মাথার চুলকানি (Itchy Scalp) যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা যা একাধারে মাথার তালু ও চুলের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। মাথায় চুলকানি হলে সারাক্ষণই চুলকাতে ইচ্ছা করে এবং চুলকানো হলে শুরুতে কিছুক্ষণ ভালো লাগে। তবে পরবর্তীতে চুলকানির স্থানে ক্ষত হয়ে যাওয়ার ফলে ব্যথা হয় অথবা জ্বালাপোড়া করে।
এই অনুচ্ছেদে মাথার চুলকানি হওয়ার কারণ এবং চুলকানি দূর করার কয়েকটি সহজ ও কার্যকরী ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও মাথার চুলকানির কোন পর্যায়ে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে সেই ব্যাপারে জানতে পড়তে থাকুন।
Table of Contents
মাথার চুলকানি হওয়ার কারণ
মাথার চুলকানি হওয়ার সবচেয়ে কমন কারণ হলো খুশকি (Dandruffs) যা হলো মাথার ত্বকের মৃত কোষ। এছাড়াও আরো যেসব কারণে মাথায় চুলকানি হতে পারে তা হলোঃ (Whelan, 2023)
- মাথার ত্বকে ফাংগাস সংক্রমণ
- মাথার উকুন
- একজিমা (Eczema)
- সোরিয়াসিস (Psoriasis)
- Atopic dermatitis
- Seborrheic dermatitis
- হার্পিস জোস্টার (Herpes zoster)
- এলার্জিক রিয়েকশন
- মানসিক চাপ ও উদ্বিগ্নতা
মাথার খুশকি ও চুলকানি দূর করার উপায়
মাথার খুশকি ও চুলকানি দূর করার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে কতিপয় ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে সুফল পাওয়া যেতে পারে। আপেল সিডার ভিনেগার, নারকেল তেল, অলিভ অয়েল, অ্যালোভেরা জেল, লেবুর রস, টি ট্রি অয়েল (Tea tree oil), শ্যাম্পু ইত্যাদির ভূমিকা ও ব্যবহারের নিয়ম নিচে তুলে ধরা হলোঃ (Lillis, 2019)
১। আপেল সিডার ভিনেগার
আপেল থেকে গাঁজন প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয় আপেল সিডার ভিনেগার যার ভেতরে ৫ শতাংশ এসিটিক এসিড থাকে। এসিটিক এসিড এন্টিফাংগাল ও এন্টিব্যাকটেরিয়াল গুণাবলী সম্পন্ন হয়ে থাকে অর্থাৎ ফাংগাস ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সক্ষম।
খুশকি, সোরিয়াসিস, মাথার ত্বকে ফাংগাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, ত্বকের শুষ্কতা ইত্যাদি জনিত মাথার চুলকানি ও প্রদাহ দূর করতে আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করা যেতে পারে।
ব্যবহারের নিয়ম:
সমপরিমাণ ভিনেগার ও পানি (অর্থাৎ ১:১ অনুপাত) মিশিয়ে মাথার ত্বকে হালকাভাবে ঘসে লাগান। ৩০ মিনিট পর পরিষ্কার পানি দিয়ে মাথা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে দুই দিন এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
চুলকানোর ফলে মাথার ত্বকে ক্ষত হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করলে ত্বকে জ্বালাপোড়া হতে পারে। আর তাই মাথায় ক্ষত থাকলে তাদের জন্য ভিনেগার ব্যবহার করা উচিত হবে না।
২। অরগানিক নারকেল তেল
অরগানিক নারকেল তেল নারকেল থেকে সংগ্রহ করে খুব কম প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি করা হয় এবং এতে আলাদা কোনো রাসায়নিক উপাদান যোগ করা হয় না। বাজারে ১০০% বিশুদ্ধ নারকেল তেল কিনতে পাওয়া যায়।
নারকেল তেলে লরিক এসিড থাকে যা মাথার ত্বকে ঈস্ট, ফাংগাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদির সংক্রমণ দূর করতে সাহায্য করে। খুশকি, একজিমা ও মাথার উকুনের ফলে চুলকানি হলে তার জন্য নারিকেল তেল ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায়।
ব্যবহারের নিয়মঃ
পরিমাণমতো নারকেল তেল মাথার ত্বকে আঙ্গুলের ডগা দিয়ে ভালোভাবে ম্যাসাজ করুন। ৩০ মিনিট পর শ্যাম্পু দিয়ে মাথা ধুয়ে ফেলুন। তবে যারা মাথায় তেল রাখতে সমস্যা বোধ করেন না তাদের জন্য শ্যাম্পু ব্যবহার করার আগে নয় বরং শ্যাম্পু ব্যবহারের পর চুল শুকিয়ে তেল ব্যবহার করতে পারেন।
৩। অলিভ অয়েল
চুলের যত্নে অলিভ অয়েল একটি কার্যকর উপাদান। ত্বকে অলিভ অয়েল ব্যবহার করলে তা খুশকি ও চুলকানি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও, অলিভ অয়েল ত্বকের শুষ্কতা, ফাংগাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ দূর করতে পারে।
ব্যবহারের নিয়মঃ
প্রথমে অলিভ অয়েল একটু গরম করে নিন। অতঃপর তেল নিয়ে দুই হাতের তালুতে কিছুক্ষণ ঘসতে হবে। এবার মাথার ত্বকে ভালোভাবে তেল ঘসে লাগান। ৩০ মিনিট পর শ্যাম্পু ব্যবহার করে মাথা পরিষ্কার করুন। স্যালিসাইলিক এসিড (Salicylic acid) সমৃদ্ধ শ্যাম্পু ব্যবহার করা হলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
৪। অ্যালোভেরা জেল
এলোভেরা পাতার ভেতরে থকথকে জেলির মতো উপাদান থাকে যা ত্বক ও চুলের যত্নে খুব উপকারী ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে মাথার ত্বকের শুষ্কতা, প্রদাহ, খুশকি ইত্যাদি দূর করতে অ্যালোভেরা ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও মাথার ত্বকে ফাংগাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ দূর করা এবং মাথা ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে।
ব্যবহারের নিয়মঃ
বাজারে অ্যালোভেরা জেল সমৃদ্ধ শ্যাম্পু কিনতে পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে ভালো হবে বাজার থেকে সরাসরি অ্যালোভেরা পাতা কিনে আনা এবং পাতার ভেতর থেকে জেল সংগ্রহ করে মাথার ত্বকে লাগানো। ১০-২০ মিনিট লাগিয়ে রাখার পর মাথা ধুয়ে ফেলতে হবে।
৫। লেবুর রস
লেবুর রসে এন্টি অক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও সাইট্রিক এসিড রয়েছে যা মাথার ত্বকে ব্যবহার করা হলে খুশকি দূর করতে সাহায্য করবে। লেবুর রস মাথার ত্বকের পিএইচ (pH) মান ঠিক রাখার মাধ্যমে খুশকি হওয়া প্রতিরোধ করে।
ব্যবহারের নিয়মঃ
লেবু চিপে রস বের করে আঙ্গুলের ডগার সাহায্যে মাথার ত্বকে ঘসে লাগান। ৩০ মিনিট পর মাথা পরিষ্কার করে ধুয়ে ফেলুন।
লেবুর রস মাথার ত্বকে ব্যবহার করা হলে তা চুলের জন্য কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। তবে লেবুর রস লাগিয়ে রোদে যাওয়া যাবে না। কারণ এতে চুলের ক্ষতি হতে পারে।
৬। টি ট্রি অয়েল
টি ট্রি অয়েল (Tea tree oil) মাথার ত্বকে ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাস সংক্রমণ দূর করে এবং প্রদাহ নিরাময় করতে সাহায্য করে। খুশকি, উকুন ও Seborrheic dermatitis জনিত মাথার চুলকানিতে টি ট্রি অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে।
ব্যবহারের নিয়মঃ
১০ থেকে ২০ ফোটা পরিমাণ টি ট্রি অয়েল একটু অলিভ অয়েল অথবা নারকেল তেলের সাথে মিশিয়ে নিন। অতঃপর সেই মিশ্রণ মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করে লাগান। ৩০ মিনিট পর শ্যাম্পু ব্যবহার করে মাথা পরিষ্কার করুন।
টি ট্রি অয়েল সরাসরি মাথার ত্বকে ব্যবহার করা যাবে না। অন্য কোনো তেলের সাথে মিশিয়ে নিতে হবে।
৭। জিঙ্ক পাইরিথিওন শ্যাম্পু
গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের মাথায় প্রচুর খুশকি রয়েছে বা Seborrheic dermatitis আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় মাথার ত্বকে দ্বিগুণ মাত্রায় হিস্টামিন থাকে। জিঙ্ক পাইরিথিওন সমৃদ্ধ শ্যাম্পু ব্যবহার করা হলে তা হিস্টামিনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। (Whelan, February 23)
ব্যবহারের নিয়মঃ
জিঙ্ক পাইরিথিওন শ্যাম্পু প্রতিদিন ব্যবহার করা উচিত নয়। বরং সপ্তাহে ২ থেকে সর্বোচ্চ ৩ দিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে।
৮। সেলেনিয়াম সালফাইড
সেলেনিয়াম সালফাইড মাথার ত্বকের কোষের অকাল মৃত্যু ঠেকানোর মাধ্যমে খুশকি দূর করে। এছাড়াও সোরিয়াসিস ও Seborrheic dermatitis এর জন্য এই শ্যাম্পু ব্যবহার করা যেতে পারে।
ব্যবহারের নিয়মঃ
প্রথম সপ্তাহে দুই দিন এবং পরবর্তী সপ্তাহ গুলোতে একদিন করে ১ মাস ব্যবহার করতে হবে।
৯। স্যালিসিলিক অ্যাসিড
সোরিয়াসিস ও Seborrheic dermatitis জনিত মাথার চুলকানি দূর করতে স্যালিসাইলিক এসিড সমৃদ্ধ শ্যাম্পু ব্যবহার করা উপকারী হবে। এছাড়াও এটি ফাংগাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ জনিত চুলকানি দূর করতে সাহায্য করে।
ব্যবহারের নিয়মঃ
পরিমাণমতো শ্যাম্পু নিয়ে মাথায় ভালোভাবে ম্যাসাজ করতে হবে। এই শ্যাম্পু একটানা কয়েকদিন ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। তবে চুলকানি ভালো হয়ে গেলে আর ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই।
১০। কেটোকোনাজোল শ্যাম্পু
মাথার ত্বকে ফাংগাস ইনফেকশন জনিত খুশকি দূর করতে কেটোকোনাজল শ্যাম্পু ব্যবহারে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। এছাড়াও সোরিয়াসিসের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
ব্যবহারের নিয়মঃ
সপ্তাহে একদিন ব্যবহার করতে হবে। চুলকানোর ফলে মাথার ত্বকে ক্ষত হয়ে গেলে বা ফোলাভাব থাকলে এই শ্যাম্পু ব্যবহার করা যাবে না।
সেলেনিয়াম সালফাইড, জিঙ্ক পাইরিথিওন, স্যালিসাইলিক এসিড ও কেটোকোনাজল সমৃদ্ধ শ্যাম্পুগুলো সাধারণ শ্যাম্পুর মতো নয় বরং এগুলো হলো মেডিকেটেড শ্যাম্পু। আর তাই এই শ্যাম্পুগুলো ব্যবহার করে ভালো ফলাফল পাওয়া এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়ানোর জন্য একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে এগুলো ব্যবহার করা উচিত।
মেডিটেশন (Meditation)
নিয়মিত মেডিটেশন করা মানসিক চাপ ও উদ্বিগ্নতা কমায় যা মাথার চুলকানির একটি কারণ। এছাড়াও একজিমা জনিত মাথার চুলকানি দূর করতে মেডিটেশন সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই ব্যাপারে Emory University এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেডিটেশন করা হলে চুলকানির অনুভূতি কিছুটা কমাতে সাহায্য করে। তবে মাথার চুলকানি দূর করার জন্য শুধুমাত্র মেডিটেশনের উপর ভরসা না করে বরং অন্যান্য পদ্ধতি অবলম্বন করার পাশাপাশি মেডিটেশন করতে হবে।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলোতে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। যেমনঃ
- ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে আশানুরূপ ফল পাওয়া না গেলে
- ১ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মাথায় চুলকানি থাকলে
- মাথার ত্বকে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হওয়া
- ব্যথা বা চুলকানি এতো তীব্র যার ফলে ঘুম ও কাজকর্ম ব্যাহত হয়
পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করার মাধ্যমে চিকিৎসক মাথার চুলকানির প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। অতঃপর সেই কারণ অনুযায়ী মেডিকেটেড শ্যাম্পু বা ক্রিম ব্যবহার ও মুখে ওষুধ সেবন করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।
References
Lillis, C. (2019, January 8). Home and natural remedies for an itchy scalp. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/324126
Whelan, C. (2023, February 23). 9 Home Remedies for Itchy Scalp. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/home-remedies-for-itchy-scalp
Last Updated on November 5, 2023
Leave A Comment