পুষ্টিগুণ সম্পন্ন দেশীয় ফল বেল যার বৈজ্ঞানিক নাম হলো Aegle marmelos আর ইংরেজিতে Wood Apple বলা হয়। আপেলের মতো খেতে না হলেও বেলের পুষ্টিগুণ আপেলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এই অনুচ্ছেদে বেল খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে।‌

বেল খাওয়ার উপকারিতা 

বেলের উপরিভাগ শক্ত ও দেখতে সুন্দর না হলেও পাকা বেল খেতে খুব সুস্বাদু হয়। পাকা বেলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, শরীরের জন্য উপকারী নানাবিধ প্রাকৃতিক উপাদান বা ফাইটোকেমিক্যালস (যেমনঃ পলিফেনল, ফ্ল্যাভোনয়েড, ক্যারোটিনয়েডস, অ্যালকালয়েড, ট্যানিন, পেকটিন ইত্যাদি) এবং প্রায় ৩৬ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ৭ শতাংশ সুগার, ৭.৫ শতাংশ প্রোটিন সহ সামান্য পরিমাণে ফ্যাট রয়েছে। এছাড়াও বেল থেকে বিভিন্ন খনিজ উপাদান যেমন- ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, কপার, আয়রন সহ ভিটামিন এ, ভিটামিন বি ও ভিটামিন সি পাওয়া যায়। বেল খাওয়ার মাধ্যমে যেসব উপকারিতা পাওয়া যেতে পারে তা হলোঃ (Sharma, 2022)

১। বেলের রয়েছে এন্টিব্যাকটেরিয়াল ও এন্টি প্যারাসাইটিক গুণাবলী যা ডায়রিয়া ও কলেরা নিরাময়ের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে বাচ্চা, ভ্রমন কারী ব্যক্তি এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য ডায়রিয়া নিরাময়ে বেল খুব উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। 

২। গ্রীষ্মকালীন সময়ে উত্তপ্ত দুপুরে তৃষ্ণা মেটাতে এবং ক্লান্তি দূর করতে বেলের শরবতের জুড়ি নেই। তবে শরবতের মধ্যে চিনির পরিমাণ খুব বেশি হওয়া উচিত নয় অথবা চিনির পরিবর্তে মধু ব্যবহার করতে পারেন। 

৩। বেলের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন সি যা স্কার্ভি রোগ (Scurvy) প্রতিরোধ করে। দাঁত ও মাড়ির সুস্থতার জন্য ভিটামিন সি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভিটামিন। 

৪। পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্রম ভালো রাখতে বেল খুব উপকারী ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত বেল খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর হয় এবং আলসার হওয়ার ঝুঁকি কমে। 

৫। লিভার হলো মানব শরীরের রাসায়নিক ল্যাবরেটরি যেখানে বিভিন্ন ক্রিয়া বিক্রিয়া ঘটে এবং বিষাক্ত উপাদান নিষ্কাশনে সাহায্য করে। অতিরিক্ত পরিমাণে বিষাক্ত উপাদানের প্রভাবে লিভারের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেলের হেপাটো প্রটেকটিভ এক্টিভিটি (Hepatoprotective activity) লিভারের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। 

৬। পাকা বেল অথবা বেলের শরবত রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL- low density lipoprotein) এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও বেলের এন্টি অক্সিডেন্ট গুণাবলী হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়। (Parmar, 2022) 

৭। গবেষণায় দেখা গেছে যে, বেলের এন্টি ডায়াবেটিক গুণাবলী রয়েছে অর্থাৎ রক্তে অতিরিক্ত সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে বেল সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর জন্য বেলের ঔষুধি ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার আরো অধিক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। (Sharma, 2022)

৮। বেশ কয়েকটি গবেষণায় বেলের এন্টি ক্যান্সার (Anticancer) গুণাবলী সম্পর্কে জানা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ের একটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বেল মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। (Sharma, 2022) 

৯। বেলের এন্টি ফাংগাল (Antifungal) গুণাবলী ফাংগাস ইনফেকশন প্রতিরোধ করে। এছাড়াও বেলের মধ্যে থাকা প্রচুর পরিমাণ এন্টি অক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সুস্থ জীবন যাপনে সহায়তা করে থাকে। 

১০। গর্ভবতী নারী এবং শিশুকে বুকের দুধ পান করান এমন মায়েদের জন্য বেল ও বেলের শরবত খাওয়া নিরাপদ। বেল খাওয়ার ফলে মহিলাদের শরীরে প্রোলাক্টিন (Prolactin) হরমোন নিঃসরণ বৃদ্ধি পায় যা স্তনের দুধ বাড়াতে সহায়তা করে। 

বেল খাওয়ার অপকারিতা 

ফল হিসেবে বেল খাওয়ার তেমন কোনো অপকারিতা নেই বললেই চলে। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে বেল খাওয়া যাবে না। বিশেষ করে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য বেল সহ যেকোনো মিষ্টি জাতীয় ফল পরিমিত মাত্রায় খেতে হবে। কারণ, বেলের মধ্যে সুগার রয়েছে যা রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়াও ঔষধ হিসেবে কোনো একটি বিশেষ রোগের চিকিৎসায় বেল খাওয়া বা ব্যবহার করার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি অনুযায়ী কাঁচা ও পাকা বেল, বেলের পাতা এমনকি বেল গাছের ছাল নানাবিধ রোগের জন্য উপকারী বলা হলেও এই ব্যাপারে যথেষ্ট গবেষণার ঘাটতি রয়েছে। বেলের ঔষুধি গুণাগুণ সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে জানা এবং ফার্মাসিউটিক্যালস কাজে ব্যবহার করার জন্য আরো অধিক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। 

দেশীয় ফল হিসেবে বেল কিছুটা অবহেলিত হলেও নিঃসন্দেহে বেল খুব উপকারী একটি ফল যা খাওয়ার মাধ্যমে আমাদের শরীরে নানাবিধ উপকার হয়ে থাকে। আর তাই অন্যান্য ফলের মতো বেল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন অথবা বেলের শরবত বানিয়ে খেতে পারেন।

বেল খাওয়ার সঠিক সময়

সাধারণত গ্রীষ্মকালীন সময়ে পাকা বেল পাওয়া যায়। পাকা বেল বা বেলের শরবত সকাল, দুপুর অথবা বিকাল যে কোনো সময়ে খাওয়া যেতে পারে। খালিপেটে বেল খাওয়া যাবে কিনা এই ব্যাপারে ভিন্নমত রয়েছে তবে কারো ক্ষেত্রে যদি খালিপেটে খেলে কোনো সমস্যা (যেমনঃ এসিডিটি, পেট ফাঁপা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি) না হয় তবে নির্বিঘ্নে খাওয়া যাবে। তবে রাস্তাঘাটে, হাঁটে বাজারে বেলের শরবত না খেয়ে বরং বাসায় খাওয়া উচিত। কারণ, বাইরের পরিবেশে ধুলাবালি ও রোগজীবাণু রয়েছে এবং সেই সাথে বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেই ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যায়। 

References

Parmar, R. (2022, 12 13). 10 Incredible Health Benefits Of Bael fruit. Retrieved from pharmeasy: https://pharmeasy.in/blog/10-incredible-health-benefits-of-bael-fruit/
Sharma, N. (2022, September 17). Aegle marmelos (L.) Correa: An Underutilized Fruit with High Nutraceutical Values: A Review. Retrieved from International Journal of Molecular Sciences: https://www.mdpi.com/1422-0067/23/18/10889

Last Updated on April 12, 2023