ডেঙ্গু জ্বর (Dengue fever) ভাইরাস জনিত একটি রোগ যার লক্ষণগুলো হলো জ্বর, প্রচন্ড শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের কোটরে ব্যথা, ত্বকে র্যাশ হওয়া, দুর্বলতা, ক্লান্তিবোধ, পিপাসা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, ডায়রিয়া ইত্যাদি। সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন পড়ে না। বরং বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করা সম্ভব হয়।
এই অনুচ্ছেদে ডেঙ্গু রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও ডেঙ্গু জ্বরের কোন পর্যায়ে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে সেই সম্পর্কে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
ডেঙ্গু রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। অর্থাৎ শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করা যাবে না। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য করণীয় (কি কি করতে হবে) এবং নিষেধাজ্ঞা সমূহ (যেসব বিষয় এড়িয়ে চলতে হবে) নিচে বর্ণনা করা হয়েছে।
তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর শরীরে পানির চাহিদা বেড়ে যায়। তাই প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। যেমনঃ খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস, দুধ, ভাতের মাড়, স্যুপ ইত্যাদি।
ডেঙ্গু আক্রমণের ফলে খাবারের প্রতি অনীহা দেখা যায়। তবুও জোরপূর্বক খাবার গ্রহণের চেষ্টা করতে হবে। যেমনঃ ভাত, মাছ, ডিম, ডাল, মাংস, দই, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয় ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
ডেঙ্গু রোগীর জন্য পরিমিত মাত্রায় চা খাওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে গ্রীন টি পান করা বেশ উপকারী হবে। তবে অতিরিক্ত চা খাওয়া যাবে না এবং কফি পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
ওষুধ সম্পর্কিত নির্দেশনা
ডেঙ্গু হলো ভাইরাস জনিত (ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাসের নাম হলো Dengue virus, সংক্ষেপে DENV) একটি রোগ যা নিরাময়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। অর্থাৎ ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিহত করার জন্য কোনো এন্টি-ভাইরাল ওষুধ পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাস ধ্বংস করার চেষ্টা করে।
ভাইরাস ধ্বংস করার ক্ষেত্রে এন্টি-বায়োটিক ওষুধ কোনো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না। তাই ডেঙ্গু রোগীর জন্য এন্টি-বায়োটিক সেবন করার প্রয়োজন নেই।
ওষুধের মাধ্যমে ভাইরাস ধ্বংস করা না গেলেও ডেঙ্গুর লক্ষণ নিরাময়ের জন্য ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। বিশেষ করে জ্বর ও ব্যথা নিরাময়ের জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়।
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্যারাসিটামল ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট দৈনিক ৩ থেকে ৪ বার (নূন্যতম ৬ ঘন্টা পর পর) সেবন করতে হবে। ছোট বাচ্চাদেরকে সিরাপ ওষুধ প্যাকেটের গায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী দিতে হবে।
তীব্র জ্বর নিরাময়ের জন্য পায়ুপথে প্যারাসিটামল সাপোজিটরি ব্যবহার করলে দ্রুত জ্বর কমে যাবে। তবে একইসাথে ট্যাবলেট সেবন এবং সাপোজিটরি ব্যবহার করা যাবে না।
প্যারাসিটামল হলো ওটিসি (OTC, Over the counter) মেডিসিনের অন্তর্ভুক্ত একটি ওষুধ যা সেবনের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা আবশ্যক নয়। আমাদের দেশে নিম্নলিখিত নামে ফার্মেসিতে (ওষুধের দোকান) প্যারাসিটামল কিনতে পাওয়া যায়।
- Ace®
- Asta®
- Fast®
- Napa®
- Paret®
ডেঙ্গু রোগীদের জন্য প্যারাসিটামল ব্যতীত অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ (আইবুপ্রোফেন, এসপিরিন ও ক্লোফেনাক) সেবন করা যাবে না। এতে শরীরে রক্তক্ষরণ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। (Mayo Clinic, 2022)
ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মোছা
জ্বর নিরাময়ের একটি সহজ ও কার্যকরী উপায় হলো ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দেওয়া। গামছা বা তোয়ালে পানিতে ভিজিয়ে হালকাভাবে চিপে নিতে হবে। অতঃপর তোয়ালে দিয়ে সারা শরীর ভালোভাবে মুছে দিতে হবে। এছাড়াও তীব্র জ্বরের ক্ষেত্রে মাথায় পানি ঢালা উপকারী হতে পারে।
মশারী ব্যবহার করতে হবে
ডেঙ্গু একটি সংক্রামক রোগ। একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে এডিস মশা (ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক) কামড়ানোর পর সেই মশা সুস্থ ব্যক্তিদের কামড়ানোর মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিদের মশারীর ভেতর থাকতে হবে। সাধারণত রাতের বেলায় ঘুমানোর জন্য মশারী টাঙানো হয়। কিন্তু ডেঙ্গু রোগীদের জন্য দিনের বেলাতেও মশারীর ভেতর থাকতে হবে। কারণ এডিস মশা দিনের বেলায় বেশি কামড়ায়। এডিস মশা রাতেও কামড়াতে পারে, তবে সম্ভাবনা খুবই কম।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মশারীর ভেতর রাখার উদ্দেশ্য মূলত ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা। সুস্থ মানুষদের জন্য দিনের বেলায় মশারীর ভেতর থাকা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে রোগীদের জন্য পূর্ণ বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। তাই রোগীদের মশারী টাঙিয়ে বিছানায় শুয়ে বা বসে থাকতে হবে যেন মশার মাধ্যমে সুস্থদের মাঝে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে একই বিছানায় (মশারী টাঙিয়ে) শুয়ে থাকা, খাবার খাওয়া এবং পোশাক পরিচ্ছদ শেয়ার করার মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে না। তাই সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য ডেঙ্গু রোগীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার প্রয়োজন নেই। বরং যতটা সম্ভব রোগীর সেবাশুশ্রূষা করতে হবে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে?
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ এক সপ্তাহের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়। তবে পরবর্তী বেশ কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত দুর্বলতা ও অরুচি সমস্যা থাকতে পারে। এক সপ্তাহের মধ্যেই ডেঙ্গু জ্বর ভালো হয়ে না গেলে অথবা নিচে উল্লেখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। (CDC, 2019)
- তীব্র পেট ব্যথা
- রাতে ঘুম কম হওয়া
- হার্ট রেট বেড়ে যাওয়া
- প্রচন্ড দুর্বলতা ও ক্লান্তি
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া
- ২৪ ঘন্টায় তিনবারের বেশি বমি হওয়া
- শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হওয়া
ডেঙ্গু জ্বরের জটিল অবস্থায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি রাখার প্রয়োজন পড়ে। চিকিৎসা হিসেবে শিরায় স্যালাইন দেওয়া হয় এবং প্রয়োজনে রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা করতে হয়।
শেষ কথা
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে পুরোপুরি বিশ্রামে থাকতে হবে, প্রচুর তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে এবং জ্বর নিরাময়ের জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হবে।
ভেজা কাপড় দিয়ে রোগীর শরীর মুছে দেওয়া উপকারী হবে। রোগীকে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়াও ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে মশারীর ভেতর রাখতে হবে।
Bibliography
CDC. (2019, October 31). Caring for a Child or Family Member Sick with Dengue. Retrieved from Centers for Disease Control and Prevention: https://www.cdc.gov/dengue/symptoms/family.html
Mayo Clinic. (2022, 10 22). Dengue Fever. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/dengue-fever/diagnosis-treatment/drc-20353084
Last Updated on January 7, 2024
Leave A Comment