বর্তমানে অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই পেটে অতিরিক্ত মেদ (ভুঁড়ি) দেখা যায় যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। অর্থাৎ ভুঁড়ি থাকা মানে হলো হার্টের রোগ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি রয়েছে। এছাড়াও ভুঁড়ি সৌন্দর্য হানিকর একটি বিষয়। 

সাধারণত যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে ভুঁড়ি দেখা যায়। তাই ভুঁড়ি কমানোর জন্য শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী। এই অনুচ্ছেদে ভুঁড়ি কমানোর ১০টি সেরা উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। 

১। উচ্চ ক্যালোরি সমৃদ্ধ খাদ্য পরিহার

শরীরের সকল কার্যক্রমের জন্য ক্যালরি দরকার হয় যা খাবার থেকে পাওয়া যায়। দৈনিক ক্যালরি চাহিদার তুলনায় বেশি খাবার গ্রহণ করা হলে অতিরিক্ত ক্যালরি শরীরে চর্বি হিসেবে জমা হয় এবং ওজন বেড়ে যায়।

ভুঁড়ি কমানো ও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য দৈনিক চাহিদার তুলনায় কম ক্যালরি সম্পন্ন খাবার খেতে হবে। এতে করে শরীরে জমে থাকা ফ্যাট ভেঙে ক্যালরি উৎপন্ন হবে।  

দৈনিক চাহিদার তুলনায় ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫০ ক্যালরি কম গ্রহণ করা যাবে যা ওজন কমানোর আদর্শ পরিসীমা। খুব বেশি পরিমাণ ক্যালরি বর্জন করলে শরীরের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। (Bjarnadottir, 2023)

২। প্রোটিনযুক্ত খাদ্য সেবন করুন

প্রোটিন জাতীয় খাবার হজম হতে বেশি সময় লাগে যার ফলে দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা থাকে। এতে ঘন ঘন খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। 

প্রোটিন থেকে তুলনামূলক কম ক্যালরি পাওয়া যায় যা শরীরের ওজন কমানোর পক্ষে সুবিধাজনক। এছাড়াও মাংসপেশীর ক্ষয়রোধে প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বাস্থ্যকর প্রোটিন রাখতে হবে। যেমনঃ মাছ, সিদ্ধ ডিম, মুরগির মাংস (চামড়া ছাড়া), বাদাম, মসুর ডাল, মটরশুটি, শিমের বিচি ইত্যাদি। 

দুধ, দুগ্ধজাত খাবার ও গরু্র মাংস ভালো মানের প্রোটিন।‌ তবে এতে অনেক ফ্যাট রয়েছে যা উচ্চ ক্যালরি সরবরাহ করে। তাই এগুলো যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে। ফ্যাট-ফ্রি বা লো-ফ্যাট দুধ খাওয়া যেতে পারে।

৩। ফাইবার সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ 

ফাইবার কোনো ক্যালরি সরবরাহ করে না এবং ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখে। পেটের চর্বি ও শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর ক্ষেত্রে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।

প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। যেমনঃ লাল আটার রুটি, যবের ছাতু, বাদামী চালের ভাত, ওটস, ফলমূল, শাকসবজি, বাদাম ইত্যাদি। 

চীয়া বীজ ও ইসবগুলের ভুসিতে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার রয়েছে। পেটের অতিরিক্ত মেদ কমানোর জন্য সকালে ও রাতে একগ্লাস পানিতে দুই চা চামচ চীয়া বীজ বা ইসবগুলের ভুসি গুলিয়ে খাওয়া উপকারী হবে।  

৪। কার্বোহাইড্রেট সেবন পরিহার করুন

আমাদের দেশের প্রধান খাদ্য হলো সাদা ভাত যা একটি পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট। অর্থাৎ এই ধরনের খাবার প্রচুর ক্যালরি সরবরাহ করে এবং শরীরে চর্বি জমা হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

তিনবেলা ভাত খাওয়ার সাথে অভ্যাস্ততা, চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলো পছন্দের তালিকার শীর্ষে রাখা, বিস্কুট (পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট) খাওয়ার প্রবণতা ইত্যাদির ফলে ভুঁড়ি ও ওজন বেড়ে যেতে দেখা যায়।

ভুঁড়ি কমানো ও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট (সাদা ভাত, বিস্কুট, চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার) যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে। লাল আটা ও বাদামী চালের ভাত খাওয়া যেতে পারে।  

৫। নিয়মিত ব্যায়াম করুন 

যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন (কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ) তাদের ক্ষেত্রে ভাত খাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকা সত্ত্বেও ভুঁড়ি দেখা যায় না। কারণ পরিশ্রম করার ফলে পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট থেকে পাওয়া ক্যালরি ব্যয় হয়ে যায় এবং ভুঁড়ি বাড়ে না। 

যাদের শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় না তাদের ক্ষেত্রে ভুঁড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। পেটের মেদ কমানোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো ব্যায়াম করা জরুরী নয়।‌ বরং যেকোনো ধরনের ব্যায়াম করলেই তা ভুঁড়ি কমাতে সহায়তা করবে। 

প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট (সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন) ব্যায়াম করতে হবে। 

৬। নিয়মিত হাটুন 

সব বয়সের মানুষের জন্য নিরাপদ একটি ব্যায়াম হলো হাঁটাহাঁটি করা। নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস ভুঁড়ি কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

স্বাভাবিক গতিতে মাত্র ৩০ মিনিট হাঁটলে ১০০ ক্যালরি বার্ন (ব্যয়) হয়। আর দ্রুত গতিতে হাঁটা হলে আরো বেশি ক্যালরি বার্ন হয়। (FIRMAN, 2022)  

ভুঁড়ি ও ওজন কমানোর জন্য নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করতে হবে। নিরাপত্তার জন্য আরামদায়ক জুতা (স্পোর্টস সু) ও ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করতে হবে। এছাড়াও পানির বোতল সাথে রাখতে পারলে ভালো যেন পিপাসা লাগলে পানি পান করা যায়। 

৭। প্রচুর পানি পান করুন 

পানি পান করার কোনো বিকল্প নেই। ব্যায়াম করা থেকে শুরু করে খাবার খাওয়া প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে পানির প্রয়োজন। ব্যায়ামের শুরুতে ও শেষে পানি পান করতে হবে যেন শরীরে পানির ঘাটতি না হয়।

খাবার খাওয়ার আগে পানি পান করলে কম খাবার খেলেই পেট ভরে যাবে যা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সুবিধাজনক। একজন মানুষের দৈনিক ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করতে হবে। 

পানীয় হিসেবে চা ও কফি পান করা যেতে পারে।‌‌ তবে তাতে চিনি যোগ করা যাবে না। কারণ চিনি প্রচুর ক্যালরি সম্পন্ন একটি খাবার যা শরীরে চর্বি জমা হওয়ার অন্যতম প্রধান উপাদান।

ভুঁড়ি কমানোর জন্য গ্রিন টি পান করা হলে সবচেয়ে বেশি উপকারিতা পাওয়া যাবে। গ্রিন টি কম ক্যাফেইন সম্পন্ন তবে এতে প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে যা ভুঁড়ি কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।  

৮। প্রোবায়োটিকস সেবন করুন 

পেটের (অন্ত্র) ভেতর বসবাসকারী উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে প্রোবায়োটিকস (Probiotics) বলা হয়। ভুঁড়ি কমাতে ও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকস সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

প্রোবায়োটিকস সমৃদ্ধ খাবার হলো টক দই, ইয়োগার্ট, আপেল সিডার ভিনেগার ইত্যাদি। খাদ্যতালিকায় প্রোবায়োটিকস সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। বিশেষ করে টক দই বা ইয়োগার্ট প্রতিদিন খেতে পারলে ভালো। 

এছাড়াও প্রোবায়োটিকস সাপ্লিমেন্ট কিনতে পাওয়া যায় যা চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে সেবন করা উচিত।

আপেল সিডার ভিনেগারের উপকারিতা, খাওয়ার নিয়ম এবং বাড়িতে তৈরি করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।‌ 

৯। কার্বনেটেড চিনিযুক্ত পানীয় পরিহার করুন 

কার্বোনেটেড পানীয় বা কোমল পানীয়তে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে। স্বাস্থ্যের জন্য কোমল পানীয় মোটেও উপকারী নয়।‌ বরং কোমল পানীয় পান করার ফলে পেটে মেদ জমা ও শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে।

তাই কোমল পানীয় পানের অভ্যাস যতটা সম্ভব পরিহার করতে হবে। এছাড়াও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করা জরুরী। মদ্যপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে

১০। স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করুন

মানসিক চাপের (স্ট্রেস) ফলে অ্যাডরেনাল গ্ল্যান্ড থেকে কর্টিসল হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যায়। অতিরিক্ত কর্টিসলের প্রভাবে ক্ষুধা বেড়ে যায় এবং শরীরে চর্বি জমা হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।

তাই মানসিক চাপ যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ইয়োগা ও মেডিটেশন সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও প্রয়োজনে একজন সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে। 

শেষ কথা

সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম করার মাধ্যমে ভুঁড়ি ও শরীরের ওজন কমানো সম্ভব।‌ এছাড়াও দৈনিক ৭ থেকে ৯ ঘন্টা ঘুমাতে হবে যা ওজন নিয়ন্ত্রণ ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় একটি বিষয়।

References

Bjarnadottir, A. (2023, February 07). The 29 Best Ways to Get a Flat Stomach. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/get-a-flat-stomach

FIRMAN, T. (2022, October 12). How Many Calories Do You Burn From Walking? Here’s How to Calculate. Retrieved from Good Housekeeping: https://www.goodhousekeeping.com/health/fitness/a47008/calories-burned-from-walking/

Last Updated on January 2, 2024