কনজাংটিভাইটিস কি? চোখের সাদা অংশ ও চোখের পাতার ভেতরের দিকের পাতলা আবরণ হলো কনজাংটিভা (Conjunctiva) যেখানে কোনো কারণবশত প্রদাহের সৃষ্টি হলে তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় কনজাংটিভাইটিস (Conjunctivitis) বলা হয়। সাধারণ মানুষের কাছে এটি চোখ ওঠা রোগ নামে পরিচিত। 

এই অনুচ্ছেদে কনজাংটিভাইটিস তথা চোখ ওঠা রোগের কারণ, ধরন, লক্ষণ, ঘরোয়া চিকিৎসা, কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং জটিলতা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও শিশুদের চোখ ওঠা সমস্যা দেখা গেলে করণীয় কি সেই ব্যাপারে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

চোখ ওঠা বা কনজাংটিভাইটিস রোগের লক্ষণ 

যেকোনো এক চোখ অথবা দুই চোখেই কনজাংটিভাইটিস হতে পারে। এই রোগের লক্ষণগুলো হলোঃ 

  • চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে যায় 
  • চোখের পাতা ফুলে যায় 
  • চোখে অস্বস্তিবোধ হয় 
  • চোখ থেকে পানি পড়ে 
  • চোখ থেকে পুঁজ বের হয় 
  • ঘুম থেকে উঠার পর চোখের পাতা সহজে খোলা যায় না  
  • ঝাঁপসা দৃষ্টি (Blurred vision) 
  • আলোক সংবেদনশীলতা (Photophobia)  
  • জ্বালাপোড়া ও চুলকানি হতে পারে। 

চোখ ওঠা বা কনজাংটিভাইটিস রোগের ধরন 

কারণের উপর ভিত্তি করে চোখ ওঠা ৩ ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ (Roth, 2022) 

ইনফেকশন জনিত চোখ ওঠা 

image3 1

ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ জনিত চোখ ওঠা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই ধরনের চোখ ওঠা ছোঁয়াচে প্রকৃতির হয়ে থাকে অর্থাৎ একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্যান্য সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে। 

এলার্জি জনিত চোখ ওঠা 

বাতাসে থাকা ফুলের রেণু (Pollen) সহ যেকোনো ধরনের এলার্জিক বস্তুর প্রভাবে এলার্জি জনিত চোখ ওঠা সমস্যা হতে পারে। এই ধরনের চোখ ওঠার ক্ষেত্রে অন্যান্য লক্ষণের পাশাপাশি চোখে অনেক বেশি চুলকানি হয়। 

অন্যান্য  

বায়ু দূষণ, সুইমিং পুলে গোসল করা এবং চোখে কোনো রাসায়নিক উপাদান প্রবেশের ফলে চোখ ওঠা সমস্যা হতে পারে। উল্লেখ্য, সুইমিং পুলের পানিতে ক্লোরিন মেশানো হয় যেন পানি ভালো থাকে। 

চোখ ওঠা বা কনজাংটিভাইটিস রোগের কারণ 

চোখ ওঠা বা কনজাংটিভাইটিস রোগের কারণগুলো হলোঃ 

  • ভাইরাসের সংক্রমণ 
  • ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ 
  • এলার্জি 
  • প্রসাধনী সামগ্রী  
  • যৌন বাহিত রোগ 
  • Blocked Tear Duct 
  • অটো ইমিউন ডিজিজ 

চোখ ওঠা রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা 

চোখ ওঠা রোগটির জন্য সাধারণত কোনো চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। বরং ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যেই তা আপনাআপনি ভালো হয়ে যায়। ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে এই সময়ের করণীয় বিষয়াবলী গুলো নিচে তুলে ধরা হলোঃ 

  • চোখে অস্বস্তি বোধ হলেও চোখে বার বার হাত দেওয়া যাবে না। 
  • চোখের ময়লা, পানি ও পুঁজ হাত দিয়ে পরিষ্কার না করে বরং নরম কাপড় বা টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলুন।
  • ব্যবহৃত কাপড় ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে। আর টিস্যু ব্যবহারের পর ঝুড়িতে ফেলে দিন। 
  • চোখ পরিষ্কারের আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে।  
  • বাইরে ঘোরাফেরা না করে বরং যতটা সম্ভব বিশ্রামে থাকতে হবে। 
  • চোখের বিশ্রাম হলো ঘুম আর তাই যতটা সম্ভব বেশি ঘুমানো ভালো। 
  • রোদে যাওয়া যাবে না। একান্তই প্রয়োজন হলে চোখে কালো চশমা পড়ে বাইরে যেতে হবে। 
  • চোখে কোনো ধরনের প্রসাধনী, কাজল ও কন্টাক্ট লেন্স (Contact lens) ব্যবহার করা যাবে না। 
  • একধরনের ড্রপ (Artificial tears) রয়েছে যা মূলত চোখের কৃত্রিম পানি। চোখে এই ড্রপ ব্যবহার করা হলে তা অস্বস্তি দূর করতে সাহায্য করে। 
  • এলার্জি সৃষ্টি করতে পারে এমন খাবার গুলো বর্জন করা ভালো। যেমনঃ বেগুন, পুঁইশাক, যব, ভুট্টা, বাদাম, ইলিশ মাছ, গরুর মাংস, চিংড়ি মাছ, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি।  

চোখে ব্যথা ও অস্বস্তি দূর করার জন্য ঠান্ডা সেঁক দেওয়া উপকারী হবে।‌ একটি পরিষ্কার নরম কাপড় ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে চিপে নিন। অতঃপর তা চোখের উপরে আলতো করে চেপে ধরে থাকুন। এভাবে কয়েকবার করলে বেশ আরাম পাওয়া যাবে।

কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হব? 

image2

চোখ ওঠার জন্য কখনো কখনো চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। যেসব লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তা হলোঃ (Begum, 2021) 

  • দুই সপ্তাহের মধ্যে চোখ ওঠা ভালো হয়ে না গেলে 
  • চোখ থেকে প্রচুর পরিমাণে হলুদ বা সবুজ বর্ণের পুঁজ নির্গত হওয়া 
  • চোখে তীব্র প্রকৃতির ব্যথা হওয়া 
  • আলোর দিকে তাকানো যায় না 
  • চোখের মধ্যে কোনো বস্তু ঢুকে রয়েছে এমন অনুভূতি হওয়া  
  • চোখের দৃষ্টি শক্তি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়া 
  • তীব্র জ্বর ও শীত বোধ 

চোখ ওঠা বা কনজাংটিভাইটিস কিভাবে নির্ণয় করা হয়? 

চোখ‌ ওঠা নির্ণয়ের জন্য লক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। চিকিৎসক রোগীর কাছ থেকে চোখ ওঠার লক্ষণ সম্পর্কে শুনে প্রাথমিক ভাবে এই রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। তাই ডাক্তারের কাছে গিয়ে চোখ ওঠার সমস্ত লক্ষণ বিস্তারিতভাবে বলতে হবে। এছাড়াও ডাক্তার রোগীর চোখ পর্যবেক্ষণ সহ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা (Vision testConjunctival tissue smear) করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। 

চিকিৎসা 

চোখ ওঠার কারণ ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস নাকি অন্য কিছু তার উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্নতর হয়ে থাকে। যথাঃ (Cleveland Clinic, 2022) 

ব্যাকটেরিয়া জনিত চোখ ওঠা 

ব্যাকটেরিয়া জনিত চোখ ওঠার ক্ষেত্রে পুঁজ নিঃসরণ হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। এই ধরনের চোখ ওঠার জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী এন্টি বায়োটিক ওষুধ সেবন বা ড্রপ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে।  

চোখ ওঠার লক্ষণ কমে গেলেই এন্টি বায়োটিক ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। বরং চিকিৎসকের নির্দেশনা মোতাবেক ওষুধের ডোজ সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় এন্টি বায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হতে পারে।‌

ভাইরাস জনিত চোখ ওঠা 

ভাইরাস জনিত চোখ ওঠার নির্দেশক লক্ষণ হলো সাধারণত পুঁজ নিঃসরণ হয় না এবং দুই চোখ আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই ধরনের কনজাংটিভাইটিসের জন্য কোনো এন্টি ভাইরাল ওষুধ পাওয়া যায় না। তবে ওষুধ ছাড়াই কয়েক দিনের মধ্যে তা ভালো হয়ে যায়। 

ভাইরাস জনিত চোখ ওঠার ক্ষেত্রে এন্টি বায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না। কারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টি বায়োটিক ওষুধ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না।

এলার্জি জনিত চোখ ওঠা 

এলার্জি‌ নিরাময়ের জন্য এন্টিহিস্টামিন গোত্রের ওষুধ সেবন করতে হয়। যেমনঃ 

  • Loratadine: Alaron®, Alert®, Cladin®, Encilor®, Lora®, Lorat®, Loratin®, Oradin®, Orin®, Pretin®, Silora® ইত্যাদি 
  • Cetirizine: Acitrin®, Alatrol®, Atrizin®, Cetizin®, Cetrin®, Citin®, Nosemin®, Ontin®, Rhinil®, Trizin® ইত্যাদি 

যেকোনো (Loratadine অথবা Cetirizine) একটি ওষুধ ১০ মিলিগ্রাম মাত্রায় দিনে একবার সেবন করতে হবে। চোখ ওঠা সেরে গেলে ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন নেই।

অন্যান্য 

অন্যান্য ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে বের করে সেই মোতাবেক চিকিৎসা করতে হবে। যেমনঃ চোখে কোনো রাসায়নিক উপাদান প্রবেশ করলে তা পানি বা স্যালাইনের (Sterile saline) সাহায্যে বের করতে হবে। অটো ইমিউন ডিজিজ জনিত চোখ ওঠার ক্ষেত্রে স্টেরয়েড জাতীয় চোখের ড্রপ বা ক্রিম (Ointment) ব্যবহার করতে হবে। চোখে কোনো ধরনের গঠনগত ত্রুটি (Blocked Tear Duct) থাকলে সেক্ষেত্রে সার্জারির সহায়তা নেওয়া লাগতে পারে।  

প্রতিরোধের উপায় 

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চোখ‌ ওঠা রোগটি ছোঁয়াচে প্রকৃতির হয়ে থাকে‌। আর তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মাধ্যমে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। চোখ ওঠা প্রতিরোধে নিচে উল্লেখিত নিয়মগুলো মেনে চলুন। 

  • আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকুন। 
  • অন্যের ব্যবহৃত তোয়ালে, চশমা, মেকআপ, বালিশ ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।  
  • অপরিষ্কার হাত দিয়ে চোখ স্পর্শ করা যাবে না। 
  • একবার কনজাংটিভাইটিস হয়ে সেরে যাওয়ার পর পুনরায় যেন না হয় সেজন্য ব্যবহৃত জিনিসপত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। কন্টাক্ট লেন্স, মাশকারা, আইল্যাশ ইত্যাদি পরিবর্তন করা উত্তম।  

শিশুদের চোখ ওঠা 

নবজাতক সহ ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে চোখ ওঠা রোগ হতে পারে। ছোটদের ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণ দেখা গেলে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার উচিত। কারণ ছোটদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম হয়ে থাকে। তাই চিকিৎসা ব্যতীত সহজে সেরে না যাওয়া সহ বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও (Vision loss) ঘটতে পারে। 

বাচ্চাদের চোখ ওঠা রোগ হলে স্কুলে পাঠানো যাবে না এবং যতটা সম্ভব বাইরে বের হতে না‌ দিয়ে বিশ্রামে রাখতে হবে।

Bibliography

Begum, J. (2021, October 13). Conjunctivitis (Pinkeye). Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/eye-health/eye-health-conjunctivitis

Cleveland Clinic. (2022, August 22). Pink Eye (Conjunctivitis). Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/8614-pink-eye

Roth, E. (2022, February 17). What You Need to Know About Conjunctivitis. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/conjunctivitis

Last Updated on June 5, 2023