আঁচিল (Warts) সাধারণত ক্ষতিকর হয় না কিন্তু তা সৌন্দর্যহানির একটা বড় কারণ৷ তবে আঁচিলের অনেকগুলো ধরন রয়েছে যার মধ্যে কোনটি আবার জটিল সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই আঁচিল চেনা এবং এর সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন।

এই অনুচ্ছেদে আঁচিল কেন হয়, আঁচিল দূর করার ক্রিম এবং আঁচিল দূর করার ঘরোয়া উপায়  নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও কোন ধরনের আঁচিলের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত সেই বিষয়ে সঠিক নির্দেশনা পেতে অনুচ্ছেদটি পড়তে থাকুন।

আঁচিল কি? কেন হয়?

আঁচিল ভাইরাস জনিত একটি রোগ যা শরীরের বিভিন্ন স্থানে ত্বকের উপরিভাগে হয়ে থাকে। এই ভাইরাসের নাম HPV (human papillomaviruses) যার অনেক গুলো প্রকরণ রয়েছে। আর তাই আঁচিলের ক্ষেত্রে অনেক ভিন্নতা দেখা যায়। সাধারণ ধরনের আঁচিল যে কয়েক ধরনের হয়ে থাকে তা হলো- (Cole, 2022)

  • Common warts: সাধারণত কনুই, হাঁটু, আঙ্গুল‌‌ ইত্যাদি স্থানে হয়ে থাকে।‌ এগুলো অনেকটা মাংসের মতো লাল লাল বর্ণের এবং উপরিভাগ খসখসে প্রকৃতির হয়।
  • Flat warts: সংখ্যায় অনেক বেশি এবং উপরিভাগ সমতল প্রকৃতির এই আঁচিল গুলো সাধারণত মুখমণ্ডলে হয়ে থাকে।
  • Plantar warts: এই ধরনের আঁচিল গুলো পায়ের পাতার নিচের দিকটায় হয়ে থাকে যা হাঁটার সময় ব্যথার সৃষ্টি করে।
  • Periungual warts: সাধারণত হাতের নখের নিচে বা নখের চারপাশ ঘিরে হয়ে থাকে।
  • Filiform warts: সাধারণত মুখে হয় যা সংখ্যায় একটি ও বেশ লম্বা প্রকৃতির।
  • Genital warts: পুরুষ এবং মহিলাদের যৌনাঙ্গে ছোট অথবা বড় আকৃতির এই আঁচিল গুলোর উপরিভাগ দেখতে অনেকটা ফুলকপির মতো মনে হয়। যৌনাঙ্গ ছাড়াও কখনো কখনো এগুলো পায়খানার রাস্তার পাশে হয়ে থাকে।

আঁচিল দূর করার উপায়

সাধারণত আঁচিলের জন্য কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি নয়। কারণ, তা আপনা আপনি ভালো হয়ে যায়।‌ তবে এর জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে সর্বোচ্চ ১৮ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। আঁচিল শারীরিক কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করলেও সৌন্দর্যহানি ঘটায় আর তাই কেউই পছন্দ করবে না যে, তার শরীরে আঁচিল থাকুক। আঁচিল দূর করার অনেক গুলো উপায় রয়েছে যেগুলো নিচে ধারাবাহিক ভাবে উপস্থাপন করা হলো-

আঁচিলের এলোপ্যাথিক চিকিৎসা / আচিল দূর করার ঔষধ

এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে আঁচিল দূর করার ক্রিম রয়েছে যা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ফার্মেসি থেকে কিনে ব্যবহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে কমন এবং কার্যকরী হলো স্যালিসাইলিক এসিড দ্বারা তৈরি ক্রিম যা বাজারে বিভিন্ন নামে কিনতে পাওয়া যায়। যেমনঃ

  • Keranil Cream (ইবনে সিনা)
  • Kerasol Cream (ইনসেপ্টা)
  • Salicid Cream (স্কয়ার)
  • Salidex Cream (এসকায়েফ)

আঁচিল দূর করার ক্রিম ব্যবহারের নিয়ম

আঁচিল দূর করার ক্রিম ব্যবহারের নিয়ম হলো- সামান্য পরিমাণে ক্রিম নিয়ে আঁচিলের উপরে লাগিয়ে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ২৪ ঘন্টা পর পুনরায় আবার লাগাতে হবে। তবে আঁচিল দূর হয়ে গেলে তখন আর লাগানোর প্রয়োজন নেই। খেয়াল রাখতে হবে যেনো, কোনো অবস্থাতেই ক্রিম চোখে না লাগে। অনেকের ক্ষেত্রে চোখের পাতায় বা কিনারায় আঁচিল হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এই ক্রিম লাগানো নিরাপদ নয়।

আঁচিল দূর করার ক্রিম লাগানোর মাধ্যমে আঁচিল দূর না হলে সেক্ষেত্রে আরো কিছু পদ্ধতি রয়েছে। তবে সেগুলোর জন্য একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যেমনঃ Cryotherapy, Imiquimod, ইনজেকশন, Electrodessication, সার্জারি ইত্যাদি। এই চিকিৎসা পদ্ধতি গুলো কিছুটা ব্যয়বহুল এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পন্ন। আর তাছাড়া আঁচিল একবার দূর করা হলে তা আবার হতে পারে। আর তাই বিকল্প ধারার চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে হোমিওপ্যাথির কথা চিন্তা করতে পারেন।

আঁচিল দূর করার হোমিও ঔষধ

আঁচিলের চিকিৎসার জন্য অধিকাংশ মানুষ সহজ ও নিরাপদ প্রকৃতির চিকিৎসা হিসেবে প্রথমেই হোমিওপ্যাথির কথা চিন্তা করে থাকেন। কারণ, হোমিওপ্যাথিতে আঁচিলের জন্য বেশ কিছু কার্যকরী ওষুধ রয়েছে যা খাওয়ার মাধ্যমে কয়েকদিনের মধ্যে ম্যাজিকের মতো আঁচিল দূর হয়ে যায়। আঁচিল দূর করার ঔষধ গুলো হলোঃ

  • Thuja occidentalis
  • Nitricum acidum
  • Natrum mur
  • Causticum
  • Graphites
  • Staphisagria
  • Ferrum picricum
  • Antimonium crude
  • Silicea terra

উপরে উল্লেখিত আঁচিলের ওষুধ গুলোর মধ্যে আপনার জন্য কোনটি উপযোগী হবে তা নির্ণয় করতে একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। তবে আপনি যদি একান্তই নিজে নিজে ওষুধ কিনে খেতে পছন্দ করেন, সেক্ষেত্রে Thuja occidentals 1M মাত্রার ওষুধটি কিনে প্রতিদিন সকালে খেতে পারেন যা আঁচিল দূর করতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

আঁচিল দূর করার ঘরোয়া উপায়

আপনি যদি মনে করেন যে, কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করবেন না আবার আঁচিল থাকুক সেটাও পছন্দ করেন না। সেক্ষেত্রে আপনি সহজ এবং কার্যকরী কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করতে পারেন। যেমনঃ

১. ক্যাস্টর অয়েল ও বেকিং সোডা

ক্যাস্টর অয়েল ও বেকিং সোডার মিশ্রণ ত্বককে ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। ১ চা চামচ ক্যাস্টর অয়েল এবং ১ চা চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে ঘন পেস্ট তৈরি করুন। এরপর এই পেস্ট আঁচিলের ওপর লাগিয়ে শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। সম্পূর্ণ শুকানোর পর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। আঁচিল চলে না যাওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন ১ বার করে এই পেস্টটি ব্যবহার করতে থাকুন।

২. পেঁয়াজ এবং লেবুর রস

৩ চা চামচ পেঁয়াজের রস এবং ১ টেবিল চামচ লেবুর রস একসাথে মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করুন। তুলা দিয়ে মিশ্রণটি রাতে ঘুমানোর আগে আঁচিলে লাগান। সকালে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। প্রতিদিন মিশ্রণটি ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।

৩. এলোভেরা এবং মধু

ভেষজ চিকিৎসা শাস্ত্রে, এলোভেরার ব্যবহার পাওয়া যায় সেই খৃষ্টপূর্ব যুগ থেকেই। মুখ এবং ত্বকের দাগ দূর করতে এলোভেরা ও মধু বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীন দুইভাবেই কাজ করে। এলোভেরা ও মধু ত্বককে মসৃণ রাখে এবং ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। ১ টেবিল চামচ এলোভেরা জেল এবং ১ টেবিল চামচ মধু একসাথে মিশ্রণ তৈরি করুন। অতঃপর, তুলার সাহায্যে মিশ্রণটি আঁচিলে লাগান। ভালো ফলাফলের জন্য দিনে ৩ বার মিশ্রণটি ব্যবহার করুন।

৪. রসুন

রসুনের মুল ব্যবহার রান্নার কাজে হলেও এটি কিন্তু ভেষজ গুণ সম্পন্ন উপাদান যা শরীরের নানাবিধ সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে। তেমনিভাবে, আঁচিলের জন্য রসুন পিষে লাগাতে পারেন। রসুনের মধ্যে সালফারের কিছু বিশেষ যৌগ রয়েছে যা আঁচিল দূর করতে সহায়তা করে।

৫. ভিটামিন সি

বাহ্যিকভাবে ভিটামিন সি এর ব্যবহার আঁচিল দূর করতে সহায়তা করে। এর জন্য আপনাকে লেবু, মালটা অথবা কমলার খোসা সংগ্রহ করতে হবে। কারণ, এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে এবং তা আঁচিলে লাগানো সুবিধাজনক হবে। খোসা পিষে পেস্ট বানিয়ে আঁচিলে লাগান যা নিরাপদ অথচ কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।

কোন‌ ধরনের আঁচিল বিপদজনক?

আঁচিল সাধারণত ক্ষতিকর প্রকৃতির না হলেও কিছু কিছু আঁচিল বিপদজনক হতে পারে। তাহলে, বিপদজনক আঁচিল চেনার উপায় কি? যৌনাঙ্গ এবং পায়খানার রাস্তার আঁচিল অর্থাৎ Genital Warts জটিল প্রকৃতির হয়ে থাকে। আর এই ধরনের আঁচিলের জন্য অবশ্যই চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।‌ তবে তা বাড়িতে অথবা নিজে নিজে নয়, বরং একজন যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

এই আঁচিল গুলো যৌন বাহিত রোগের অন্তর্ভুক্ত যা HPV ভাইরাসের তুলনামূলক জটিল প্রকরণের সংক্রমণের ফলে হয়ে থাকে। মনে রাখবেন, যৌনাঙ্গে আঁচিল হলে কখনোই লজ্জা বশত চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে নিজে নিজে ক্রিম লাগানো অথবা ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে না। তবে অন্যান্য আঁচিলের ক্ষেত্রে আপনার ইচ্ছা মতো অপশন বেছে নিতে পারেন।

 

References

Cole, G. W. (2022, 04 12). Warts (Common Warts). From Medicine Net: https://www.medicinenet.com/warts_common_warts/article.htm

Last Updated on May 13, 2023