মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস একটি বিরল প্রকৃতির রোগ যা অটোইমিউন ডিজিজের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিক আচরণের ফলে এই রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে। মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের ক্ষেত্রে নার্ভ থেকে পেশিতে সিগন্যাল গ্রহণের রিসেপ্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এতে পেশির কার্যক্রমে সমস্যা (অস্বাভাবিক দূর্বলতা ও ক্লান্তি) দেখা যায়।
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস দীর্ঘমেয়াদী জটিল প্রকৃতির রোগ যার কোনো আরোগ্যকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ একদম ভালো হয়ে যায় না। তবে লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। এই অনুচ্ছেদে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের চিকিৎসা পদ্ধতি
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের ফলে পেশির কার্যক্রমে সমস্যা দেখা যায়। অস্বাভাবিক দূর্বলতা বোধ হয় অর্থাৎ পেশিতে শক্তি পাওয়া যায় না এবং অল্পতেই খুব ক্লান্তি লাগে।
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের লক্ষণ হলো চোখের পাতা ঝুলে যাওয়া, ঝাঁপসা দৃষ্টি, একই বস্তুর দুইটি প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া, কথা বলতে সমস্যা হয়, খাবার চিবানো ও গিলতে সমস্যা, ঘাড় সোজা রাখা যায় না, হাত ও পায়ের শক্তি কমে যায়, স্বাভাবিক কাজকর্ম ও চলাফেরায় সমস্যা হয় এবং তীব্র পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট হয়।
চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ লক্ষণ নিরাময় এবং পেশির ক্ষতিগ্রস্ততা ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো হলোঃ (Mayo Clinic, 2023)
- স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ
- থাইমাস গ্রন্থির সার্জারি
- প্লাজমাপেরেসিস (Plasmapheresis)
- ইমিউনোগ্লোবিন থেরাপি
স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেহেতু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিক আচরণের ফলেই পেশির রিসেপ্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনের মাধ্যমে পেশির ক্ষতিগ্রস্ততা কমানো যায়।
স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের ব্যবহার অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হবে। কখনো চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ সেবন বন্ধ রাখা যাবে না।
এছাড়াও অ্যাসিটাইলকোলিন-এস্টারেজ ইনহিবিটর (Acetylcholinesterase inhibitor) জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয় যা নার্ভ থেকে পেশিতে সিগন্যাল গ্রহণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
থাইমাস গ্রন্থির সার্জারি
থাইমাস গ্রন্থি বুকের উপরের অংশে স্টার্নামের (Breastbone) নিচে অবস্থিত। জন্ম থেকে বয়ঃসন্ধিকালের আগ পর্যন্ত থাইমাস গ্রন্থির আকার বৃদ্ধি পায়। বয়ঃসন্ধিকালের পর থেকে (অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে) থাইমাস গ্রন্থির আকার ও কার্যক্রম কমে যায়। থাইমাস গ্রন্থি মূলত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অংশ হিসেবে কাজ করে।
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীদের ক্ষেত্রেই থাইমাস গ্রন্থির আকার বেড়ে যায় এবং অতিরিক্ত মাত্রায় এন্টিবডি নিঃসরণ হয় যা পেশির রিসেপ্টর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
তাই থাইমাস গ্রন্থি সার্জারির মাধ্যমে অপসারণের প্রয়োজন পড়ে যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় থাইমেকটমি (Thymectomy) বলা হয়। এটি তুলনামূলক জটিল ও ব্যয়বহুল সার্জারি। তবে আমাদের দেশেই সফলভাবে এই ধরনের সার্জারি করা হয়ে থাকে।
প্লাজমাপেরেসিস (Plasmapheresis)
তীব্র পর্যায়ের লক্ষণ নিরাময়ের জন্য প্লাজমাপেরেসিস করা হয়। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে রক্ত থেকে ক্ষতিকর এন্টিবডি (যা মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগের সাথে সম্পর্কিত) দূর করা সম্ভব হয়।
ইমিউনোগ্লোবিন থেরাপি
রক্তে ক্ষতিকর এন্টিবডি নিয়ন্ত্রণের আরেকটি উপায় হলো ইমিউনোগ্লোবিন থেরাপি। এই পদ্ধতিতে শিরায় স্যালাইন দেওয়ার মতো করে বিশেষ একধরনের ইমিউনোগ্লোবিন শরীরে প্রবেশ করানো হয় যা ক্ষতিকর এন্টিবডি ধ্বংস করে দেয়।
এছাড়াও মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগীদের ক্ষেত্রে তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে রোগীকে আইসিইউতে রেখে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের জটিলতা
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের ফলে পেশির কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম ও চলাফেরায় সমস্যা হয়। এছাড়াও শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত পেশি সমূহ আক্রমিত হলে তীব্র শ্বাসকষ্ট হয় যার ফলে মৃত্যু হতে পারে।
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের জন্য যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে রোগ লক্ষণ ও জটিলতা অনেকটাই কমানো সম্ভব হয় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত রোগী বেঁচে থাকতে পারে। তবে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা গ্রহণের ব্যাপারে অবহেলার ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় এবং অকাল মৃত্যু হতে পারে।
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের প্রাকৃতিক প্রতিকার
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। যেসব বিষয় রোগের লক্ষণ বাড়িয়ে দিতে পারে সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। (Pietrangelo, 2021)
- পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে লক্ষণ বেড়ে যায়। তাই রাতে ভালো ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
- একটানা দীর্ঘসময় পরিশ্রম করলে ক্লান্তি বেড়ে যায়। তাই কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিতে হবে।
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা ইত্যাদি লক্ষণ বাড়িয়ে দেয়। তাই মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে। এই ব্যাপারে ইয়োগা বা মেডিটেশন চর্চা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
- অতিরিক্ত ঠান্ডা ও গরমের ফলে লক্ষণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ঠান্ডা ও গরম এড়িয়ে চলতে হবে।
এছাড়াও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে যেন ইনফেকশন প্রতিরোধ করা যায়। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করা জরুরী।
থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণের মাত্রা কমে যাওয়ার (হাইপোথাইরয়েডিজম) সাথে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের লক্ষণ বেড়ে যাওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। তাই থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা থাকলে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
কতিপয় ওষুধের (যেমনঃ এন্টি-বায়োটিক, বিটা-ব্লকার ও ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার জাতীয় ওষুধ, মাসল রিলাক্সেন্ট ইত্যাদি) পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের লক্ষণ বেড়ে যেতে পারে। তাই এইসব ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হলে চিকিৎসককে রোগের ব্যাপারে আগেই জানাতে হবে যেন চিকিৎসক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন।
বাংলাদেশে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের চিকিৎসা
আমাদের দেশেই মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস নির্ণয় ও চিকিৎসার সকল সুব্যবস্থা রয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইন্সটিটিউট (ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত) এবং শাহবাগে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব কম খরচে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের জন্য ভালো মানের চিকিৎসা পাওয়া যায়।
দুঃখজনক বিষয় হলো, মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগের লক্ষণ দেখে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ সম্পর্কে ধারণা করা এবং রোগ নির্ণয় করে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এর কারণ হলো রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব এবং লক্ষণ অনেকটা সাধারণ দুর্বলতার মতোই অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর কাছে মনেই হয় যেন সাধারণ কোনো কারণে (রক্তস্বল্পতা বা পুষ্টিকর খাবারের অভাব) দূর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ হচ্ছে।
শেষ কথা
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস একদম সারিয়ে তোলা যায় না। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং রোগী দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে। এছাড়াও এই রোগের কোনো প্রতিষেধক ব্যবস্থা নেই অর্থাৎ মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস প্রতিরোধ করা যায় না।
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের আরোগ্যকারী চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য গবেষণা বিদ্যমান রয়েছে। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই এই রোগের প্রতিষেধক ও আরোগ্যকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।
Bibliography
Mayo Clinic. (2023, June 22). Myasthenia Gravis. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/myasthenia-gravis/diagnosis-treatment/drc-20352040
Pietrangelo, A. (2021, July 15). Treatment Options for Myasthenia Gravis, Plus Support and Tips. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/myasthenia-gravis-treatment-options
Last Updated on January 7, 2024
Leave A Comment