ভিটামিনের অভাব বুঝতে শারীরিক বিভিন্ন লক্ষণের দিকে নজর দিতে পারেন। শরীরে যে কোনো প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের অভাব দেখা দিলে তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়, দেখা দিতে পারে নানান সমস্যা। চুল পড়ে যাওয়া, স্নায়ুতে ব্যথা, পেশিতে ব্যথা কিংবা দুর্বলতা, অবসাদ, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি এমনই কিছু শারীরিক সমস্যার উদাহরণ।
স্বাস্থ্যকর ডায়েটই পারে একটি সুস্থ, সুন্দর ও দীর্ঘ জীবন দিতে- একথা সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ এটা বলে থাকেন যে, নিয়মিত প্রপার ডায়েট মেনে চলা খুব কঠিন এবং অনেকের ক্ষেত্রে তা প্রায় অসম্ভব। তবে যখন আমরা পুষ্টিতে ভরা খাবার থেকে দূরে সরে যাই, তখন আমরা আমাদের দেহকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেই। কেননা তখন শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও অন্যান্য মুল্যবান উপাদান গুলো নিশ্চিত করা যায় না।
কিন্তু এই ভিটামিনের অভাব যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা আমাদের উপলব্ধির বাইরে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মানুষের ভিটামিন ডি এর ঘাটতি রয়েছে। (Harvard School of Public Health, n.d.)
আমরা কি জানি যে, ভিটামিন এ এর মারাত্মক ঘাটতি মৃত্যুর কারণও হতে পারে? চলুন আজকের এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে আমরা লক্ষণ দেখে শরীরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং ভিটামিনের অভাব বুঝতে এবং তার যথাযথ সমাধান জানতে চেষ্টা করবো।
Table of Contents
মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়লে
খুব জোড়ে দাঁত ব্রাশ করলে হালকা একটু রক্ত বের হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু যদি আপনি খেয়াল করেন যে আপনার মাড়ি থেকে খুব ঘন ঘন রক্ত বের হচ্ছে তবে অবশ্যই আপনার ডায়েটে ভিটামিন সি যোগ করার চেষ্টা করুন। কারণ ভিটামিন সি এর অভাবে মাড়িতে প্রদাহ হয় এবং সহজেই রক্তক্ষরণের প্রবণতা দেখা যায়। এছাড়াও শরীরে ভিটামিন সি এর ঘাটতি হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে যার কারণে আপনার মাড়িতে সহজেই ইনফেকশন, ব্যথা এবং দাঁতের অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি হয়।
এমতাবস্থায় শরীরে ভিটামিন সি এর অভাব পূরণে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে। আমাদের আশে পাশেই ভিটামিন সি যুক্ত খাবার রয়েছে যেগুলো আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে এবং মাড়ির সমস্যা দূর করতে সহায়তা করবে। যেমনঃ লেবু, কমলা, মালটা, আঙ্গুর, পেয়ারা, পেপে, আনারস, জাম, কাঁচা মরিচ, ব্রকলি, স্ট্রবেরি ইত্যাদি।
উল্লেখ্য ভিটামিন সি পানিতে দ্রবণীয় একটি ভিটামিন যা শরীরে সংরক্ষিত থাকে না। আর তাই ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিনই খাওয়া উচিত। সেই সাথে গর্ভবতী মা এবং ধুমপান করেন এমন ব্যক্তিদের জন্য তুলনামূলক বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি গ্রহণ করতে হবে।
আবার কেউ যদি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার অনেক বেশি পরিমাণে খেয়ে ফেলেন তাতেও কোনো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ মানুষের অন্ত্রের (Intestine) মাধ্যমে ভিটামিন সি শোষণ একটি সুনিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। তবে খুব বেশি মাত্রায় যেমন দিনে ৩০০০ মিলিগ্রামের বেশি খেলে সমস্যা হতে পারে।
ফোলা চোখ
ঘুম থেকে উঠার পর আয়নায় মুখ দেখলে প্রায় সবারই চোখ কিছুটা ফোলা মনে হয় যা স্বাভাবিক বলে বিবেচিত। তবে এর পেছনের কারণ জানতে ইচ্ছে করে না? স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের চোখে অনবরত পানি (Basal tears) নিঃসরণ হয় যা অক্ষিগোলকের (Eyeball) নড়াচড়াকে মসৃণ করে এবং চোখের ময়লা দূর করে চোখ পরিষ্কার রাখে।
রাতের বেলায় আমরা ঘুমিয়ে থাকি বলে চোখের পাতা বার বার খোলা ও বন্ধ করা হয় না। আর এই সময়ে কিছু পানি চোখের পাতায় শোষণ হয় এবং ফোলাভাব দেখা যায়। তবে এটি ঘুম থেকে উঠার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই এই সমস্যা আপনাআপনি ঠিক হয়ে যায়।
যা হোক, আমাদের আলোচনার বিষয় হলো চোখের অতিরিক্ত ফোলাভাব যা ঘুম জনিত নয় বরং শারীরিক কোনো সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। শরীরে আয়োডিনের (Iodine) অভাব হলে তার লক্ষণ হিসেবে এমনটি হতে পারে। এছাড়াও সহজেই ঠান্ডা লাগার প্রবণতা তৈরি হওয়ার পেছনে আয়োডিনের মাত্রা কমে যাওয়া দায়ী হতে পারে।
আয়োডিন একটি খনিজ উপাদান যা শরীরে সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন পড়ে। তবুও গর্ভবতী নারী, নিরামিষাশী (Vegetarian) এবং আয়োডিন যুক্ত লবণ খেতে পান না এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে শরীরে আয়োডিনের অভাব হয়ে থাকে যার লক্ষণ হিসেবে আরো দেখা যেতে পারে-
- শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি
- অপ্রত্যাশিতভাবে শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া
- খসখসে ত্বক ও চুল পড়া
- অনিয়মিত হৃদস্পন্দন ইত্যাদি
এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যেমনঃ ডিম, দই, আলু, স্ট্রবেরি, চিংড়ি, সামুদ্রিক মাছ, আয়োডিনযুক্ত লবণ ইত্যাদি। তবে শুধুমাত্র খাবার গ্রহণের মাধ্যমে সমাধান না হলে সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
ফ্যাকাশে ত্বক
আপনি যদি লক্ষ্য করে দেখেন যে আপনার গায়ের রং এ ফ্যাকাশে ভাব বাড়ছে, তাহলে বুঝবেন আপনার শরীরে ভিটামিন বি ১২ এর ঘাটতি হয়েছে। এক্ষেত্রে আরো যে সমস্ত লক্ষণ দেখা যেতে পারে তা হলোঃ
- মাথাব্যথা
- ক্লান্তি (Fatigue)
- পেটের সমস্যা
- মনোযোগের অভাব ইত্যাদি
শুধুমাত্র লক্ষণ দেখে ভিটামিন বি ১২ এর অভাব নির্ধারণ করা কঠিন। তবে আপনার বয়স যদি হয়ে থাকে ৬০ এর বেশি অথবা নিরামিষাশী ব্যক্তি এবং গর্ভবতী মায়েদের শরীরে এই ভিটামিনের অভাব হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি ১২ যুক্ত খাবার খেতে হবে। যেমনঃ স্যালমন ফিশ, লাল মাংস, ডিম, দই, cheese বা পনির ইত্যাদি।
তবে ভিটামিন বি ১২ এর অতিরিক্ত অভাব পূরণ করতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে যা নিরাপদ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত। (Kubala, 2021)
ফ্যাকাশে ঠোঁট
আপনার ঠোঁটের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখুন তো ফ্যাকাশে কিনা? যদি ফ্যাকাশে হয় তাহলে আপনার শরীরে পর্যাপ্ত আয়রনের (Iron) ঘাটতি আছে। আয়রন একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান যার অভাবে শরীরে রক্তস্বল্পতার (Anemia) সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে আরো যেসব লক্ষণ দেখা যেতে পারে তা হলোঃ
- দুর্বলতা বোধ
- অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
- ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাস (Shortness of breath)
- নখ দেখতে চামচের মতো গর্ত বিশিষ্ট (koilonychia) ও সহজেই ভেঙে যায় (Brittle)
- পা নাড়াতে থাকা (restless leg syndrome) ইত্যাদি
শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণের জন্য যে খাবারগুলো খাবেন- লাল মাংস, কলিজা, দুধ, ডিম, বিভিন্ন ধরনের সীফুড (seafood), মটরশুটি, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি। এছাড়াও প্রয়োজন সাপেক্ষে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন বড়ি (Iron supplement) খেতে পারেন।
শুষ্ক চুল
আপনার চুল যদি শুষ্কতার জন্য নষ্ট হতে থাকে, তাহলে বুঝবেন যে কোন একটা ভিটামিনের অভাব হয়েছে। আর এমনটা সাধারণত বায়োটিন বা ভিটামিন বি ৭ এর অভাবে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে, খুব বেশি পরিমাণে খুশকিও লক্ষ্য করতে পারেন। এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি৭ রয়েছে এমন খাবার খেতে হবে। যেমনঃ ডিম, কাঠবাদাম, অন্যান্য জাতের বাদাম, ফলমূল, শস্যজাতীয় খাবার ইত্যাদি। গবেষণায় দেখা গেছে যে বায়োটিন সমৃদ্ধ খাবার নখ ও চুল ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। (Ware, 2017)
উল্লেখ্য বায়োটিনের অভাব ছাড়াও অন্যান্য নানাবিধ কারণে চুল শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। যেমনঃ চুলে নিয়মমাফিক শ্যাম্পু ও তেল ব্যবহার না করা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে অনীহা, দীর্ঘসময় ধরে রোদে থাকা ইত্যাদি। চুলের শুষ্কতা দূর করতে প্রতিদিন শ্যাম্পু না করে বরং ১ দিন পর পর শ্যাম্পু করুন এবং সেই সাথে প্রতিবারে কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। প্রয়োজন মাফিক তেল ব্যবহার করতে হবে এবং অতিরিক্ত রোদের তাপ থেকে বাঁচতে মাথা ঢেকে রাখতে হবে।
মানুষের শরীরে যখন প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি হয়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যেতে থাকে এবং নানাবিধ অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যায়। ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি হলে খুব সহজেই ভিটামিন বা খনিজ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ অথবা একজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী multivitamins বা supplements টাইপ ওষুধ সেবন করে সুস্থ থাকা সম্ভব।
References
Harvard School of Public Health. (n.d.). Vitamin D. From Harvard School of Public Health;: https://www.hsph.harvard.edu/nutritionsource/vitamin-d/
Kubala, J. (2021, december 22). 9 Signs and Symptoms of Vitamin B12 Deficiency. From Healthline: https://www.healthline.com/nutrition/vitamin-b12-deficiency-symptoms#How-is-B12-deficiency-detected-and-treated
Ware, M. (2017, oct. 18). Why do we need biotin (vitamin B7)? From medical news today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/287720
Last Updated on April 27, 2023
Leave A Comment