ভালো স্বাস্থ্যের জন্য কম-বেশি বাদাম আমরা সবাই খেয়ে থাকি। কিন্তু বাদাম খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা বিষয়ে অনেক কিছুই অজানা। সুস্বাস্থ্য রক্ষায় এবং ত্বকের যত্নে কাজু বাদাম এবং কাঠবাদামের তুলনা নেই। কিন্তু বাদামকে বলা হয় ফাইটিক এসিডের (Phytic Acid) ‘স্টোর হাউজ’। অর্থাৎ এর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইটিক এসিড রয়েছে যা অতিরিক্ত পরিমাণে শরীরে প্রবেশ করলে হজমে ব্যাঘাত ঘটানো সহ শরীরের মধ্যে বিভিন্ন মিনারেলস শোষণে বাঁধার সৃষ্টি করে থাকে।
তবে সঠিক নিয়মে এবং পরিমিত পরিমাণে ফাইটিক এসিড গ্রহণ করলে নানাবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায়। যেমনঃ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং হার্টের রোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। এই অনুচ্ছেদে বাদাম খাওয়ার নিয়ম, দৈনিক সর্বোচ্চ কতটুকু পরিমাণে খাওয়া যাবে এবং সংরক্ষণের সঠিক পদ্ধতি কোনটি সেই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
কাজু বাদাম খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা
কাজু বাদাম (Cashews) পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি খাবার যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে, থায়ামিন, ভিটামিন বি৬, জিংক, আয়রন, ফসফরাস ইত্যাদি রয়েছে। এছাড়াও প্রতি ১ আউন্স (প্রায় ২৮ গ্রাম) কাজুবাদাম থেকে ১৫৭ ক্যালরি, ১২.৪ গ্রাম ফ্যাট, ৫.১৬ গ্রাম প্রোটিন, ৮.৫৬ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট এবং ০.৯৪ গ্রাম ফাইবার পাওয়া যায়। নিয়মিত এই বাদাম খাওয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের জন্য যে সমস্ত উপকারিতা বয়ে আনে তা হলোঃ (Shaikh, 2022)
- ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, কাজুবাদাম রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের (LDL- low density lipoprotein) পরিমাণ কমাতে সহায়তা করে।
- ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগের ঝুকি কমায়
- রক্তস্বল্পতা (Anemia) দূর করে
- এর মধ্যে বিদ্যমান কপার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ভালো রাখে
- ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ রয়েছে যা হাড়ের গঠন মজবুত করে
- এছাড়াও মহিলাদের শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে
কাজু বাদাম খাওয়ার নিয়ম কি?
কাজুবাদামের পুষ্টিগুণের পাশাপাশি কিছু অপকারিতাও রয়েছে। যেমনঃ
- কারো কারো ক্ষেত্রে এলার্জি (Allergy) দেখা যেতে পারে
- ফাইটিক এসিড রয়েছে যা মিনারেলস শোষণে বাধা দেয়
- এর মধ্যে অক্সালেট (Oxalate) রয়েছে যা কিডনিতে পাথর সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে
- উপরিভাগের আস্তরণ সহ খেলে সেক্ষেত্রে urushiol নামক একটি উপাদান শরীরে প্রবেশ করে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর
- লবণ মিশিয়ে খাওয়ার ফলে শরীরের ওজন এবং উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে
আশার কথা হলো এই যে, কতিপয় নিয়ম মেনে কাজুবাদাম খেতে পারলে এই সমস্ত অপকারিতা গুলো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে করণীয় বিষয়াবলী গুলো হলোঃ
✓ এলার্জি দেখা দিলে তাদের জন্য কাজুবাদাম না খাওয়াই ভালো।
✓ কিডনিতে পাথর হওয়া প্রতিরোধে কাজুবাদাম খাওয়ার পাশাপাশি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। কারণ, ক্যালসিয়াম শরীরে অক্সালেট শোষণে বাঁধার সৃষ্টি করে। ক্যালসিয়ামের একটি ভালো উৎস হলো দুধ। তবে দুধ ছাড়াও কিছু কিছু খাবারের মধ্যে ভালো পরিমাণ ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। যেমনঃ কমলা, মিষ্টি আলু, মটরশুটি, ব্রকলি, শালগম, তিল, তিসি, সজনে পাতা ইত্যাদি।
✓ urushiol দূর করতে উপরিভাগের আস্তরণ তুলে ফেলতে হবে। এছাড়াও রাতের বেলায় ভিনেগার মেশানো পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে খাওয়া উত্তম।
✓ ফাইটিক এসিড দূর করার পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে দেখতে পাবেন নিচের দিকে কাঠ বাদাম খাওয়ার নিয়ম চ্যাপ্টারে।
✓ বাদামের সাথে লবণ খাওয়া যাবে না।
কাঠ বাদাম খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা
কাঠবাদাম (Almonds) বা আমন্ড বাদাম খাওয়ার নিয়ম কি সেই বিষয়ে জানার পূর্বে এর উপকারিতা সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া ভালো। কাঠবাদামে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, প্রোটিন, উপকারী ফ্যাট, মিনারেলস, ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ইত্যাদি রয়েছে। নিয়মিত কাঠবাদাম খাওয়ার মাধ্যমে যে সমস্ত উপকারিতা পাওয়া যায় তা হলোঃ
- রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় এবং হার্ট ভালো রাখে
- প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে
- শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে সুগারের মাত্রা কমিয়ে দেয়
- হজম শক্তি বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
- কোলন ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
- পুরুষের যৌন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে
- মহিলাদের মেনোপজকালীন সমস্যা দূর করে
- হাড়ের ঘনত্ব ঠিক রাখে
- রক্তস্বল্পতা দূর করে
- স্মৃতি শক্তি ভালো রাখে
- এছাড়াও ত্বক ও চুলের যত্নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
এতসব উপকারিতা পাওয়ার জন্য অবশ্যই কাঠ বাদাম খাওয়ার নিয়ম কি সেই বিষয়ে সঠিক ধারণা থাকতে হবে। বেশিরভাগ মানুষই যেমন খুশি তেমন ভাবে পানিতে ভিজিয়ে কাঁচা বাদাম অথবা তেলে ভাঁজা বাদাম খেয়ে থাকেন। কিন্তু এটা সঠিক পদ্ধতি নয়। তো চলুন এবার কাঠ বাদাম খাওয়ার নিয়ম কি সেই বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা যাক।
কাঠ বাদাম খাওয়ার নিয়ম
ফাইটিক এসিড মূলত অন্ত্রের (Intestine) মধ্যে মিনারেলস শোষণে বাঁধার সৃষ্টি করে থাকে। যেমনঃ আয়রন, জিংক, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি যার ফলে শরীরে মিনারেলসের ঘাটতি দেখা দেয়। ফাইটিক এসিড দূর করার সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী উপায় হলো বাদাম রাতের বেলায় পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকাল বেলা পানি ফেলে দিয়ে শুধু বাদাম গুলো খাওয়া। (Hingtgen, 2021)
বিস্তারিত বিবরণ:
১টি বড় বাটিতে ২ কাপ বাদাম নিন। এরপর তাতে খাবার পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখুন। এমনভাবে পানি দিন যেন বাদামের ২ ইঞ্চি উপর পর্যন্ত পানি থাকে। এবার ২ চা চামচ সামুদ্রিক লবণ বা খাবার লবণ দিয়ে কিছুক্ষণ নাড়ুন।
কাজু বাদামের ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ ঘন্টা পর পানি ছেঁকে ফেলুন এবং কাঠবাদামের ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা পর পানি ছাঁকুন। লবণ দেয়া পানি ফেলে দিয়ে এবার খুব ভালোভাবে খাবার পানি দিয়ে ধুয়ে খেতে পারেন। অথবা একবার এভাবে প্রস্তুত করে সংরক্ষণ করতে পারেন যা পরবর্তীতে খেতে পারবেন। এক্ষেত্রে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলার পর বাদাম গুলো খুব ভালোভাবে শুকিয়ে নিন। রোদে বা আগুনের হালকা আঁচে অথবা কুকিং শীটে নিয়ে ওভেনেও শুকাতে পারেন। খেয়াল রাখতে হবে যেনো বাদামে পানির কোন ছিটেফোঁটাও না থাকে। অন্যথায় সংরক্ষণ করলে বাদাম নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এবার ভালোভাবে শুকনো বাদামগুলো ১টি এয়ার টাইট পাত্রে রেখে ফ্রিজে সংরক্ষণ করুন। এই প্রক্রিয়ায় বাদাম সংরক্ষণ করে নিয়মিত খেলে এতে ভাল পুষ্টিগুণ পাওয়া যায় এবং পুষ্টিগুণ অটুট থাকে অনেক দিন পর্যন্ত। সেই সাথে এই প্রক্রিয়ায় বাদাম তৈরি করলে এতে ফাইটিক এসিডও ভেঙ্গে যায়। ফলে মিনারেলস শোষণ এবং হজমে সমস্যা হয় না।
উল্লেখ্য ফাইটিক এসিডের মিনারেলস শোষণে বাঁধার ফলে সৃষ্ট সমস্যা বেশি প্রভাব ফেলে নিরামিষাশী (Vegetarians) ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে। আর তাই যারা নিরামিষ আহার করেন তাদের জন্য অবশ্যই উপরে উল্লেখিত পদ্ধতিতে বাদাম খাওয়া উচিত।
এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হলো, খাবার গ্রহণের একদম পর পরই বাদাম না খেয়ে বরং দুইবেলা খাবারের মাঝামাঝি সময়, যেমন সন্ধ্যা কালীন নাস্তা (Snacks) হিসেবে বাদাম খাওয়া উত্তম।
গর্ভাবস্থায় কাঠ বাদাম খাওয়ার নিয়ম
গর্ভাবস্থায় কাঠ বাদাম খাওয়া যাবে কিনা সেটা অধিকাংশ গর্ভবতী মহিলাদের একটি কমন প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো, খাওয়া যাবে এবং তা সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ যদি না আপনার ক্ষেত্রে বাদামে এলার্জি থাকে। বরং গর্ভকালীন সময়ে কাঠবাদাম খাওয়ার মাধ্যমে বেশ কিছু উপকারিতা পাওয়া যায়। যেমনঃ (Chatterjee, 2019)
- প্রচুর পরিমাণে ফলিক এসিড রয়েছে যা গর্ভকালীন সময়ে বাচ্চা সঠিকভাবে বেড়ে উঠার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান
- প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে যা রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে
- গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের পর শরীরের ওজন বেড়ে যেতে দেয় না
- হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে ইত্যাদি
উপকারিতা পাওয়ার জন্য অবশ্যই পরিমিত মাত্রায় বাদাম খেতে হবে। আর পরিমিত মাত্রা বলতে গর্ভবতী মা সহ যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য দৈনিক ১ আউন্স বা প্রায় ২৮ গ্রাম পরিমাণকে আদর্শ মনে করা হয়। সেই সাথে মনে রাখবেন, যে কোনো একধরনের বাদাম অথবা সব ধরনের বাদাম মিলিয়েই যেনো এই মাত্রা ঠিক রাখা হয়। (Shaikh, 2022)
বাদাম নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী একটি খাবার তবে সঠিকভাবে প্রস্তুত করে না খাওয়াতে উপকারের পরিবর্তে উল্টো শরীরের জন্য আরো ক্ষতি হতে পারে। আর তাই বাদাম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন সঠিক নিয়ম অনুসরণ করে। সেই সাথে কিডনি রোগী অথবা ডায়েট কন্ট্রোল করছেন এমন ব্যক্তিদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে বাদাম খাওয়া উচিত।
References
Chatterjee, T. (2019, 8 19). Eating Almonds While Pregnant. Retrieved from firstcry parenting: https://parenting.firstcry.com/articles/a-quick-guide-to-eating-almonds-while-pregnant/
Hingtgen, H. (2021, 5 13). Phytic Acid: Everything You Need to Know. Retrieved from doctorkiltz: https://www.doctorkiltz.com/phytic-acid/
Shaikh, D. J. (2022, 3 10). Why Cashews Are Not Good for You. Retrieved from MedicineNet: https://www.medicinenet.com/why_cashews_are_not_good_for_you/article.htm
Last Updated on May 16, 2023
Leave A Comment