মানুষের পেটের ভেতর পাতার মতো দেখতে অঙ্গের নাম হলো প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়। প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ হলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় প্যানক্রিয়াটাইটিস বলা হয়। প্যানক্রিয়াটাইটিস আবার দুই ধরনের হয়ে থাকে যার মধ্যকার একটি হলো ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস (Chronic Pancreatitis) যা দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ জনিত একটি রোগ। ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের ক্ষেত্রে প্রদাহের ফলে প্যানক্রিয়াসের কোষের স্থায়ী ক্ষতি বা ড্যামেজ হয় এবং প্যানক্রিয়াসের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে।
এই অনুচ্ছেদে ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের কারণ, কাদের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকি রয়েছে, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পদ্ধতি ও সম্ভাব্য জটিলতা সমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের কারণ কী?
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের সবচেয়ে কমন কারণ হলো মদ্যপানের অভ্যাস। এছাড়াও অন্যান্য আরো যেসব কারণে এই রোগ হয়ে থাকে তা হলোঃ (Marcin, 2018)
- ধুমপানের অভ্যাস
- অটোইমিউন ডিজিজ
- রেডিওথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
- পেটের কোনো সার্জারি করার সময় প্যানক্রিয়াসে আঘাত লাগা
- পিত্তনালীর পাথর জনিত কারণে প্যানক্রিয়াস থেকে নিঃসৃত এনজাইম প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়া
- প্যানক্রিয়াসের নালী সরু হয়ে যাওয়া (নিঃসৃত এনজাইম প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে)
- সিস্টিক ফাইব্রোসিস (Cystic fibrosis) যা শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়
- রক্তে অতিরিক্ত ট্রাইগ্লিসারাইড থাকা (Hypertriglyceridemia)
- রক্তে অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের (Hypercalcaemia) উপস্থিতি
অনেক সময় ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না যাকে মেডিকেলের ভাষায় Idiopathic chronic pancreatitis বলা হয়।
পিত্তথলির পাথর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
দীর্ঘস্থায়ী প্যানক্রিয়াটাইটিস হওয়ার ঝুঁকিতে কারা?
যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস হতে পারে। তবে ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে অধিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও পুরুষ মানুষের ক্ষেত্রে মহিলাদের তুলনায় অধিক ঝুঁকি রয়েছে। মা বাবা বা ভাই বোনদের মধ্যে কারো ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের ইতিহাস থাকলে সেই সন্তান বা সহোদরের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি থাকে। অর্থাৎ জিনগত প্রভাব রয়েছে।
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের লক্ষণগুলি কী কী?
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস ধীর গতিতে শুরু হওয়া একটি রোগ যার প্রারম্ভিক অবস্থায় তেমন কোনো লক্ষণ টের পাওয়া যায় না। প্যানক্রিয়াসের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বৃদ্ধির সাথে লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। এই রোগের নির্দেশক লক্ষণ হলো মাঝে মধ্যেই পেটে ব্যথা হওয়া এবং ব্যথা পেটের মাঝ বরাবর বা পেটের বাম পাশ থেকে শুরু হয়ে পুরো পেট সহ পিঠের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্যথার প্রকৃতি খুব তীব্র হয় না তবে দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত ব্যথা থাকে। প্যানক্রিয়াসের যতবেশি সংখ্যক কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যথার আক্রমণ তত ঘন ঘন হয়ে থাকে। সেই সাথে ব্যথার তীব্রতা ও স্থায়ীত্ব বেড়ে যায়। পানীয় পান করা ও খাবার খাওয়ার সাথে ব্যথা বেড়ে যাওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। এছাড়াও ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব ও বমি হওয়ার লক্ষণ দেখা যায়।
তীব্র প্রকৃতির ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের ক্ষেত্রে এনজাইম নিঃসরণ কমে যায়। যার ফলে খাবার হজমে সমস্যা হয়। এই সময়ে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ (National Health Service, UK, 2022)
- ক্ষুধা কমে যাওয়া
- শরীরের ওজন কমতে থাকে
- ত্বক হলুদ হয়ে যায় (জন্ডিস)
- বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া
লক্ষণ দেখে ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস হয়েছে বলে মনে হলে গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।
কিভাবে ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস নির্ণয় করা হয়?
চিকিৎসক রোগীর মুখে রোগ লক্ষণের বর্ণনা শোনার পর শারীরিক পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস নির্ণয় করার জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্য নিয়ে থাকেন। যেমনঃ
- এক্সরে (X-ray)
- আল্ট্রাসনোগ্রাফি
- সিটি স্ক্যান (CT scan)
- এমআরআই (MRI)
- ইআরসিপি (ERCP)
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস ও প্যানক্রিয়াস ক্যান্সারের লক্ষণ অনেকটা একই রকমের হয়ে থাকে। তাই ক্যান্সার হয়েছে কিনা সেই ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে জানার জন্য অনেক সময় বায়োপসি (Biopsy) করার নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে।
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের চিকিৎসা
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের ক্ষেত্রে চিকিৎসার মাধ্যমে প্যানক্রিয়াসের ড্যামেজ হওয়া কোষ ফিরিয়ে আনা যায় না। বরং এক্ষেত্রে চিকিৎসার উদ্দেশ্য থাকে ড্যামেজ ঠেকানো এবং রোগীর যন্ত্রণা নিরাময় করা। ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের জন্য যেসব চিকিৎসা পদ্ধতি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে তা হলোঃ
- ব্যথার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ব্যথা নাশক ওষুধ। ব্যথার তীব্রতা অনুযায়ী চিকিৎসক মৃদু বা তীব্র প্রকৃতির ব্যথা নাশক ওষুধ সেবন করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।
- পিত্তথলির পাথর অপসারণের জন্য সার্জারির প্রয়োজন পড়ে।
- প্যানক্রিয়াসের ড্যামেজ অংশ কেটে বাদ দেওয়ার দরকার হলে সার্জারির মাধ্যমে করা হয়ে থাকে।
- এনজাইম নিঃসরণ কমে যায় বলে খাবার হজমের জন্য এনজাইম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
- শরীরে চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনের (ভিটামিন এ, ডি, ই, কে ইত্যাদি) ঘাটতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
খাবার সম্পর্কিত নির্দেশনা
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের রোগীদের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার খেতে হবে। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। লো-ফ্যাট ও ভালো মানের প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস বর্জন করা জরুরী। চা ও কফি পান করা যাবে তবে তা পরিমিত মাত্রায়। একবারে বেশি পরিমাণে খাবার না খেয়ে অল্প পরিমাণে ঘন ঘন খেতে হবে।
দীর্ঘস্থায়ী প্যানক্রিয়াটাইটিসের সম্ভাব্য জটিলতাগুলি কী কী?
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের ফলে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম নিঃসরণ কমে যায়। যার ফলে খাবার হজমে সমস্যা হয় ও পুষ্টি উপাদান শোষণ ব্যঘাত ঘটে। বিশেষ করে ফ্যাট জাতীয় খাবার হজম না হওয়ার ফলে শরীরে চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনের (ভিটামিন এ, ডি, ই, কে ইত্যাদি) ঘাটতি হয়।
প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে গেলে ডায়াবেটিস দেখা যায়। ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের ফলে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা (বিষন্নতা ও উদ্বিগ্নতা) হতে পারে। এছাড়াও ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে প্যানক্রিয়াস ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যায়।
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস প্রতিরোধ
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস প্রতিরোধের শতভাগ কার্যকরী পদ্ধতি নেই তবে কতিপয় নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়। যেমনঃ
- মদ্যপান করা যাবে না।
- ধুমপান বর্জন করতে হবে।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে।
- ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে।
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করে চিকিৎসা গ্রহণ করা হলে এবং সেই সাথে নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করার মাধ্যমে রোগী দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। আর তাই রোগ লক্ষণ বুঝতে পারলে দেরি না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক জীবন যাপন করতে হবে।
References
Marcin, J. (2018, September 29). Chronic Pancreatitis. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/chronic-pancreatitis
National Health Service, UK. (2022, May 26). Chronic pancreatitis. Retrieved from NHS: https://www.nhs.uk/conditions/chronic-pancreatitis/
Last Updated on November 20, 2023
Leave A Comment