মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস (Myasthenia Gravis বা সংক্ষেপে MG) একটি বিরল প্রকৃতির রোগ। বিরল প্রকৃতির রোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জিনঘটিত (Genetic) বা বংশগত কারণে হয়ে থাকে। অর্থাৎ বংশানুক্রমে মা বাবা থেকে সন্তানদের মাঝে যেসব রোগ ছড়িয়ে পড়ে সেগুলোকে জিনঘটিত বা বংশগত রোগ বলা হয়।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস কি‌ বংশগত কারণে হয়ে থাকে? এই অনুচ্ছেদে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগের কারণ, রিস্ক ফ্যাক্টর তথা কাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে, মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগীদের আয়ুস্কাল কত এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস কি বংশগত?

মানুষের শরীর অসংখ্য কোষ (Cell) দিয়ে গঠিত এবং প্রত্যেকটি কোষের কেন্দ্রে নিউক্লিয়াস রয়েছে। নিউক্লিয়াসে জিন (Gene) থাকে যা জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্য বহন করে। অর্থাৎ জিনের মাধ্যমে মা বাবা থেকে সন্তানদের মাঝে বংশগত বৈশিষ্ট্য ও রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে।

তবে সকল রোগ জিনঘটিত নয়। অর্থাৎ মা বাবা রোগাক্রান্ত থাকলেই সন্তানদের মাঝে সব রোগ ছড়িয়ে পড়ে না।  

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস জিনঘটিত রোগ নয়। অর্থাৎ বংশানুক্রমে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস সন্তানদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে না।

মা বাবা মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগে আক্রান্ত হলে সন্তান রোগাক্রান্ত হবেই এমন কোনো কথা নেই। তবে সম্ভাবনা বা ঝুঁকি বেশি থাকে।

গর্ভকালীন সময়ে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগে আক্রান্ত হলে মায়ের শরীর থেকে গর্ভস্থ সন্তানের শরীরে এন্টিবডি (যা মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগের জন্য দায়ী) প্রবেশ করে। অর্থাৎ জন্মের পর সন্তানের ক্ষেত্রে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের লক্ষণ দেখা যেতে পারে। তবে এটি একটি সাময়িক অবস্থা যা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। (Harvard Medical School, 2018) 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস কোনো ছোঁয়াচে প্রকৃতির (Contagious) রোগ নয়। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকলে এই রোগ সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের কারণ

myasthenia gravis reasons

স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী শরীরে কোনো রোগ জীবাণু প্রবেশ করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সেগুলোকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমরা রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারি।

কখনো কখনো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) শরীরের নিজস্ব কোষ বা অঙ্গকে ক্ষতিকর ভেবে আক্রমণ করে বসে যাকে অটোইমিউন ডিজিজ (Autoimmune diseases) বলা হয়। মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস একটি অটোইমিউন ডিজিজ যার প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায়নি।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগের ক্ষেত্রে পেশির নিউরোট্রান্সমিটার (Acetylcholine) রিসেপ্টর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিকতার দরুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে নার্ভ থেকে পেশিতে সিগন্যাল গ্রহণ ব্যাহত হয় এবং পেশির কার্যক্রমে সমস্যা (অস্বাভাবিক দূর্বলতা ও ক্লান্তি) দেখা যায়।

উল্লেখ্য, মস্তিষ্ক থেকে নার্ভের মাধ্যমে পেশিতে সিগন্যাল পৌঁছায় এবং এক্ষেত্রে নিউরোট্রান্সমিটার নার্ভ থেকে পেশিতে সিগন্যাল বহনকারী হিসেবে কাজ করে। আর পেশিতে থাকা রিসেপ্টর সেই সিগন্যাল (নিউরোট্রান্সমিটার) গ্রহণ করে এবং যার ফলে পেশি নড়াচড়া করতে পারে।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের ঝুঁকিতে কারা?

যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস হতে পারে। তবে ৫০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ এবং ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

কোনো অটোইমিউন ডিজিজে (সবচেয়ে কমন হলো রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস) আক্রান্ত অথবা পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে কোনো অটোইমিউন ডিজিজের ইতিহাস রয়েছে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যায়। 

এছাড়াও থাইমাস গ্রন্থিতে (Thymus gland) কোনো টিউমার বা অস্বাভাবিকতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

কেন মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের লক্ষণ বেড়ে যায়? 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের লক্ষণগুলো হলোঃ 

  • চোখের পাতা ঝুলে যাওয়া (Drooping eyelids)
  • ঝাঁপসা দৃষ্টি (Blurred vision)
  • দ্বিত্বদৃষ্টি (Double vision) বা একই বস্তুর দুইটি প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া 
  • কথা বলতে সমস্যা হয় 
  • খাবার চিবানো ও গিলতে সমস্যা হয় 
  • ঘাড় সোজা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে 
  • স্বাভাবিক কাজকর্ম এবং চলাফেরায় সমস্যা হয় 
  • এছাড়াও তীব্র পর্যায়ের লক্ষণ হলো শ্বাসকষ্ট হওয়া  

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস আক্রান্ত রোগী অল্প একটু পরিশ্রমের পরেই পেশিতে শক্তি পায় না। তবে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলে শক্তি ফিরে পায়। দিনের শুরুতে লক্ষণের তীব্রতা কম থাকে। তবে দিনের শেষে বেড়ে যায়। 

এছাড়াও আরো যেসব বিষয় মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের লক্ষণ বাড়িয়ে দিতে পারে তা হলোঃ (Pietrangelo, 2021) 

  • পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব 
  • অতিরিক্ত মানসিক চাপ 
  • উদ্বিগ্নতা (Anxiety) ও বিষন্নতা (Depression)
  • তীব্র আলো ও রোদ (সূর্যরশ্মির প্রভাব)
  • আঘাত, ব্যথা ও ইনফেকশন
  • অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম 
  • হাইপোথাইরয়েডিজম 
  • মদ্যপান করা 

কতিপয় ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের লক্ষণ বেড়ে যেতে পারে। যেমনঃ এন্টি-বায়োটিক, বিটা-ব্লকার জাতীয় ওষুধ, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার, ম্যাগনেসিয়াম, মাসল রিলাক্সেন্ট ইত্যাদি। 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস আক্রান্ত ব্যক্তির আয়ু কত? 

life span of myasthenia gravis patient

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই মানুষ মারা যায় না।‌ এই রোগের লক্ষণ অনেকটা সাধারণ দুর্বলতার মতোই বলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ (মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস) সম্পর্কে ধারণা করাই সম্ভব হয় না। যার ফলে রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে উঠে না।  

রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেকটাই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে সক্ষম হয় এবং দীর্ঘজীবন লাভ করে। তবে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তীব্র সমস্যায় (যেমনঃ শ্বাসকষ্ট) ভুগে মারা যায়। 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস আক্রান্ত ব্যক্তি ঠিক কতদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের চিকিৎসা পদ্ধতি কী কী?

চিকিৎসার মাধ্যমে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস একদম ভালো হয়ে যায় না। রোগ লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য থাকে। অর্থাৎ মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের কোনো আরোগ্যকারী চিকিৎসা পদ্ধতি নেই।   

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও রক্তের এন্টিবডির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্লাজমা পেরেসিস (Plasmapheresis) করতে হয় অথবা ইমিউনিগ্লোবিন থেরাপি দিতে হয়। আর যদি থাইমাস গ্রন্থি বেড়ে যায় তাহলে তা অপসারণের জন্য সার্জারির প্রয়োজন পড়ে। 

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। 

  • রাতে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। 
  • একটানা দীর্ঘসময় পরিশ্রম করা যাবে না।‌ 
  • কাজের ফাঁকে যথেষ্ট বিশ্রাম নিতে হবে। 
  • নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। 
  • অতিরিক্ত ঠান্ডা ও গরম এড়িয়ে চলতে হবে। 
  • মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ইয়োগা বা মেডিটেশন চর্চা করতে হবে।  

শেষ কথা

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস কোনো বংশগত রোগ নয়। এছাড়াও এটি খুব বিরল প্রকৃতির একটি রোগ যা সচরাচর দেখা যায় না। তবে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের ঝুঁকি হ্রাস করা বা এই রোগ প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই।  

মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস রোগে আক্রান্ত হলে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশেই এই‌ রোগের চিকিৎসা রয়েছে। যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ এবং নিয়ম মেনে চললে দীর্ঘজীবন লাভ করা যায়। 

Last Updated on January 7, 2024