খাবারের ৭টি উপাদানের মধ্যে একটি হলো প্রোটিন (Protein) বা আমিষ। অন্যান্য উপাদানগুলো হলো কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেল, ফাইবার ও পানি। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত আমিষ জাতীয় খাবার রাখতে হবে।
আমিষ জাতীয় খাবার শরীরের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, প্রতিদিন কি পরিমাণ প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত, অনেক বেশি পরিমাণে আমিষ জাতীয় খাবার গ্রহণ করা হলে শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
প্রোটিনের গুরুত্ব
প্রোটিন (Protein) শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ প্রোটোস (Protos) থেকে যার অর্থ হলো প্রথম। খাদ্যতালিকায় প্রোটিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। প্রোটিন শরীরের যেসব কাজে অংশগ্রহণ করে তা হলোঃ
- দেহের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধি সাধন
- হরমোন ও এনজাইম উৎপাদন
- নখ, ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য রক্ষা
- দেহে pH ভারসাম্য বজায় রাখা
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো রাখা
- দেহে তরলের ভারসাম্য রক্ষা করা
- পেশির (Muscles) গঠন ও বৃদ্ধি
- ক্যালরি বা শক্তি সরবরাহ করা
প্রতিদিন কতটুকু প্রোটিন খেতে হবে?
শরীরের প্রতি কেজি ওজনের জন্য দৈনিক ০.৮ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। অর্থাৎ ৭০ কেজি ওজনের একজন মানুষের জন্য দিনে ৫৬ গ্রাম প্রোটিন খেতে হবে। (Harvard T.H. Chan, School of Public Health, 2020)
যারা বডি ফিটনেস (মাংসপেশি) বৃদ্ধি করতে চান, এথলেটস, শিশু, গর্ভবতী নারী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য তুলনামূলক বেশি পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে।
প্রোটিন জাতীয় খাবার হলো মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল ও বাদাম। এছাড়াও শাকসবজি ও ফলমূল থেকে সামান্য পরিমাণে প্রোটিন পাওয়া যায়।
উদ্ভিজ্জ উৎসের তুলনায় প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রোটিনের গুণগত মান ভালো।
আমিষ জাতীয় খাবারের পরিমাণ
১ গ্রাম প্রোটিন বলতে ১ গ্রাম খাবার ধরে হিসাব করা যাবে না। অর্থাৎ ৫৬ গ্রাম প্রোটিনের জন্য ৫৬ গ্রাম মুরগির মাংস বা একটি ডিম (৫৬ গ্রাম) খেলে যথেষ্ট হবে না।
কারণ খাবারের পুরোটাই প্রোটিন নয়। যেমনঃ ১টি ডিমের মাত্র ১২.৬ শতাংশ হলো প্রোটিন। মাঝারি সাইজের একটি ডিম (৫৬ গ্রাম ওজন) খেলে মাত্র ৭ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যাবে। আবার মুরগির মাংসের ২৭ শতাংশ হলো প্রোটিন। অর্থাৎ ১০০ গ্রাম মুরগির মাংস খেলে মাত্র ২৭ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যাবে।
আমিষ জাতীয় অন্যান্য খাবারে আমিষের পরিমাণ হলো গরুর মাংসের ২৬ শতাংশ, মাছের ২২ শতাংশ, বাদামের ২০ শতাংশ, দুধের ২.৩ শতাংশ ও ডালের ৯ শতাংশ।
প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন খাওয়া কি ভাল?
খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন জাতীয় খাবার রাখার উপকারিতা হলো প্রচুর ক্যালরি বা এনার্জি পাওয়া যায় এবং বডি ফিটনেস ভালো রাখতে সাহায্য করে।
যারা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান তাদের জন্য কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার (ভাত ও রুটি) কম খেয়ে প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া উপকারী হবে।
কারণ, কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকে একই অনুপাতে ক্যালরি (১ গ্রামে ৪ ক্যালরি) পাওয়া যায়। তবে প্রোটিন হজম ও মেটাবলিসমের জন্য তুলনামূলক অনেক বেশি ক্যালরি খরচ হয়। এছাড়াও প্রোটিন জাতীয় খাবার দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখে যার ফলে সহজে ক্ষুধা পায় না।
অতিরিক্ত প্রোটিন বলতে কি বোঝায়?
প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়া উপকারী তবে অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া যাবে না। শরীরের প্রতি কেজি ওজনের জন্য দৈনিক সর্বোচ্চ ২ গ্রামের বেশি প্রোটিন গ্রহণ করা হলে তা অতিরিক্ত হিসেবে গণ্য হবে।
অর্থাৎ ৭০ কেজি ওজনের একজন মানুষের জন্য দৈনিক সর্বোচ্চ ১৪৪ গ্রামের বেশি প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত হবে না। তবে ব্যক্তিভেদে প্রোটিনের পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে।
যেমনঃ এথলেটস বা বডি ফিটনেস বাড়াতে আগ্রহী এমন ব্যক্তিদের জন্য কিছুটা বেশি পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ করা যেতে পারে। যারা কঠোর পরিশ্রম করেন তাদের ক্ষেত্রে পেশির ক্ষয়পূরণের জন্য তুলনামূলক বেশি পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে।
অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণের ক্ষতিকর দিক
খাবারের কোনো একটি উপাদান অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি খেলে যেসব সমস্যা হতে পারে তা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো। (Kulkarni, 2019)
ওজন বেড়ে যাওয়া
শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য দৈনিক ক্যালরি চাহিদার তুলনায় কিছুটা কম ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। অতিরিক্ত প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়া হলে ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়ায়
প্রোটিন জাতীয় খাবার (বিশেষ করে মাংস) ফ্যাট সমৃদ্ধ হয়ে থাকে যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে হার্টের রোগে (হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পরিপাকতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর
প্রোটিন জাতীয় খাবারগুলোতে ফাইবারের পরিমাণ কম থাকে। ফাইবার থেকে ক্যালরি পাওয়া যায় না তবে পরিপাকতন্ত্রের জন্য ফাইবার খুব উপকারী। কম ফাইবার গ্রহণ করার ফলাফল হিসেবে কোষ্ঠকাঠিন্য সহ কোলন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
লিভারের জন্য ক্ষতিকর
প্রোটিন জাতীয় খাবার মেটাবলিসমের (বিপাক প্রক্রিয়া) ফলে যেসব বাই-প্রোডাক্ট (বিশেষ করে অ্যামোনিয়ার যৌগ) তৈরি হয় তা শরীর থেকে নিষ্কাশনের জন্য লিভার কাজ করে। অতিরিক্ত পরিমাণে প্রোটিন খাওয়া হলে বাই-প্রোডাক্টের পরিমাণ বেশি হয় যার জন্য লিভারের উপর চাপ বেড়ে গিয়ে লিভারের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ কি কিডনির ক্ষতির কারণ?
প্রোটিন জাতীয় খাবার মেটাবলিসমের ফলে নাইট্রোজেন ঘটিত বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয় যা কিডনির মাধ্যমে ছেঁকে শরীর থেকে বের হয়। অতিরিক্ত প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে কিডনির উপর চাপ বেড়ে যায় যা কিডনির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যারা অতিরিক্ত পরিমাণে প্রোটিন জাতীয় খাবার খেয়ে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। (Harvard T.H. Chan, School of Public Health, 2020)
যাদের কিডনিতে কোনো রোগ (ক্রনিক কিডনি ডিজিজ) রয়েছে তাদের জন্য প্রোটিন জাতীয় খাবার পরিমিত পরিমাণে বা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে খেতে হবে।
কিডনি ভালো রাখতে প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়ার পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। কারণ প্রোটিন থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্য কিডনির মাধ্যমে অপসারণের জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়।
প্রোটিন কি হাড়ের ক্ষয় (অস্টিওপোরোসিস) করে?
অস্টিওপোরোসিস হলো হাড় ক্ষয় রোগ যা সাধারণত বয়স্কদের ক্ষেত্রে হতে দেখা যায়। অতিরিক্ত প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়ার সাথে অস্টিওপোরোসিস আক্রান্ত হওয়ার যোগসূত্র নেই বলে গবেষণায় দেখা গেছে। বরং পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়ার অভ্যাস হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। (Gunnars, 2018)
শেষ কথা
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য শরীরের চাহিদা অনুযায়ী খাবারের সব উপাদানগুলো সঠিক অনুপাতে গ্রহণ করতে হবে। প্রোটিন জাতীয় খাবারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় কম খাওয়া যাবে না আবার খুব বেশি পরিমাণে প্রোটিন খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট হিসেবে বাজারে বিভিন্ন প্রোটিন পাউডার কিনতে পাওয়া যায়। শরীরের প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ না করে বরং প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার খাওয়া উত্তম।
References
Gunnars, K. (2018, April 27). Is Too Much Protein Bad for Your Health? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/is-too-much-protein-bad-for-you
Harvard T.H. Chan, School of Public Health. (2020, March 30). When it comes to protein, how much is too much? Retrieved from Harvard T.H. Chan, School of Public Health: https://www.health.harvard.edu/nutrition/when-it-comes-to-protein-how-much-is-too-much
Kulkarni, S. (2019, May 07). Why consuming excessive protein is not good for health. Retrieved from Times of India: https://timesofindia.indiatimes.com/life-style/food-news/why-consuming-excessive-protein-is-not-good-for-health/articleshow/69201294.cms
Last Updated on December 31, 2023
Leave A Comment