খিঁচুনি (Convulsion) সাধারণত মৃগী রোগের লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। কারো ক্ষেত্রে খিঁচুনি দেখা দিলে আমরা মনে করে থাকি যে, মানুষটির হয়তো মৃগীর সমস্যা রয়েছে। তবে মৃগী ছাড়াও আরো নানাবিধ কারণে খিঁচুনি হতে পারে যার মধ্যে অন্যতম হলো ফেব্রাইল কনভালশন (Febrile convulsion) বা জ্বর জনিত খিঁচুনি। 

যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে জ্বর জনিত খিঁচুনি হতে পারে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি রয়েছে। এই অনুচ্ছেদে শিশুর জ্বর জনিত খিঁচুনি কেন হয়, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা, করণীয় বিষয়াবলী এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

শিশুর জ্বর জনিত খিঁচুনি বা ফেব্রাইল কনভালশন কি?

জ্বরে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত পরিবর্তনের ফলে খিঁচুনি হলে তাকে জ্বর জনিত খিঁচুনি বা ফেব্রাইল কনভালশন বলা হয়। শরীরের তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বা তার বেশি হলে এই ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। (Wells, 2021) 

সাধারণত ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে জ্বর জনিত খিঁচুনি হয়ে থাকে। তবে ১২ মাস থেকে ১৮ মাস বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রবণতা দেখা যায়। 

জ্বর জনিত খিঁচুনির ধরন

জ্বর জনিত খিঁচুনি বা ফেব্রাইল কনভালশন দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ 

সিম্পল ফেব্রাইল কনভালশন 

এটি হলো সবচেয়ে কমন ধরনের ফেব্রাইল কনভালশন যার ফলে সাধারণত ২ মিনিট খিঁচুনি হয়ে থাকে। সর্বোচ্চ ১৫ মিনিটের বেশি খিঁচুনি হয় না এবং ২৪ ঘন্টায় সাধারণত একবারের বেশি আক্রমণ ঘটে না। 

কমপ্লেক্স ফেব্রাইল কনভালশন

এই ধরনের ফেব্রাইল কনভালশন সচরাচর দেখা যায় না। এর বৈশিষ্ট্য হলোঃ

  • ১৫ মিনিটের বেশি সময় খিঁচুনি হয়
  • ২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যে একাধিক বার খিঁচুনি দেখা যায়
  • শরীরের একপাশে খিঁচুনি শুরু হয় 

সিম্পল ও কমপ্লেক্স দুই ধরনের ফেব্রাইল কনভালশনের ক্ষেত্রেই খিঁচুনির ফলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। জ্বর জনিত খিঁচুনির কিছুক্ষণ পরেই আবার জ্ঞান ফিরে আসে।

শিশুর জ্বর জনিত খিঁচুনি বা ফেব্রাইল কনভালশনের লক্ষণ

শিশুর জ্বর জনিত খিঁচুনির ক্ষেত্রে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ

  • শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় 
  • হাত, পা ও শরীর অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে থাকে
  • চোখের মণি একদিকে বেঁকে যায় 
  • ডাকলে সারা দিতে সক্ষম হয় না
  • প্রস্রাব বা পায়খানা হতে পারে 
  • অজ্ঞান হয়ে যায় ইত্যাদি

শিশুর জ্বর জনিত খিঁচুনি বা ফেব্রাইল কনভালশনের কারণ

শিশুর জ্বর জনিত খিঁচুনির প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। তবে জ্বরের কারণে হঠাৎ শরীরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের ফলে এমন হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। সাধারণত ভাইরাস ইনফেকশন জনিত জ্বরের ক্ষেত্রে ফেব্রাইল কনভালশন হয়ে থাকে। যেমনঃ (Brazier, 2021) 

যাদের পরিবারে ফেব্রাইল কনভালশন হওয়ার ইতিহাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।

টিকা এবং জ্বর জনিত খিঁচুনি 

image4 2

শিশুদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে টিকা (Vaccine) নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। যেমনঃ হাম, মামস, রুবেলা, ডিপথেরিয়া ও টিটেনাসের টিকা নেওয়ার পরবর্তী সময়ে শিশুর জ্বর এবং জ্বর জনিত খিঁচুনি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী টিকা গ্রহণের ফলে জ্বর জনিত খিঁচুনি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। 

জ্বর জনিত খিঁচুনি হওয়ার সম্ভাবনা থাকুক আর না থাকুক, শিশুদের ক্ষেত্রে টিকা নেওয়া বাদ দেওয়া যাবে না। কারণ টিকা বিভিন্ন জটিল রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

জ্বর জনিত খিঁচুনির সময় যে কাজগুলো কখনোই করবেন না

জ্বর জনিত খিঁচুনি হলে কি কি করবেন আর কি কি করবেন না সেই ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান থাকা জরুরী।

  • আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছুটাছুটি না করে বরং ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টা করতে হবে
  • জ্বর কমানোর জন্য মুখে ওষুধ না দিয়ে বরং পায়ুপথে সাপোজিটরি ব্যবহার করা উত্তম।‌‌ কারণ খিঁচুনির সময় মুখে ওষুধ দিলে তা গলায় আটকে গিয়ে শ্বাসরোধ হতে পারে
  • শিশু কোলে থাকলে বিছানায় কাত করে শুইয়ে দিন
  • বিছানা থেকে যেন গড়িয়ে নিচে না পড়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখুন
  • মাটিতে বা ফ্লোরে শুয়ে দিন এবং আশেপাশের ধারালো জিনিস দূরে সরিয়ে রাখুন যেন আঘাত না পায়
  • তাপমাত্রা কমানোর জন্য মাথায় পানি ঢালা অথবা ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে
  • কাঁপুনি, নড়াচড়া বা খিঁচুনি ঠেকাতে শিশুকে জোর করে চেপে ধরে থাকবেন না। 

জ্বর জনিত খিঁচুনি নির্ণয় 

image3 6

জ্বর জনিত খিঁচুনি হলে শিশু রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসক রোগ লক্ষণের বর্ণনা শোনার পর শারীরিক পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেমনঃ (Mayo Clinic, 2023)

  • রক্ত পরীক্ষা
  • প্রস্রাব পরীক্ষা
  • Spinal tap (Lumbar puncture)
  • Electroencephalogram (EEG)
  • মস্তিষ্কের এমআরআই (MRI)

চিকিৎসা 

জ্বর জনিত খিঁচুনির চিকিৎসা হিসেবে জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল (Paracetamol) অথবা আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) সেবন করতে হবে। আর খিঁচুনি দূর করার জন্য মৃদু প্রকৃতির ঘুমের ওষুধ (Diazepam) গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। 

শিশুদের জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে ওষুধ খাওয়াতে হবে। কখনো চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ বন্ধ করা যাবে না।

প্রতিরোধ 

জ্বর জনিত খিঁচুনি প্রতিরোধের শতভাগ কার্যকরী কোনো পদ্ধতি নেই। তবে শিশুর জ্বর যেন না হয় অথবা জ্বর হলে শুরুতেই চিকিৎসা গ্রহণ করা হলে খিঁচুনি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। আর তাই যেসব শিশুর জ্বর জনিত খিঁচুনি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে তাদের জন্য হাতের নাগালে জ্বরের ওষুধ রাখতে হবে। এছাড়াও জ্বর যেন না হয় বিশেষ করে ভাইরাস সংক্রমণ জনিত জ্বর প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। 

মৃগী রোগীদের জন্য খিঁচুনি প্রতিরোধের ওষুধ (Anti-seizure) রয়েছে তবে তা জ্বর জনিত খিঁচুনি প্রতিরোধের জন্য সেবন করা যাবে না।

জ্বর জনিত খিঁচুনি এবং মৃগী

জ্বর জনিত খিঁচুনি এবং মৃগী রোগ জনিত খিঁচুনির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য সমূহ নিচে ছকের মাধ্যমে তুলে ধরা হলোঃ

জ্বর জনিত খিঁচুনি

মৃগী রোগ জনিত খিঁচুনি

শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তনের ফলে খিঁচুনি দেখা যায় যা ততটা জটিল প্রকৃতির নয়মৃগী হলো একটি স্নায়ুবিক সমস্যা যা তুলনামূলক জটিল প্রকৃতির একটি রোগ
সাধারণত অল্প সময় খিঁচুনি হয়ে থাকেদীর্ঘ সময় খিঁচুনি হয়
বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা হয় না বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যার সাথে সম্পর্কিত
৫ বছর বয়সের পরে সাধারণত এই ধরনের সমস্যা থাকে না। আর থাকলেও খুব কম দেখা যায়

সারা জীবন ব্যাপী এই ধরনের সমস্যা বয়ে বেড়াতে হয় 

শিশু রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা করতে হবেনিউরোলজিস্ট এর শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়ে 

 

References

Brazier, Y. (2021, October 25). What is a febrile seizure or febrile convulsion? Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/168010

Mayo Clinic. (2023, March 03). Febrile seizure. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/febrile-seizure/diagnosis-treatment/drc-20372527

Wells, D. (2021, September 01). What Is a Febrile Seizure? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/febrile-seizure

Last Updated on November 1, 2023