাৎ নিউরন (নার্ভ বা স্নায়ু) এবং মাংসপেশীর সাথে সম্পর্কিত রোগ। এই রোগের ফলে নার্ভ থেকে পেশিতে সিগন্যাল প্রদান ব্যাহত হয়।‌ 

আমাদের শরীরের সকল পেশী নার্ভের (স্নায়ু) মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ মস্তিষ্ক থেকে নার্ভের মাধ্যমে সিগন্যাল পেশিতে পৌঁছায় এবং যার ফলে পেশি নড়াচড়া করতে পারে। 

মূলত নার্ভ থেকে সিগন্যাল নিউরোট্রান্সমিটারের (Acetylcholine) সাহায্যে পেশিতে পৌঁছায়। অর্থাৎ নার্ভ ও পেশির সংযোগস্থলে (নার্ভের শেষ প্রান্ত থেকে) নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসৃত হয় এবং পেশিতে থাকা রিসেপ্টর (Receptors) সেগুলো শোষণ করে। অর্থাৎ নিউরোট্রান্সমিটার হলো সিগন্যাল বহনকারী মাধ্যম।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগের ক্ষেত্রে পেশির রিসেপ্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে নিউরোট্রান্সমিটার শোষণ ব্যাঘাত ঘটে এবং পেশির কার্যক্রমে সমস্যা (অস্বাভাবিক দূর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ) দেখা যায়।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস কেন হয়? 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগের মূল কারণ অজানা। তবে এটি একটি অটোইমিউন ডিজিজ (Autoimmune disease) অর্থাৎ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিকতার দরুণ এই রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে। 

শরীরে রোগ জীবাণু প্রবেশ করলে ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সেগুলোকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। এটি শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আমরা রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারি।

কখনো কখনো ইমিউন সিস্টেম অস্বাভাবিক আচরণ করে। অর্থাৎ শরীরের নিজস্ব অঙ্গকে ক্ষতিকর ভেবে আক্রমণ করে বসে এবং যার ফলে সুস্থ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের ক্ষেত্রে পেশির নিউরোট্রান্সমিটার রিসেপ্টর ইমিউন সিস্টেমের অস্বাভাবিকতার দরুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে নার্ভ থেকে সিগন্যাল গ্রহণ ব্যাহত হয় এবং পেশির কার্যক্রমে সমস্যা ঘটে।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের লক্ষণ কী কী? 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের প্রাথমিক পর্যায়ের লক্ষণ হলো পেশির দুর্বলতা এবং অল্পতেই ক্লান্তি বোধ। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের পেশির ক্ষেত্রে দুর্বলতা ও ক্লান্তি দেখা যায়। 

প্রথমদিকে চোখ ও চোখের পাতার সাথে সম্পর্কিত পেশির দুর্বলতা দেখা যায়। যার ফলে চোখের পাতা ঝুলে যাওয়া (Drooping eyelids), ঝাঁপসা দৃষ্টি (Blurred vision), দ্বিত্বদৃষ্টি (Double vision) বা একই বস্তুর দুটি প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।

drooping eyelids

মুখমণ্ডলের পেশি‌ আক্রান্ত হলে কথা বলা, খাবার চিবানো এবং খাবার গিলতে সমস্যা হয়। ঘাড়ের পেশি দূর্বল হয়ে পড়লে ঘাড় সোজা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

হাত ও পায়ের পেশি আক্রান্ত হলে কাজকর্ম এবং চলাফেরায় সমস্যা দেখা যায়। অল্প একটু পরিশ্রমের পরেই পেশিতে শক্তি পাওয়া যায় না। তবে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার ফলে কিছুটা শক্তি ফিরে পাওয়া যায়।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের তীব্র পর্যায়ের লক্ষণ হলো শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত পেশির দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ। যার ফলে শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। 

দিনের শুরুতে লক্ষণের (দুর্বলতা) তীব্রতা কম থাকে। তবে দিনের শেষে লক্ষণের তীব্রতা বেশি দেখা যায়।

কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে? 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের লক্ষণ অনেকটা সাধারণ দুর্বলতার মতোই। অর্থাৎ পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ না করা, রক্তস্বল্পতার রুগী, বয়স্ক ব্যক্তি বা রুগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ খুব কমন সমস্যা। 

তাহলে আপনার ক্ষেত্রে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস হয়েছে কিনা তা বোঝার উপায় কি? 

বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ দেখা গেলে এবং সময়ের সাথে সাথে তা বাড়তে থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বিশেষ করে চোখের পাতা ঝুলে যাওয়া এবং দ্বিত্বদৃষ্টি হলো মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের প্রাথমিক পর্যায়ের নির্দেশক লক্ষণ।  

২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারী এবং ৫০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের ক্ষেত্রে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। (Harvard Medical School, 2018) 

এছাড়াও যাদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগের ইতিহাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই‌ রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যায়।

যারা মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকিতে রয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে সন্দেহজনক লক্ষণ (অস্বাভাবিক দূর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ) দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের চিকিৎসার জন্য একজন নিউরোলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে ভালো হাসপাতাল হলো ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ‘জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইন্সটিটিউট’ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ। 

কিভাবে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের নির্ণয় করা হয়? 

myasthenia gravis

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক রোগীর রোগ লক্ষণের বিস্তারিত বর্ণনা শোনা এবং শারীরিক পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেমনঃ 

  • রক্ত পরীক্ষা 
  • নার্ভের পরীক্ষা 
  • সিটি স্ক্যান ও এমআরআই

দুর্বলতা ও ক্লান্তিকে সামান্য সমস্যা ভেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর ব্যাপারে অবহেলা করা যাবে না। বরং চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক প্রয়োজনীয় সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। মনে রাখবেন,‌ প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব হবে।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের চিকিৎসা

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস একটি জটিল প্রকৃতির রোগ যার কোনো আরোগ্যকারী চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে রোগ যন্ত্রণা নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে যার মাধ্যমে রোগীর কষ্ট লাঘব করা যায় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

  • স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয় যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কর্তৃক পেশির নিউরোট্রান্সমিটার রিসেপ্টর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ঠেকায়।  
  • মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগের ক্ষেত্রে থাইমাস গ্রন্থি (Thymus gland) বেড়ে যেতে দেখা যায়। তাই সার্জারির মাধ্যমে থাইমাস গ্রন্থি অপসারণ করা হয়।  
  • রক্ত থেকে ক্ষতিকর এন্টিবডি (যা নিউরোট্রান্সমিটার রিসেপ্টর ধ্বংস করে) দূর করার জন্য প্লাজমা পেরেসিস (Plasmapheresis) করতে হয় অথবা ইমিউনিগ্লোবিন থেরাপি দিতে হয়। 

যতটা সম্ভব বিশ্রামে থাকতে হবে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ, তীব্র ঠান্ডা ও গরম এড়িয়ে চলতে হবে।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের জটিলতা

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের জন্য যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে পেশির কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়। যার ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। বিশেষ করে শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত পেশির দূর্বলতার জন্য শ্বাসকষ্ট হয় যা তীব্র আকার ধারণ করলে মৃত্যু হতে পারে।

থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। যার ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি (হাইপারথাইরয়েডিজম) বা কম (হাইপোথাইরয়েডিজম) মাত্রায় থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ হয়। এছাড়াও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও লুপাস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। (Herndon, 2023) 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস প্রতিরোধের কোনো কার্যকরী উপায় বা পদ্ধতি নেই।

শেষ কথা 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস একটি বিরল রোগ যা সচরাচর দেখা যায় না। তাই এই বিষয়টি নিয়ে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। তবে কারো ক্ষেত্রে এই রোগ ধরা পড়লে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে অন্যদের মাঝে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে না। তাই আক্রান্ত ব্যক্তিদের পাশে থেকে যতটা সম্ভব সাপোর্ট দেওয়া উচিত। 

Bibliography

Harvard Medical School. (2018, December 19). Myasthenia Gravis. Retrieved from Harvard Health: https://www.health.harvard.edu/a_to_z/myasthenia-gravis-a-to-z 

Herndon, J. (2023, July 17). What Is Myasthenia Gravis? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/myasthenia-gravis

Last Updated on January 7, 2024