গর্ভধারণ (Pregnancy) একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায় যার মাধ্যমে বংশগতির ধারা অব্যাহত থাকে। আর তাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই পর্যায় শুরু করার আগে প্রয়োজন বিশেষ প্রস্তুতি।

কি ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে সুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব? গর্ভধারণের কতদিন আগে থেকে শরীরের প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত? এই সময় কি ধরনের খাবার গ্রহণ করতে হবে এবং ব্যায়াম করা কতটা যৌক্তিক ইত্যাদি বিষয় সমূহ নিয়ে এই অনুচ্ছেদে আমরা আলোচনা করবো। সেই সাথে অনুচ্ছেদের শেষের দিকে রয়েছে গর্ভধারণ করতে ইচ্ছুক এমন মহিলাদের জন্য কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণ সম্পর্কিত জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের দেওয়া বিশেষ নির্দেশনা সমূহ।

গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ গর্ভধারণ করার পূর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আমাদের দেশে গর্ভধারণের পূর্বের প্রস্তুতি নেওয়া বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে খুব বেশি সচেতনতা দেখা যায় না। যার ফলে গর্ভকালীন সময়ে অথবা বাচ্চা প্রসব করার পরে নানাবিধ সমস্যা দেখা যায়। যেমন:

  • মায়ের রক্তস্বল্পতা (Anemia)
  • প্রিএক্লাম্পশিয়া (Preeclampsia)
  • গর্ভপাত (Miscarriage)
  • বাচ্চা কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করা (Low birth weight)
  • রোগাক্রান্ত শিশুর জন্ম হওয়া
  • মৃত বাচ্চা প্রসব করা ইত্যাদি

উল্লেখিত সমস্যা গুলো প্রতিরোধের মাধ্যমে গর্ভবতী মায়ের সুস্থতা নিশ্চিত করণ এবং সেই সাথে সুস্থ সবল সন্তান প্রসব করতে চাইলে গর্ভধারণের পূর্বে বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করা আবশ্যক।

কখন গর্ভধারণের প্রস্তুতি নিতে হবে? 

আপনি যদি সন্তান নিতে চান তবে গর্ভধারণ করার কত সময় পূর্বে থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো নূন্যতম তিনমাস আগে থেকে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে হবে। (Davis, 2017) প্রস্তুতি হিসেবে বিশেষত পাঁচটি বিষয়ের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যা নিচে পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হয়েছে। তবে বয়স, শরীরের অবস্থা অথবা বিশেষ কোনো রোগে আক্রান্ত থাকলে সেই ক্ষেত্রে আরো আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। যেমন: উচ্চ রক্তচাপে (Hypertension) আক্রান্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণ করতে চাইলে আগে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। অন্যথায় গর্ভকালীন সময়ে প্রিএক্লাম্পশিয়ার মতো মারাত্মক রোগের সৃষ্টি হতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী উপায় সমূহ জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

বেশি বয়সে (৩৫ বছরের বেশি) গর্ভধারণের প্রস্তুতি এবং ঝুঁকি

উল্লেখ্য যারা অধিক বয়সে গর্ভধারণ করতে চান তাদের জন্য প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। কারণ ৩৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণের বেলায় নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। যেমন:

  • গর্ভধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়া
  • ডায়াবেটিস (Gestational Diabetes)
  • প্রিএক্লাম্পশিয়া
  • গর্ভকাল শেষ হওয়ার আগেই বাচ্চা প্রসব করা (premature birth)
  • প্রসবের পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি

এছাড়াও যারা অধিক বয়সে গর্ভধারণ করে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিজারিয়ান ডেলিভারি (cesarean delivery) করানোর প্রয়োজন হয়ে থাকে।

কোন বয়সে গর্ভধারণ করা উত্তম তা জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন। 

১. শরীরের বাড়তি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

শরীরের বাড়তি ওজন গর্ভধারণের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে। প্রথমত অতিরিক্ত ওজনের কারণে মহিলাদের গর্ভধারণ ক্ষমতা কমে যায়।‌ অর্থাৎ অতিরিক্ত ওজন রয়েছে এমন মহিলারা সহজেই গর্ভধারণ করতে পারে না। অতিরিক্ত ওজন কিভাবে গর্ভধারণের পথে বাঁধার সৃষ্টি করে থাকে সেই বিষয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে।

সাধারণত অতিরিক্ত ওজন রয়েছে এমন মহিলাদের শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা হয়ে থাকে আর যার ফলে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নিঃসরণে সমস্যা হয়। আর ডিম্বাণু হলো গর্ভধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি উপাদান যা পুরুষের শুক্রাণুর সাথে মিলিত হয়ে ভ্রূণের (Fetus) সৃষ্টি করে থাকে। অধিকাংশ স্থূল মহিলাদের ক্ষেত্রেই মাসিকের সমস্যা হতে দেখা যায় যা সঠিকভাবে ডিম্বাণু নিঃসরণ হচ্ছে না এই সংকেত বোঝায়।

অনেকের ক্ষেত্রেই আবার অতিরিক্ত ওজন থাকা সত্ত্বেও গর্ভধারণ করতে দেখা যায়। তবে সেক্ষেত্রে নানাবিধ স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন: উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, প্রসবের সময় জটিলতা, কম ওজনের বাচ্চা প্রসব করা ইত্যাদি। আর তাই এই সমস্ত সমস্যা প্রতিরোধ করতে চাইলে গর্ভধারণের পূর্বে শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি।

শরীরের ওজন কতটুকু পরিমাণে কমাতে হবে তা নির্ধারণ করার জন্য রয়েছে BMI (body mass index) স্কেল। BMI মান নির্ণয় করতে হলে শরীরের ওজন উচ্চতা দিয়ে ভাগ করতে হবে। এক্ষেত্রে ওজন কিলোগ্রাম (KG) এককে এবং উচ্চতা মিটার একক ও বর্গ করে নিতে হবে। BMI নির্ণয়ের সূত্র টি হলো:

# BMI= ওজন (কেজি) ÷ [উচ্চতা (মিটার)]

BMI স্কেল এর মান ৩০ বা তার বেশি হলে তা অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা হিসেবে গণ্য হবে। এই মান ১৮.৫ থেকে ২৪ এর মধ্যে রাখতে হবে যা স্বাভাবিক বলে বিবেচিত। অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে BMI মান স্বাভাবিক রাখতে হলে সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করতে হবে। পরিশোধিত শর্করা ও চর্বি জাতীয় খাবার বর্জন এবং ভালো মানের আমিষ, আঁশযুক্ত খাবার, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি বেশি পরিমাণে খেতে হবে।

উল্লেখ্য অতিরিক্ত ওজন যেমন গর্ভধারণের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে তেমনি ভাবে কম ওজনের ফলেও নানাবিধ সমস্যা হতে পারে। যেমন: গর্ভবতী মায়ের শরীরে রক্তস্বল্পতা, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে শিশু জন্ম গ্রহণ করা ইত্যাদি। আর তাই কম ওজন রয়েছে এমন মহিলাদের জন্য নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের ওজন বৃদ্ধি করতে হবে।

 

২. পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন 

পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন 

গর্ভধারণের পূর্বে শরীরকে সুস্থ ও সবল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। পুষ্টিকর খাবার বলতে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সমূহ বিদ্যমান রয়েছে এমন খাবারকে বোঝানো হয়ে থাকে। যেমন: খনিজ (minerals), ভিটামিন (vitamins), এন্টি-অক্সিডেন্ট, আমিষ, স্বাস্থ্যকর চর্বি, ফাইবার, শর্করা ইত্যাদি। এই উপাদানগুলো বিভিন্ন খাবার থেকে আমরা পেয়ে থাকি। তারমধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কয়েকটি উৎস হলো

  • মাছ, ডিম, দুধ, মাংস
  • ফলমূল এবং শাকসবজি
  • আটার রুটি ও বাদামী চালের ভাত
  • বাদাম, মটরশুঁটি, ডাল, অ্যাভোকাডো, তিল, তিসি বীজ ইত্যাদি

পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের পাশাপাশি শরীরের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে এমন খাবার গুলো বর্জন করা জরুরি। যেমন: পরিশোধিত শর্করা জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। আবার অস্বাস্থ্যকর চর্বি রয়েছে এমন খাবার একেবারেই বর্জন করা উচিত।

কোন ধরনের খাবারে অস্বাস্থ্যকর চর্বি রয়েছে তা জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

আমেরিকান প্রেগন্যান্সি এসোসিয়েশন (The American Pregnancy Association) এর নির্দেশনা হলো গর্ভধারণের পূর্বে তিন ধরনের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করা অতীব জরুরি। যেমন: ফলিক এসিড, ক্যালসিয়াম ও প্রিনেটাল ভিটামিন। (Davis, 2017) কোন উপাদানটি কতটুকু পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে এবং তা শরীরের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়ে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

✓ ফলিক এসিড 

ফলিক এসিড হলো ভিটামিন বি৯ যা বিভিন্ন খাবার যেমন ব্রকলি, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি, কলা, টমেটো, বাঙ্গি, মাশরুম ইত্যাদি থেকে পাওয়া যায়। তবে গর্ভধারণের জন্য বেশি পরিমাণে ফলিক এসিড গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে যা শুধুমাত্র খাবার থেকে পাওয়া সম্ভব হয় না। আর‌ তাই অতিরিক্ত ফলিক এসিডের চাহিদা মেটাতে দৈনিক ৪০০ মাইক্রোগ্রাম পরিমাণে ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের প্রয়োজন হয়ে থাকে।

শরীরে ফলিক এসিডের ঘাটতি থাকলে গর্ভস্থ শিশুর সুষুম্না কাণ্ডে (spinal cord) গঠনগত ত্রুটি হয়ে থাকে যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় Spina Bifida রোগ নামে অভিহিত করা হয়। মূলত এই রোগ প্রতিরোধের জন্যই গর্ভধারণের পূর্বে থেকে গর্ভকালীন ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত অতিরিক্ত পরিমাণে ফলিক এসিড গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে যারা ফলিক এসিড গ্রহণ করা ছাড়াই গর্ভধারণ করে ফেলেছেন তাদের জন্য‌ আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। বরং যখন আপনি টের পাবেন যে মা হতে চলেছেন তখন থেকে শুরু করে গর্ভকালীন ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত ফলিক এসিড গ্রহণ করতে থাকুন।

এছাড়াও যে সমস্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে সুষুম্না কাণ্ডের ত্রুটি নিয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে অথবা ডায়াবেটিস আক্রান্ত এমন মহিলাদের জন্য সর্বোচ্চ ৫ মিলিগ্রাম (5 mg) পর্যন্ত ফলিক এসিড গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে। তবে এতো অধিক মাত্রায় ফলিক এসিড গ্রহণের জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।

✓ ক্যালসিয়াম 

গর্ভধারণ করতে ইচ্ছুক এমন মহিলাদের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে দৈনিক ১০০০ মিলিগ্রাম (1000 mg) ক্যালসিয়াম গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। ক্যালসিয়াম হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান যা দাঁত ও হাড়ের গঠন মজবুত করে। অর্থাৎ হাড়ের মধ্যে ক্যালসিয়াম মজুত (store) থাকার মাধ্যমে হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়।

গর্ভধারণের পরে গর্ভস্থ শিশুর শরীরের গঠনের জন্য ক্যালসিয়াম এর প্রয়োজন পড়ে যা মায়ের শরীর থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের জন্য প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের বন্দোবস্ত না‌ থাকলে হাড়ের মধ্যে মজুত থাকা ক্যালসিয়াম দ্বারা চাহিদা পূরণ হয়। কিন্তু যাদের ক্ষেত্রে পূর্বে থেকে ক্যালসিয়াম গ্রহণ তথা মজুত করা না থাকে সেক্ষেত্রে হাড়ের ঘনত্ব অস্বাভাবিক ভাবে কমে গিয়ে হাড় ক্ষয় (Osteoporosis) রোগের সূচনা হয়। অথবা ক্যালসিয়াম এর ঘাটতির দরুন শিশুর গঠনগত ত্রুটি হতে পারে।

ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের নির্দেশনা পেতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

✓ প্রিনেটাল ভিটামিন (Prenatal vitamins)

চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট তার মধ্যে একটি প্রিনেটাল‌ ভিটামিন আবিষ্কার হয়েছে যা গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। সেই সাথে তা গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের প্রিনেটাল ভিটামিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-

  • Choline
  • আয়রন ট্যাবলেট
  • ভিটামিন এ, ডি, সি, ই
  • জিংক ট্যাবলেট
  • কপার, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি

উল্লেখ্য অযাচিত মাত্রায় প্রিনেটাল ভিটামিন গ্রহণ করার ফলে নানাবিধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। আর তাই আপনার শরীরের জন্য কোন প্রিনেটাল ভিটামিন টি গ্রহণ করা উচিত এবং তা কতটুকু মাত্রায় গ্রহণ করতে হবে সেই বিষয়ে সঠিক নির্দেশনা পেতে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।

৩. ক্যাফেইন বা চা-কফি খাওয়া পরিমিত করুন

ক্লান্তি দূর করে সজীবতা ফিরিয়ে আনতে চা ও কফিতে বিদ্যমান ক্যাফেইন বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে ক্যাফেইন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষত তা মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রজনন ক্ষমতা (Fertility) কমিয়ে দেয় বলে মনে করেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। আর তাই গর্ভধারণ করতে চাইলে আপনাকে দৈনিক সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ৩০০ মিলিগ্রামের (মিগ্রা) বেশি ক্যাফেইন গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। চা, কফি ছাড়াও চকোলেট এবং কোকাকোলাতে ক্যাফেইন রয়েছে। কোনটাতে কতটুকু পরিমাণে রয়েছে তা জানা‌র মাধ্যমে আপনি দৈনিক মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে খাচ্ছেন কিনা তা বুঝতে সক্ষম হবেন।

  • এক কাপ (২৩০ মিলিলিটার) লাল চায়ের মধ্যে প্রায় ৪৭ মিগ্রা ক্যাফেইন রয়েছে
  • এক কাপ কফিতে প্রায় ৯০ মিগ্রা
  • ৩৫০ মিলিলিটার কোকাকোলাতে ৩৪ মিগ্রা
  • ৩০ গ্রাম ডার্ক চকোলেটে ১২ মিগ্রা

চায়ের তুলনায় কফিতে বেশি পরিমাণে ক্যাফেইন রয়েছে। আবার গ্রিন টির মধ্যে তুলনামূলক আরো কম ক্যাফেইন রয়েছে। প্রতি ১০০ মিলিলিটার গ্রিন টিতে মাত্র ৮ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন রয়েছে। সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আর তাই লাল চা বা কফির পরিবর্তে গ্রিন টি খাওয়ার অভ্যাস করা ভালো।

৪. ধূমপান বর্জন করুন

ধূমপান বর্জন করুন

ধুমপান করেন (Smokers) এমন মহিলাদের গর্ভধারণ ক্ষমতা যারা ধুমপান করেন না তাদের তুলনায় অনেক কম। আর তাছাড়া গর্ভকালীন সময়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধুমপানের ফলে গর্ভস্থ শিশুর নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। আর তাই গর্ভধারণ করতে চাইলে আগে থেকেই ধুমপানের অভ্যাস ছাড়ার চেষ্টা নেওয়া উচিত। সেই সাথে পরোক্ষ ধূমপানের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে আপনার সঙ্গীকে ধুমপানের অভ্যাস বর্জন করতে বলুন।

গর্ভবতী মহিলা ছাড়াও নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য ধুমপান ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বস্তুত ধুমপানের কোনো শারীরিক অথবা মানসিক উপকারিতা নেই। আর তাই শুধুমাত্র আবেগ বা নেশার বশবর্তী হয়ে ধুমপানের মতো ক্ষতিকর অভ্যাস টি স্থায়ী না‌ করে বরং ধুমপান পরিত্যাগের চেষ্টা করুন।

উল্লেখ্য ধুমপানের মতো মদ্যপান করাও গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ শিশুর উপর মারাত্বক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। আর তাই মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করা জরুরি।

৫. নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন

অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং শরীরকে সুস্থ সবল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা জরুরি। গর্ভধারণের পূর্বে হালকা থেকে মাঝারি প্রকৃতির ব্যায়াম করা উচিত। তবে খুব জোরালো প্রকৃতির (Vigorous Exercises) ব্যায়াম যেমন ভারোত্তোলন, ট্রেডমিলে দ্রুত গতিতে দৌড়ানো, দীর্ঘসময় ধরে ব্যায়াম করা ইত্যাদির ফলে ডিম্বাণু নিঃসরণে সমস্যা হতে পারে। আর তাই এই সময়ে জোরালো প্রকৃতির ব্যায়াম না করাই ভালো।

গর্ভধারণের পূর্বে সবচেয়ে নিরাপদ প্রকৃতির ব্যায়াম হলো হাঁটাহাঁটি, যোগব্যায়াম করা ইত্যাদি। প্রত্যেকদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ৭ দিন ব্যায়াম করা উত্তম। তবে শরীরের ক্লান্তি দূর করতে প্রয়োজন বোধে সপ্তাহে ১ থেকে ২ দিন বিরতি নেওয়া যেতে পারে।

গর্ভধারণের প্রস্তুতি হিসেবে আরো কিছু টিপস্ 

শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক দিক দিয়ে প্রস্তুত হওয়া গর্ভধারণ করার পূর্ব প্রস্তুতি গুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বিশেষত প্রথম বার গর্ভধারণ করবেন এমন মহিলাদের জন্য এটি সম্পূর্ণ নতুন একটি যাত্রা যার জন্য মনের মধ্যে ভয়, আতংক, হতাশা, বিষন্নতা ইত্যাদির সৃষ্টি হতে পারে। আর তাই এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে জীবন সঙ্গীর কাছে সহায়তা কামনা করা সহ পরিবার ও বন্ধুদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনি যদি নিয়মিত কোনো ওষুধ সেবন করে থাকেন তবে সেক্ষেত্রে চিকিৎসককে জানান যে এই ওষুধ গ্রহণের সময় গর্ভধারণ করা নিরাপদ হবে কিনা। অনেক ওষুধ রয়েছে যা গর্ভস্থ শিশুর উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। মনে রাখবেন একজন গর্ভবতী মা হিসেবে আপনি ওষুধ খেলে তার প্রভাব আপনার পেটের সন্তানের উপর পড়বে। (Center for Disease Control and Prevention, 2020)

কোভিভ-১৯ টিকা ও গর্ভধারণ

কোভিভ-১৯ টিকা ও গর্ভধারণ

গর্ভকালীন সময়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণ হলে সেক্ষেত্রে সাধারণের তুলনায় অধিক জটিলতা দেখা দেয়। আর কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়াবলীর মধ্যে অন্যতম হলো টিকা গ্রহণ করা। তবে অনেকের কাছেই গর্ভধারণের পূর্বে টিকা গ্রহণ করা নিরাপদ হবে কিনা সেই বিষয়ে সংশয় রয়েছে।

এই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের তথ্যের সাথে একমত হয়ে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের নির্দেশনা হলো গর্ভধারণ করতে ইচ্ছুক এমন মহিলাদের জন্য কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণ করা উচিত। টিকা গ্রহণ করা হলে তাতে গর্ভধারণের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বরং তা কোভিড-১৯ সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনাকে হ্রাস করে। (Satin, 2021)

উল্লেখ্য কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণ করা হলে তাতে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায় এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। এবং সেই সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিশুকে বুকের দুধ পান করান এমন মায়েদের জন্যও টিকা গ্রহণ করা নিরাপদ। এতে দুধ পান করা শিশুর উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না বলে গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।

গর্ভধারণের প্রস্তুতি হিসেবে কোভিড-১৯ টিকা ছাড়াও আরো কিছু টিকা গ্রহণ করা উচিত। যেমন:

  • আপনি যদি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা ইতিমধ্যে গ্রহণ করে না‌ থাকেন তবে অবশ্যই গর্ভধারণের পূর্বে তা গ্রহণ করুন
  • MMR/MR (measles, mumps and rubella) টিকা গ্রহণ করা না থাকলে অতিসত্বর তা গ্রহণ করা উচিত। (National Health Service, 2020)

এছাড়াও কারো যৌন রোগের (sexually transmitted diseases) সংক্রমণ থাকলে উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে সুস্থ হওয়ার পর গর্ভধারণের প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত। অন্যথায় যৌন রোগের সংক্রমণ গর্ভস্থ সন্তানের মাধ্যমে বংশগতভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

গর্ভধারণ করার মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়া নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যার জন্য শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। প্রস্তুতি হিসেবে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং প্রয়োজনীয় টিকা গ্রহণ করুন। প্রয়োজনে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।

 

 

References

Center for Disease Control and Prevention. (2020, April 16). Planning for Pregnancy. Retrieved from CDC: https://www.cdc.gov/preconception/planning.html

Davis, N. (2017, January 19). Preparing for Pregnancy: 5 Things You Can Do to Get Your Body Ready. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/pregnancy/tips-to-get-your-body-ready-for-pregnancy

National Health Service. (2020, January 21). NHS of UK. Retrieved from NHS of UK: https://www.nhs.uk/pregnancy/trying-for-a-baby/planning-your-pregnancy/

Satin, A. (2021, August 23). The COVID-19 Vaccine and Pregnancy: What You Need to Know. Retrieved from Johns Hopkins Medicine: https://www.hopkinsmedicine.org/health/conditions-and-diseases/coronavirus/the-covid19-vaccine-and-pregnancy-what-you-need-to-know

 

 

Last Updated on May 6, 2023