কিডনিতে বিভিন্ন ধরনের রোগ হতে পারে। তবে সাধারণভাবে কিডনি রোগী বলতে ক্রনিক কিডনি ডিজিজে (কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া) আক্রান্ত ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। এমতাবস্থায় শরীর থেকে পানি সহ অপ্রয়োজনীয় উপাদান (খাবার থেকে তৈরি বর্জ্য) কিডনির মাধ্যমে বের করে দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই কিডনি‌ রোগীদের জন্য খাবার গ্রহণের ব্যাপারে কিছু নিয়ম নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হয়।

কিডনির অবস্থা বিবেচনায় ব্যক্তিভেদে খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কিত নির্দেশনা কিছুটা ভিন্নতর হতে পারে যা একজন পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হয়ে জানতে হবে। সাধারণভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য যেসব খাবার উপকারী মনে করা হয় আর যেগুলো বর্জন করতে হবে সেই সম্পর্কে জানতে চাইলে এই অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

১। ডিমের সাদা অংশ

কিডনি রোগীদের জন্য প্রোটিন জাতীয় খাবার কম খেতে বলা হয়। কারণ প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকে তৈরি বর্জ্য অপসারণ করা কিডনির জন্য কষ্টসাধ্য কাজ হয়ে দাঁড়ায়। তবে একদম বর্জন করা যাবে না বরং পরিমিত পরিমাণে প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে।

ডিমের সাদা অংশে পানি ও প্রোটিন ব্যতীত অন্য কোনো উপাদান থাকে না। তাই কিডনি রোগীদের জন্য প্রোটিনের উৎস হিসেবে সিদ্ধ ডিমের সাদা অংশ খাওয়া নিরাপদ হবে। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় এক থেকে দুইটি ডিমের সাদা অংশ রাখা যেতে পারে।

ডিমের কুসুম না খাওয়াই ভালো। কারণ কুসুমে প্রচুর ফ্যাট (কোলেস্টেরল) সহ পটাশিয়াম ও‌‌ ফসফরাস থাকে যা কিডনির জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

২। মুরগির মাংস

chicken meat

কিডনি রোগীদের জন্য প্রোটিনের উৎস হিসেবে মুরগির মাংস খাওয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। অর্থাৎ দিনে একবেলার খাবারে ২/৩ টুকরো (১০০ গ্রাম) মুরগির মাংস খেতে হবে।

স্বাস্থ্যকর উপায়ে মুরগির মাংসের স্যুপ (চিকেন স্যুপ) বানিয়ে খাওয়া যাবে। তবে মুরগির চামড়া খাওয়া যাবে না। কারণ চামড়ায় প্রচুর পরিমাণ ফ্যাট থাকে। 

গরু ও খাসির মাংস থেকে প্রচুর প্রোটিন পাওয়া যায়। তবে কিডনি রোগীদের জন্য প্রোটিন জাতীয় খাবার হিসেবে গরু ও খাসির মাংস খাওয়া যাবে না।

৩। মাছ

প্রোটিন ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের উৎস হিসেবে খাদ্যতালিকায় মাছ রাখতে পারেন। দিনের একবেলার খাবারে ২ টুকরো (১০০ গ্রাম পরিমাণ) মাছ খাওয়া যেতে পারে।

দৈনিক সবমিলিয়ে (ডিম, মুরগির মাংস ও মাছ) প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ শরীরের প্রতি কেজি ওজনের অনুপাতে ০.৫ থেকে ০.৮ গ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়। 

৬০ কেজি ওজনের মানুষের জন্য দিনে ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ গ্রাম প্রোটিন খেতে হবে ‌যা ১ থেকে ২ টি ডিমের সাদা অংশ এবং ২ টুকরো মাছ অথবা ২ থেকে ৩ টুকরো মুরগির মাংস থেকে পাওয়া যাবে।

৪। কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার 

শরীরের ক্যালরি চাহিদার বেশিরভাগ অংশ পূরণের জন্য শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হয়। কিডনি রোগের পাশাপাশি ডায়াবেটিস না‌ থাকলে সেক্ষেত্রে শর্করা গ্রহণের ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার প্রয়োজন হয় না।

তবে শর্করা জাতীয় খাবার ফাইবার সমৃদ্ধ হতে হবে। যেমনঃ লাল আটার রুটি, ওটস, সাগু ইত্যাদি। আর ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকলে সেক্ষেত্রে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য শর্করা জাতীয় খাবার (বিশেষ করে সাদা ভাত) পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে।

৫। ফলমূল

সুস্থ মানুষের জন্য প্রচুর পরিমাণ ফলমূল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সবধরনের ফলমূল খাওয়া নিরাপদ হবে না। আবার কিছু ফলমূল উপকারী ভূমিকা পালন করে। (Khatri, 2022)

যেসব ফলমূল প্রচুর পটাশিয়াম সমৃদ্ধ সেগুলো বর্জন করতে হবে। যেমনঃ পাকা কলা, ডালিম, লেবু, আমড়া, বড়ই, আম, কাঁঠাল, বাদাম, খেজুর, নারিকেল ইত্যাদি। 

আপেল, পেয়ারা, আনারস, পাকা পেঁপে, জাম, কমলা, বেল, তরমুজ ইত্যাদি খাওয়া যাবে। তবে অবশ্যই অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া যাবে না।

সাধারণভাবে ডাবের পানি রোগীর পথ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও কিডনি রোগীদের জন্য ডাবের পানি খাওয়া যাবে না। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে যা কিডনির জন্য ক্ষতিকর।

৬। শাকসবজি

vegetables

কিডনি রোগীদের জন্য নিরাপদ সবজি হলো লাউ, কুমড়া, বেগুন, পটল, ধুন্দল, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, শশা, করলা, কাকরোল, ফুলকপি, ব্রকলি, কাঁচা পেঁপে, কাঁচা কলা, লাল শাক ইত্যাদি। 

সবুজ পাতা বিশিষ্ট শাক খাওয়া যাবে না। যেমনঃ পালংশাক, পুঁইশাক ও ধনেপাতা। এছাড়াও আরো যেসব শাকসবজি বর্জন করতে হবে তা হলো ঢেঁড়স, শিম, বরবটি, কচু, আলু, মিষ্টি আলু, মুলা, গাজর ইত্যাদি।

কিডনি রোগীদের জন্য শাকসবজি সিদ্ধ করে পানি ফেলে দিয়ে রান্না করা উত্তম হবে।

ডালজাতীয় খাবার (ছোলা, মটরশুটি ও মসুর ডাল) এবং কাঁচা সবজি (সালাদ) কম খেতে হবে।

৭। অলিভ ওয়েল  

রান্নার কাজে অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে পারলে ভালো। অলিভ অয়েল (স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, ভিটামিন ও প্রদাহ নাশক গুণাবলী সমৃদ্ধ) কিডনির জন্য উপকারী ভূমিকা পালন করে। (Jones, 2023)  

তবে অলিভ অয়েলের দাম কিছুটা বেশি। তাই সয়াবিন বা সূর্যমুখী তেল ব্যবহার করা যেতে পারে। তেলের পরিমাণ অবশ্যই বেশি হওয়া যাবে না বরং পরিমিত পরিমাণে তেল ব্যবহার করতে হবে।

৮। মাশরুম 

কিডনি রোগীদের জন্য স্ন্যাকস হিসেবে বাদাম ও বীজ (কুমড়োর বিচি) জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না। তবে স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস হিসেবে মাশরুম খাওয়া যেতে পারে যা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। 

যেসব মাশরুম বিক্রি করা হয় সেগুলো চাষকৃত অর্থাৎ বাড়ির আশেপাশে এমনিতেই জন্মানো মাশরুম নয়। ব্যাঙের ছাতা নামে পরিচিত মাশরুম খাওয়া যাবে না। কারণ এগুলো বিষাক্ত ও ক্ষতিকর।  

৯। ইয়োগার্ট

স্বাস্থ্যকর আরেকটি স্ন্যাকস হতে পারে টক দই বা ইয়োগার্ট। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় একবাটি টক দই বা ইয়োগার্ট রাখা যাবে।  

স্বাদ বৃদ্ধি করার জন্য টক দই বা ইয়োগার্ট এর সাথে কিছু ফলমূল (যেসব ফলমূল নিরাপদ হিসেবে গণ্য) যোগ করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে যে, কিডনি রোগীদের জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া যাবে না। 

১০। পানি

কিডনির অবস্থা বিবেচনায় পানি খাওয়ার পরিমাণ চিকিৎসক নির্ধারণ করে দেবেন। সাধারণত দিনে এক থেকে দেড় লিটারের বেশি পানি পান করতে নিষেধ করা হয়।

কারণ যতবেশি পরিমাণে পানি খাওয়া হবে কিডনির ততবেশি কাজ করা লাগবে। তাই অতিরিক্ত পরিমাণে পানি খাওয়া যাবে না। 

চা, কফি, দুধ, শরবত ও স্যুপ পানির পরিমাণের ক্ষেত্রে হিসাব করতে হবে। ফলের জুস, কোমল পানীয়, অ্যালকোহল ইত্যাদি গ্রহণ করা যাবে না।

শেষ কথা

খাবার কিডনি রোগ ভালো করতে পারে না। তবে কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে দীর্ঘজীবী হওয়ার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার গুরুত্ব অপরিসীম। 

পরিমিত কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট ও প্রোটিন সহ যেসব ফলমূল ও শাকসবজি কিডনির জন্য ক্ষতিকর নয় সেগুলো খেতে হবে। এছাড়াও অতিরিক্ত লবণ খাওয়া যাবে না এবং সকল ফাস্টফুড বর্জন করতে হবে। 

Bibliography

Jones, J. (2023, May 26). The 20 Best Foods for People with Kidney Disease. Retrieved from https://www.healthline.com/nutrition/best-foods-for-kidneys

Khatri, M. (2022, August 29). Chronic Kidney Disease. Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/a-to-z-guides/diet-and-chronic-kidney-disease

Last Updated on January 3, 2024