যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ (NIH of US) এর তথ্য অনুযায়ী পঞ্চাশ উর্ধ্ব বয়সের প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি মানুষদের ক্ষেত্রে পাইলসের (Hemorrhoids) সমস্যায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক একটি রোগ যা একইসাথে লজ্জাজনকও বটে। তবে আশার কথা হলো এই যে প্রাথমিক পর্যায়ে পাইলস নির্ণয় করা সম্ভবপর হলে শুধুমাত্র জীবন যাপন পদ্ধতির পরিবর্তন ও কতিপয় ঘরোয়া উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে এই সমস্যার প্রতিকার করা যায়। (Jewell, 2021)
এই অনুচ্ছেদে পাইলসের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও কিভাবে ঘরোয়া উপায়ে পাইলসের চিকিৎসা করানো যায় সেই বিষয়ক আলোচনা সহ অনুচ্ছেদের শেষের দিকে রয়েছে পাইলস প্রতিরোধের বিজ্ঞান ভিত্তিক কিছু কার্যকরী টিপস।
Table of Contents
পাইলস (Hemorrhoids) কি?
পাইলস হলো পায়ুপথ বা মলদ্বারের একটি রোগ যাকে মেডিকেলের ভাষায় Hemorrhoids বলা হয়। এই রোগটি অর্শরোগ নামেও প্রচলিত। মূলত পায়ুপথের রক্তনালীতে অতিরিক্ত চাপ পড়লে অথবা দীর্ঘদিনের কোষ্টকাঠিন্যের ফলে পায়ুপথের রক্তনালী (Veins) ফুলে গিয়ে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। সাধারণত রক্তনালী ফুলে গিয়ে এক বা একাধিক নরম গোটা (আঙুরের মত) হয়ে থাকে যা পায়ুপথের ভিতরে অথবা বাইরে অবস্থান করতে পারে।
পাইলস (Hemorrhoids) কত ধরনের হয়?
অবস্থানের উপর ভিত্তি করে পাইলস সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। যেমন:
- অভ্যন্তরীণ (Internal hemorrhoids): এই ধরনের পাইলস পায়ুপথের ভিতরে হয়ে থাকে এবং সাধারণত বাইরে থেকে হাত দিয়ে অনুভব করা যায় না।
- বাহ্যিক (External hemorrhoids): এই ধরনের পাইলস সবচেয়ে বেশি হারে হতে দেখা যায় যা পায়ুপথের বাইরে আঙুরের থোকার মত ঝুলে থাকে।
দুই ধরনের পাইলসের মধ্যে কারণগত কোনো পার্থক্য না থাকলেও লক্ষণ সমূহের (Symptoms) ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায় যা পরবর্তীতে আলোচনা করা হয়েছে।
পাইলস বা অর্শরোগ কেন হয় এবং রিস্ক ফ্যাক্টর কি?
পায়ুপথের রক্তনালীতে (Veins) চাপ পড়ে এমন বিষয়গুলোকে পাইলস হওয়ার কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়ে থাকে।
যেমন:
- কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation)
- দীর্ঘদিন ধরে ডায়রিয়া (Diarrhea)
- মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা
- দীর্ঘসময় ধরে টয়লেটে বসে থাকা
- পায়ুপথে যৌন সম্পর্ক করা (Anal sex)
- ভারোত্তোলনের কাজ করা
- অলস জীবন যাপন (Sedentary lifestyle) ইত্যাদি
অনেকেই টয়লেটে বসে খবরের কাগজ পড়া, মোবাইলে গেম খেলা অথবা ধুমপান করে থাকেন। এই সমস্ত অভ্যাসগুলো মলত্যাগে বিঘ্ন ঘটায় যা একসময়ে পাইলসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়াও আরো কিছু বিষয় রয়েছে যা পাইলসের রিস্ক ফ্যাক্টর (Risk factors) বা ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত। যেমন:
- অতিরিক্ত ওজন (Obesity)
- পাইলস রোগের পারিবারিক ইতিহাস
- ৫০ বছরের বেশি বয়স ইত্যাদি
উল্লেখ্য গর্ভকালীন (Pregnancy) সময়ে জরায়ুর আকার বেড়ে যায় যা কোলন (Colon) ও পায়ুপথের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে থাকে। আর তাই গর্ভকালীন সময়ে মহিলাদের ক্ষেত্রে পাইলস হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। (Jewell, 2021)
পাইলস এর লক্ষণ কি?
Internal hemorrhoids:
অভ্যন্তরীণ পাইলসের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় তেমন লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় না। বিশেষত বাহ্যিক কোনো ফোলাভাব, অস্বস্তিকর অনুভূতি ও ব্যথা (Pain) থাকে না। তবে পায়খানার সময় উজ্জ্বল লাল বর্ণের রক্ত বের হয় যা সাধারণত টিস্যু পেপারের সাথে লেগে থাকতে দেখা যায়। অভ্যন্তরীণ পাইলস বৃদ্ধি পেয়ে একসময় তা বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে যাকে মেডিকেলের ভাষায় Prolapsed Hemorrhoid বলা হয়। এই পর্যায়ের ৩ টি গ্রেড (Grade) রয়েছে যা নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো: (Wedro, 2020)
গ্রেড ১ (Grade 1): এই পর্যায়ে পাইলসের গোটা পায়ুপথের ভিতরে থাকে এবং বাইরে বেরিয়ে আসে না।
গ্রেড ২ (Grade 2): পায়খানা করার সময় পাইলসের গোটা পায়ুপথের বাইরে বেরিয়ে আসে তবে পায়খানা শেষে তা আপনাআপনি ভেতরে ঢুকে যায়।
গ্রেড ৩ (Grade 3): এই পর্যায়ে পাইলসের গোটা বের হয়ে আসলে তা আপনাআপনি ভেতরে ঢুকে যায় না বরং হাত দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হয়।
External Hemorrhoids:
বাহ্যিক পাইলসের ক্ষেত্রে পায়ুপথের বাইরে হাত দিয়ে আঙুরের থোকার মত গোটা অনুভব করা যায় এবং সেই সাথে নিম্নলিখিত লক্ষণ গুলো দেখা যায়।
যেমন:
- মলত্যাগের সময় রক্তপাত
- অস্বস্তিবোধ ও চুলকানি
- মৃদু থেকে মাঝারি প্রকৃতির ব্যথা
- ক্ষেত্রে বিশেষে কোমর ব্যথা হতে পারে
বাহ্যিক পাইলসের ক্ষেত্রে পায়ুপথে ত্বকের নিচে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়ে জটিলতর অবস্থার সৃষ্টি করলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় Thrombosed Hemorrhoid বলা হয়। সাধারণত এই পর্যায়ের লক্ষণ হিসেবে তীব্র ব্যথা (Severe pain) হয়ে থাকে এবং সেই সাথে প্রদাহ (Inflammation) থাকতে পারে।
পাইলস কিভাবে ডায়াগনোসিস করা হয়?
উপরে উল্লেখিত পাইলসের লক্ষণ সমূহ দেখা দিলে লজ্জা না করে জরুরি ভিত্তিতে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে চিকিৎসক সঠিক ভাবে রোগ নির্ণয়ের জন্য কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেমন-
DRE (Digital Rectal Examination): এটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও সহজ একটি পরীক্ষা পদ্ধতি যেখানে কোনো যন্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। এই পদ্ধতিতে পরীক্ষার জন্য চিকিৎসক হাতে গ্লাভস পড়ে পায়ুপথে আঙ্গুল প্রবেশের মাধ্যমে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসককে যথেষ্ট পারদর্শী হওয়া প্রয়োজন আর তাই পায়ুপথের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য উত্তম হলো একজন কোলোরেক্টাল সার্জনের (Colorectal surgeon) শরণাপন্ন হওয়া।
কোলনোস্কোপি (Colonoscopy): এই পরীক্ষার মাধ্যমে পায়ুপথের অভ্যন্তরীণ অবস্থা ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে একটি ক্যামেরা যুক্ত নলবিশেষ (tube) পায়ুপথে প্রবেশের মাধ্যমে এই পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। সাধারণত হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একজন কোলোরেক্টাল সার্জনের সহায়তায় এই পরীক্ষা করানো হয়ে থাকে।
এছাড়াও প্রয়োজন সাপেক্ষে চিকিৎসক বায়োপসি (Biopsy) করানোর নির্দেশনা দিতে পারেন যে পদ্ধতিতে পায়ুপথের টিস্যু (tissue) সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগের অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
পাইলস এর চিকিৎসা কি?
লক্ষণ ও জটিলতার উপর ভিত্তি করে পাইলসের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভিন্নতর হয়ে থাকে। সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ের সমস্যার ক্ষেত্রে জীবন যাপন পদ্ধতির পরিবর্তন ও কতিপয় ঘরোয়া উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে সুস্থ থাকা যায়।
তবে জটিলতর সমস্যার ক্ষেত্রে যেমন দ্বিতীয় বা তৃতীয় গ্রেডের অভ্যন্তরীণ পাইলস এবং বাহ্যিক পাইলসের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যথা সহ রক্তক্ষরণ অথবা Thrombosed Hemorrhoid হলে সেক্ষেত্রে ঘরোয়া পদ্ধতিতে সমাধান করা যায় না। বরং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা বা মেডিকেল ট্রিটমেন্ট গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে যে বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করা হয়েছে।
পাইলস এর চিকিৎসায় সতর্কতা
উল্লেখ্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পাইলস রোগের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সহ প্রায় সব ধরনের শল্যচিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে অনেক সময় সাধারণ মানুষ অজ্ঞতা বশত অথবা চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে নানাবিধ অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা (যেমন: কবিরাজি, হেকিমি, হারবাল ইত্যাদি) পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। এই সমস্ত চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তেমনি তা পায়ুপথের রোগকে আরো জটিলতর করে তুলতে পারে। আর তাই সকলেরই এই ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে এবং বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা না বাড়িয়ে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
পাইলস বা অর্শরোগ এর ঘরোয়া চিকিৎসা কি?
যেহেতু পাইলস রোগটি নিয়ে কথা বলতে মানুষ লজ্জা বোধ করে থাকেন আর তাই অনেকেই ঘরোয়া পদ্ধতিতে কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায় সেই ব্যাপারে ইন্টারনেটে তথ্য খুঁজতে থাকেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে সেই পদ্ধতি গুলো কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর তাই এই অনুচ্ছেদে আমরা এমন কতগুলো ঘরোয়া উপায় নিয়ে আলোচনা করবো যা একাধারে বিজ্ঞান সম্মত ও কার্যকরী এবং সেই সাথে আপনাকে বুঝতে সহায়তা করবে যে কিভাবে সেই পদ্ধতি গুলো পাইলস সমস্যার সমাধান করে থাকে।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা:
পাইলস নিরাময়ে প্রথমেই আসে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার বিষয়টি কারণ পাইলসের সাথে কোষ্ঠকাঠিন্যের বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে। আর তাই কিভাবে ঘরোয়া পদ্ধতিতে কোষ্টকাঠিন্য দূর করা যায় সেটিই হলো মুখ্য বিষয়। কোষ্ঠকাঠিন্য বা পাইলস দূর করার ঘরোয়া উপায়ের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী হলো:
- গরুর মাংস, চর্বি জাতীয় খাবার, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার, পিৎজা, ফাস্টফুড ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস কমাতে হবে
- ফলমূল ও শাকসবজি বেশি বেশি করে খেতে হবে কারণ তাতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ (Fiber) রয়েছে যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশেষত মিষ্টি আলু, গাজর, ব্রকলি, কলা, শশা, তরমুজ, আপেল ইত্যাদি
- নিয়মিত ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ১ থেকে ২ চামচ পরিমাণ ইসবগুলের ভুসি নিয়ে এক গ্লাস পানিতে গুলিয়ে খেয়ে ফেলতে হবে। দৈনিক দুই বেলা খাবার গ্রহণের পরে এভাবে ইসবগুলের ভুসি খাওয়া যেতে পারে তবে দীর্ঘদিন ধরে খাওয়া উচিত নয়। এছাড়াও অনেকেই রাতের বেলায় ইসবগুলের ভুসি পানিতে গুলিয়ে রেখে সকালে খালি পেটে খেয়ে থাকেন যা একটি ভুল পদ্ধতি। ইসবগুলের ভুসি পানিতে গুলিয়ে রেখে দেওয়া যাবে না, বরং সাথে সাথেই তা খেয়ে ফেলতে হবে।
কারণ, ইসবগুলের ভুসি মূলত একটি আঁশ জাতীয় খাদ্য উপাদান যা খাওয়ার পর অন্ত্রের মধ্যে গিয়ে পানি শোষণ করে এবং অন্ত্রে থাকা খাদ্য উপাদানের সাথে মিশে মল (Stools) তৈরি করে থাকে। শুধুমাত্র রাত বলে কথা নয়, যে কোনো সময়ের জন্যই অনেক্ষণ যাবত ইসবগুলের ভুসি পানিতে ভিজিয়ে রাখা হলে তা পানি শোষণ করতে থাকে। আর এতে করে ইসবগুলের ভুসি অন্ত্রে প্রবেশের পর পানি শোষণ করতে পারে না। যার দরুন এর কার্যকারিতা হ্রাস পায় (Butler, 2020) ।
ব্যথা নিরাময় করা:
কোষ্ঠকাঠিন্যের পর যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো পাইলসের ব্যথা নিরাময় করা। এক্ষেত্রেও কিছু ঘরোয়া উপায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। এই পদ্ধতি গুলো একইসাথে ব্যথা নিরাময়ের পাশাপাশি রক্তপাত কমাতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
- Sitz bath: একটি বড় গামলায় কুসুম গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে তাতে কোমর ডুবিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট বসে থাকতে হবে। এই পদ্ধতিতে দৈনিক ২ থেকে ৩ বার বসে থাকার মাধ্যমে যেমন ব্যথা ও জ্বালাপোড়া নিরাময় হয় তেমনি ভাবে রক্তপাত কমে যায়
- ক্রিম/অলিভ অয়েল (Olive oil): পায়খানার রাস্তায় ময়েশ্চারাইজিং ক্রিম অথবা অলিভ অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি একই সাথে সহজেই মলত্যাগ করতে সহায়তা করে এবং ব্যথা নিরাময়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখে
- বরফ লাগানো: কয়েক খন্ড বরফ একটি তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে পায়খানার রাস্তায় কিছুক্ষণ লাগানোর মাধ্যমে ব্যথা ও ফোলা ভাব কমে যায়। সেই সাথে রক্তপাত কমাতেও এই পদ্ধতি কার্যকরী ভূমিকা রাখে
পাইলসের ব্যথা দূর করতে কি চিকিৎসা দেওয়া হয়?
পাইলসের ব্যথা দূর করার জন্য ঘরোয়া পদ্ধতির উপায় হিসেবে উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো যেমন Sitz bath, ক্রিম বা অলিভ অয়েল ব্যবহার ও বরফ লাগানো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে ঘরোয়া পদ্ধতির বাইরে চিকিৎসা হিসেবে কিছু ওটিসি ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। ওটিসি (OTC- over the counter) ওষুধ হলো এমন একধরনের ওষুধ যা চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়াই সংগ্রহ ও ব্যবহার করা যায়।
পাইলসের ব্যথা নিরাময়ের জন্য সাধারণ ব্যথা নাশক ওষুধ হিসেবে প্যারাসিটামল (Paracetamol) সেবন করা যেতে পারে। কারণ এক্ষেত্রে প্যারাসিটামল হলো সবচেয়ে নিরাপদ প্রকৃতির ওষুধ যা ৫০০ মিলিগ্রাম (500 mg) মাত্রায় দৈনিক ৩ থেকে ৪ বার সেবন করা যেতে পারে। ওষুধ সেবনের মধ্যবর্তী দূরত্ব অবশ্যই ৪ থেকে ৬ ঘন্টা হওয়া উচিত এবং সেই সাথে কখনোই খালি পেটে ওষুধ সেবন করা যাবে না।
তবে ব্যথা নিরাময়ের জন্য অন্যান্য ওষুধ যেমন আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen), এসপিরিন (Aspirin), ট্রামাডল (Tramadol), কোডিন (Codeine) ইত্যাদি সেবন করা উচিত নয়। কারণ তাতে যেমন রক্তপাত বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি ভাবে তা কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো এই যে পাইলসের ক্ষেত্রে যেমন পায়ুপথে ব্যথা হয়ে থাকে তেমনি ভাবে এনাল ফিসারের (Anal fissure) ক্ষেত্রেও ব্যথা হয়। পাইলসের মতো এনাল ফিসারও পায়ুপথের একটি রোগ যাকে অনেকেই ‘গেজ’ নামে অভিহিত করে থাকেন। পাইলস ও গেজ দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের রোগ এবং এদের চিকিৎসা ব্যবস্থাও ভিন্নতর। তবে প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যথা নিরাময়ের জন্য উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো পাইলস এবং গেজ উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকরী হয়ে থাকে।
পাইলসের সমস্যায় কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত?
পাইলসের সমস্যায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS of UK) এর নির্দেশনা হলো: (NHS, 2019)
- প্রাথমিক পর্যায়ে ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বনের পাশাপাশি ব্যথা নিরাময়ের জন্য একজন ফার্মাসিস্ট এর পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথা নাশক ওষুধ সেবন করা যাবে
- এছাড়াও ফার্মাসিস্ট এর পরামর্শে পায়খানা নরম করার ক্রিম বা সাপোজিটরি (Glycerin suppository) ব্যবহার করা যেতে পারে
- একটানা ৭ দিন পর্যন্ত ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা এবং ফার্মাসিস্ট এর পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণের পরেও কোনো পরিবর্তন (Improvement) দেখা না গেলে তখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত
এছাড়াও NHS এর আরো নির্দেশনা হলো নিম্নলিখিত লক্ষণ সমূহ দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যেমন:
- অতিরিক্ত পরিমাণে রক্তপাত
- কালো বর্ণের পায়খানা (Stools)
- প্রচন্ড ব্যথা বা উচ্চ মাত্রার জ্বর
- পাইলস থেকে পুঁজ (Pus) নির্গত হওয়া ইত্যাদি
পাইলস এর মেডিকেল ট্রিটমেন্ট
পাইলসের মেডিকেল ট্রিটমেন্ট হিসেবে কিছু উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে শল্যচিকিৎসা বা সার্জারি ব্যতীত পাইলস অপসারণ করা সম্ভব হয়ে থাকে। এমন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো Rubber band ligation এবং Sclerotherapy বা ইনজেকশন থেরাপি। (Jewell, 2021)
Rubber band ligation:
এই পদ্ধতির চিকিৎসায় পাইলসের গোটা গুলোতে বিশেষ একধরনের রাবার লাগিয়ে দেওয়া হয় যাতে করে এগুলোতে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত এক্ষেত্রে ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যেই পাইলসের গোটা গুলো মলত্যাগের সময় পড়ে যায়। এটি একটি নিরাপদ ও সহজ চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকার প্রয়োজন পড়ে না। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় আর তাই অবশ্যই চিকিৎসা পরবর্তীতে নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। Rubber band ligation চিকিৎসা পদ্ধতি কোন পর্যায়ের রোগীদের জন্য কার্যকরী হবে তা একজন চিকিৎসক নির্ধারণ করে থাকেন।
ইনজেকশন থেরাপি (Sclerotherapy):
এই পদ্ধতির চিকিৎসায় ইনজেকশনের মাধ্যমে পাইলসের গোটা গুলোতে বিশেষ একধরনের রাসায়নিক উপাদান প্রবেশ করানো হয়। আর এতে করে Rubber band ligation এর মতো রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে একসময় গোটা গুলো একদম ছোট হয়ে যায়। অভ্যন্তরীণ পাইলসের দ্বিতীয় গ্রেড পর্যন্ত এই চিকিৎসা ব্যবস্থা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
উল্লেখ্য ইনজেকশন থেরাপি অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ (Colorectal surgeon) চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে গ্রহণ করা উচিত। কারণ অনেক সময় অনভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা ভুল ইনজেকশন থেরাপি বা ক্ষতিকর উপাদান প্রয়োগের মাধ্যমে রোগের জটিলতা আরও বেড়ে যেতে পারে। আর তাই সচেতন হওয়া জরুরি।
Hemorrhoidectomy:
এটি একটি সার্জিক্যাল পদ্ধতি যা তৃতীয় গ্রেডের অভ্যন্তরীণ পাইলস এবং বাহ্যিক পাইলসের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। একজন সাধারণ সার্জন (General surgeon) অথবা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (Colorectal surgeon) এই ধরনের সার্জারি সম্পন্ন করে থাকেন। এই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীকে ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি থাকার প্রয়োজন হয়ে থাকে।
পাইলস এর জটিলতা কি?
পাইলস রোগের যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তা ধীরে ধীরে জটিলতর হতে থাকে। এবং সেই সাথে সর্বাঙ্গীন কিছু জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন-
- প্রতিনিয়ত রক্তপাতের দরুন শরীরে রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয়
- শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি দেখা দেয়
- কাজে কর্মে অনীহা ও মনোযোগের অভাব দেখা দেয়
- ইনফেকশন হতে পারে যা পরবর্তীতে পায়ুপথের ক্যান্সারের সংক্রমণ ঘটাতে পারে
পাইলস কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
কয়েকটি বিশেষ নির্দেশনা মেনে চলার মাধ্যমে পাইলস রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিজ্ঞান সম্মত কিছু নির্দেশনা নিচে তুলে ধরা হলো যা একইসাথে পাইলস প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে (NHS, 2019)
- খাবার হজম হওয়া থেকে শুরু করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা পর্যন্ত পানির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আর তাই প্রত্যেকদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে (২ থেকে ৩ লিটার) পানি পান করতে হবে
- আঁশযুক্ত খাবার বেশি করে খেতে হবে। যেমন: ফলমূল ও শাকসবজি
- মলত্যাগের পর নরম প্রকৃতির টিস্যু পেপার ব্যবহার করা উচিত
- ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি (পরিষ্কার -পরিচ্ছন্নতা) মেনে চলতে হবে
- নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে (প্রত্যেক দিন নূন্যতম ৩০ মিনিট)
- চা ও কফি পানের অভ্যাস কমাতে হবে। এবং সেই সাথে মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করতে হবে
- কখনোই মলত্যাগের বেগ চেপে রাখা উচিত নয়। বরং মলত্যাগের বেগ হলে সাথে সাথেই মলত্যাগ করতে হবে
- দীর্ঘসময় ধরে টয়লেটে বসে থাকা যাবে না এবং মলত্যাগের সময় খুব জোরে চাপ দেওয়া যাবে না
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে যে উঁচু কমোডে (High commode) বসে মলত্যাগ করা ভালো নাকি নিচু কমোডে (Low commode) অর্থাৎ পায়ের উপর ভর করে বসে মলত্যাগ করা উত্তম? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো উঁচু কমোড আরামদায়ক কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে যে উঁচু কমোডে সোজা হয়ে বসে মলত্যাগের অভ্যাস কোষ্ঠকাঠিন্য সহ পায়ুপথের রোগ যেমন পাইলস ও এনাল ফিসারের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পক্ষান্তরে নিচু কমোড ব্যবহারের মাধ্যমে কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলস হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। তবে যাদের নিচু কমোড ব্যবহার করতে সমস্যা হয় তাদের ক্ষেত্রে উচু কমোডে পায়ের নিচে একটি টুল রেখে বসলে শরীরের সঠিক অবস্থান বজায় থাকে। (Ho, 2016)
পাইলস একটি জটিলতর ব্যাধি তবে প্রাথমিক পর্যায়ে ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে এই রোগ নিরাময় করা সম্ভব। এছাড়াও এই রোগের জন্য রয়েছে কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা তবে এর জন্য অবশ্যই সচেতন হতে হবে যেনো লজ্জা এড়াতে অজ্ঞতাবশত বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা বাড়িয়ে ভুল চিকিৎসা গ্রহণ করা না হয়। সেই সাথে সুস্থদের ক্ষেত্রে পাইলস যেনো না হয় সেই জন্য পাইলস প্রতিরোধ করতে উপরে প্রদত্ত কার্যকরী টিপসগুলো মেনে চললে এ রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
References
Ho, V. (2016, August 16). What’s the best way to go to the toilet – squatting or sitting? Retrieved from The Conversation: theconversation.com/whats-the-best-way-to-go-to-the-toilet-squatting-or-sitting
Jewell, T. (2021, Nov 08). Causes of Hemorrhoids and Tips for Prevention. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/hemorrhoids
Butler, N. (2020). 7 benefits of psyllium. Retrieved from :www.medicalnewstoday.com/articles/318707
NHS. (2019, May 22). Piles (haemorrhoids). Retrieved from National Health Service of UK: https://www.nhs.uk/conditions/piles-haemorrhoids/
Wedro, B. (2020, sep 11). Internal and External Hemorrhoids. Retrieved from MedicineNet: https://www.medicinenet.com/hemorrhoids_piles/article.htm
Last Updated on May 25, 2023
Leave A Comment