কামরাঙ্গা (বৈজ্ঞানিক নাম Averrhoa carambola) একটি দেশীয় ফল যা সবার কাছেই বেশ পরিচিত। তবে কামরাঙ্গা খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ভূমিকা রাখে নাকি ক্ষতিকর সেই বিষয়টি নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিশেষ করে কামরাঙ্গা খেলে কিডনি নষ্ট হয়ে যায় বলে প্রচলিত ধারণা রয়েছে।
এই অনুচ্ছেদে কামরাঙা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা বিষয়ক (বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য নির্ভর) বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আপনার জন্য কামরাঙ্গা ও বিলিম্বি (কামরাঙ্গার সমগোত্রীয় একটি ফল যার বৈজ্ঞানিক নাম Averrhoa bilimbi) খাওয়া উচিত হবে কিনা এবং খাওয়া গেলেও তা কতটুকু পরিমাণে খেতে হবে সেই ব্যাপারে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
পুষ্টি সংক্রান্ত তথ্য
কামরাঙ্গা টকজাতীয় একটি ফল যা কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। কাঁচা কামরাঙ্গা দেখতে সবুজ বর্ণের এবং পাকা অবস্থায় হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে।
কামরাঙ্গা কাটলে তারা বা স্টারের (Star) মতো দেখা যায় বলে ইংরেজিতে স্টার ফ্রুট (Star fruit) বলা হয়।
কামরাঙ্গা খুবই কম ক্যালোরিযুক্ত একটি ফল। একটি মাঝারি সাইজের (৯১ গ্রাম ওজনের) কামরাঙ্গায় ৬ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে যা ২৮ ক্যালরি সরবরাহ করে। তবে কামরাঙ্গা প্রচুর ভিটামিন (বিশেষ করে ভিটামিন সি) ও এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল। (Gunnars, 2023)
ফাইবার | ৩ গ্রাম |
প্রোটিন | ১ গ্রাম |
ভিটামিন সি | দৈনিক চাহিদার ৫২ শতাংশ |
ভিটামিন বি৫ | দৈনিক চাহিদার ৪ শতাংশ |
ভিটামিন বি৯ | দৈনিক চাহিদার ৩ শতাংশ |
কপার | দৈনিক চাহিদার ৬ শতাংশ |
পটাশিয়াম | দৈনিক চাহিদার ৩ শতাংশ |
ম্যাগনেসিয়াম | দৈনিক চাহিদার ২ শতাংশ |
স্বাস্থ্য উপকারিতা
কামরাঙ্গায় বিদ্যমান ভিটামিন সি ও এন্টি-অক্সিডেন্ট শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। আর ইমিউন সিস্টেম রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের (এলডিএল) মাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং সেই সাথে উপকারী কোলেস্টেরলের (এইচডিএল) মাত্রা কমে যাওয়ার ফলে হার্টের রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে যাদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি তাদের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন দেখা যায়। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, কামরাঙ্গা খাওয়া রক্তে উপকারী কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং ক্ষতিকর কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। (Lakmal, 2023)
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়
প্রাণীদের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে যে, কামরাঙ্গা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। তবে এই ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে জানার জন্য মানুষের উপর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। (Lakmal, 2023)
কামরাঙ্গার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খুবই কম। অর্থাৎ কামরাঙ্গা খাওয়ার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় না। এই দিক বিবেচনায় ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য স্ন্যাকস হিসেবে অন্যান্য ফলের তুলনায় কামরাঙ্গা বেশ উপযোগী।
তবে ডায়াবেটিসের রোগীদের কিডনির সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। আর কামরাঙ্গা খাওয়ার সাথে কিডনির সমস্যা হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কিডনির সমস্যার বিষয় বিবেচনায় কামরাঙ্গা না খাওয়াই উত্তম।
প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে
কামরাঙ্গায় বিদ্যমান এন্টি-অক্সিডেন্ট প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ শরীরের ফ্রি-রেডিক্যালের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে, কোষের অকাল মৃত্যু প্রতিরোধ করে এবং প্রদাহ নিরাময় করে। প্রদাহ জনিত বিভিন্ন রোগের আক্রমণ ও লক্ষণ নিরাময়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যেমনঃ আর্থ্রাইটিস, লিভারের প্রদাহ, আলজেইমার্স ইত্যাদি।
অন্যান্য
ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের ইনফেকশনের ফলে বিভিন্ন রোগ হয়। ইনফেকশন দূর করার ক্ষেত্রে কামরাঙ্গায় বিদ্যমান ভিটামিন সি ও এন্টি-অক্সিডেন্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আলসার হওয়ার ঝুঁকি কমাতে কামরাঙ্গার ভূমিকা রয়েছে। ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য কামরাঙ্গা খাওয়া উপকারী হতে পারে। কামরাঙ্গায় বিদ্যমান এন্টি-অক্সিডেন্ট ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি
কামরাঙ্গায় বিদ্যমান ক্যারাম্বক্সিন (Caramboxin) ও অক্সালেট (Oxalate) নামক টক্সিক উপাদান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষ করে যাদের কিডনিতে সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই টক্সিক উপাদানগুলো কিডনির মাধ্যমে ছেঁকে শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না। যার ফলে কিডনি আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং স্নায়ুতন্ত্রের উপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
বিলিম্বি
কামরাঙ্গার মতোই টক স্বাদ জাতীয় একটি ফল হলো বিলিম্বি। পুষ্টিগুণ বিবেচনায় কামরাঙ্গা ও বিলিম্বি প্রায় একই রকম। সেই সাথে কামরাঙ্গার মতোই বিলিম্বি টক্সিক উপাদান সমৃদ্ধ যা কিডনি রোগীদের জন্য খাওয়া ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। (Alhassan, 2016)
কিভাবে কামরাঙ্গা খাবেন?
কামরাঙ্গা আচার বানিয়ে খাওয়া যেতে পারে। তবে কাঁচা বা পাকা কামরাঙ্গা রান্না না করে সরাসরি খেলে সবচেয়ে বেশি উপকারিতা পাওয়া যায়। কারণ এতে আগুনের তাপে ভিটামিন ও এন্টি-অক্সিডেন্ট নষ্ট হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে না।
সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য পরিমিত পরিমাণে কামরাঙ্গা খাওয়া নিরাপদ ও উপকারী হবে। তবে প্রতিদিন খাওয়া যাবে না। অর্থাৎ একটানা দীর্ঘদিন পর্যন্ত কামরাঙ্গা খাওয়া যাবে না বরং মাঝেমধ্যে খেতে হবে।
একদিনে ২টার বেশি কামরাঙ্গা খাওয়া উচিত হবে না। এছাড়াও খালিপেটে কামরাঙ্গা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
যাদের কিডনির সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য কামরাঙ্গা ও বিলিম্বি খাওয়া যাবে না। এছাড়াও যাদের কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে তাদের জন্য কামরাঙ্গা ও বিলিম্বি এড়িয়ে যাওয়া উচিত। যেমনঃ
- উচ্চ রক্তচাপের রোগী
- ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তি
- যাদের কিডনি রোগের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে
গর্ভবতী মা ও যাদের দীর্ঘমেয়াদী কোনো ওষুধ সেবন করতে হয় তাদের জন্য কামরাঙ্গা খাওয়ার ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
শেষ কথা
কামরাঙ্গা সহজলভ্য একটি ফল যা ভিটামিন ও এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য কামরাঙ্গা খেলে কিডনি নষ্ট হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। বরং মাঝেমধ্যে কামরাঙ্গা (পরিমিত পরিমাণে অর্থাৎ দিনে ১/২ টি) খাওয়া যেতে পারে।
তবে যাদের কিডনিতে সমস্যা রয়েছে বা যারা কিডনি রোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন তাদের জন্য কামরাঙ্গা ও কামরাঙ্গা জাতীয় ফল (বিলিম্বি) খাওয়া যাবে না।
Bibliography
Alhassan, A. M. (2016, 12). Averrhoa bilimbi Linn.: A review of its ethnomedicinal uses, phytochemistry, and pharmacology. Retrieved from NCBI: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5314823/
Gunnars, K. (2023, March 08). Star Fruit 101 — Is It Good For You? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/star-fruit-101
Lakmal, K. (2023, January 23). Nutritional and medicinal properties of Star fruit (Averrhoa carambola): A review. Retrieved from Wiley Online Library: https://onlinelibrary.wiley.com/doi/full/10.1002/fsn3.2135
Last Updated on January 7, 2024
Leave A Comment