আমাদের আশেপাশে এমন অনেকেই আছেন যারা গ্যাসের সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। কারণ পেট ফাঁপা কিংবা গ্যাস হওয়া খুব কমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা যা যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রেই হতে পারে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকি রয়েছে তেমনি কিছু কিছু খাবার কিংবা অনিয়ম এই সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা আরো বৃদ্ধি করে থাকে।

এই অনুচ্ছেদে গ্যাসের সমস্যার কারণ, লক্ষণ এবং গ্যাসের সমস্যায় করণীয় বিষয়াবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সেই সাথে গ্যাসের সমস্যা দূর করার ঘরোয়া উপায় (ওষুধ ছাড়াই সমাধান) সম্পর্কিত হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা সমূহ জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

গ্যাসের সমস্যা কেন হয়?

পাকস্থলীতে খাবার হজমের জন্য স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী এসিড নিঃসরণ হয়। তবে কখনো এই এসিড নিঃসরণের পরিমাণ খুব বেড়ে গেলে অথবা এসিড খাদ্যনালী (Esophagus) বেয়ে উপরে উঠে আসলে তখন গ্যাসের সমস্যা দেখা যায়। এক্ষেত্রে কারণ হিসেবে দায়ী মনে করা হয়-

  • পাকস্থলী ধীর গতিতে খালি হওয়া
  • ভারী আহার করা (Heavy diet)
  • মশলাযুক্ত/তৈলাক্ত খাবার খাওয়া
  • ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস
  • অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যাসিডযুক্ত খাবার খাওয়া
  • পরিপাক নালীতে বাতাস আটকে যাওয়া
  • হায়াটাল হার্নিয়া (Hiatal hernia) 
  • অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা
  • কতিপয় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

এছাড়াও যারা প্রতিনিয়ত খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশ অনিয়ম করেন, গর্ভবতী মহিলা, স্থূল ব্যক্তি (Obese) অর্থাৎ যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে গ্যাসের সমস্যা হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে।

গ্যাসের সমস্যার লক্ষণ

  • বুক জ্বালাপোড়া (Heartburn)
  • টক ঢেঁকুর উঠে
  • পেট ফাঁপা (Flatulence)
  • বমি বমি ভাব (Nausea)
  • খাবারের প্রতি অনীহা
  • খাবার গিলতে কষ্ট হতে পারে
  • মুখে দুর্গন্ধ থাকতে পারে ইত্যাদি

গ্যাসের সমস্যা দূর করার ঘরোয়া উপায়

গ্যাসের সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে ওষুধ সেবন করা ছাড়াও বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে বলে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাম্প্রতিক সময়ের একটি প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছে। চলুন এই পর্যায়ে সেই বিষয়গুলো সহজভাবে বুঝতে চেষ্টা করি। (Harvard Medical School, 2021)

✓ একবারে ভারী আহার করা তথা পেট ভরে খাওয়া যাবে না বরং অল্প পরিমাণে বারে বারে খেতে হবে।

✓ দ্রুত খাবার খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করুন। কারণ খাবার আস্তে ধীরে চিবিয়ে খেলে তাতে হজমে সুবিধা হয়।

✓ খাওয়ার ঠিক পরেই শোয়া যাবে না। কারণ তাতে এসিড পাকস্থলী থেকে খাদ্যনালী বেয়ে উপরে উঠে আসার সুযোগ পায়।

✓ রাতের খাবার ঘুমাতে যাওয়ার ২ থেকে ৩ ঘন্টা আগে খাওয়া উচিত। সেই সাথে খাওয়ার পর দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

✓ ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে অবশ্যই তা পরিত্যাগ করতে হবে।

✓ খাবার খাওয়ার ১ থেকে ২ ঘন্টার মধ্যে ব্যায়াম না করাই উত্তম। বিশেষ করে ভারী প্রকৃতির ব্যায়াম (Vigorous exercises) থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।

✓ যদি শরীরের ওজন অতিরিক্ত হয়ে থাকে তবে তা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা শুরু করুন।

✓ বিছানার মাথার দিকটা পায়ের তুলনায় সামান্য উঁচু (৬ থেকে ৮ ইঞ্চি) হওয়া ভালো। তবে মনে রাখবেন, শুধুমাত্র উঁচু বালিশ ব্যবহার করলে যেমন মাথা উঁচু হয় তেমনটি নয়, বরং শরীরের উপরের অংশ (upper body) উঁচু রাখার জন্য বিছানার নিচে কিছু দিতে হবে।

✓ কিছু কিছু ওষুধ রয়েছে বিশেষত ব্যথার ওষুধ ও এন্টি বায়োটিক সেবনের পর গ্যাসের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে চিকিৎসকেরা এর পাশাপাশি গ্যাসের ওষুধ সেবনের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে নিজে নিজে গ্যাসের ওষুধ বাদ না দিয়ে বরং অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলা উচিত।

গ্যাসের সমস্যা হলে কি খাওয়া উচিত?

গ্যাসের সমস্যা হলে কি খাওয়া উচিত

গ্যাসের সমস্যা সমাধানে খাবারের ব্যাপারে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক Dr. Ekta Gupta এর নির্দেশনা হলো- (Gupta, n.d.)

কি কি খাবেন: 

  • আঁশযুক্ত খাবার বিশেষ করে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল
  • উচ্চ pH মানের খাবার অর্থাৎ যাদের এসিক মান কম। যেমনঃ কলা, বাঙ্গি, বাদাম ও ফুলকপি।
  • প্রচুর পানি সমৃদ্ধ খাবার। যেমনঃ শসা, লেটুস, তরমুজ, আদা পানি, আপেল সিডার ভিনেগার ইত্যাদি‌।

কি কি খাবেন না?

✓ অতিরিক্ত চর্বি, লবণ ও মশলাযুক্ত খাবার গুলো বর্জন করতে হবে। যেমনঃ ভাজাপোড়া, ফাস্টফুড, পিজ্জা, পটেটো চিপস, টমেটো সস, প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত মরিচের গুঁড়া, পনির ইত্যাদি।

✓ কার্বোনেটেড বেভারেজ তথা কোমল পানীয় পান করা উচিত নয়। কারণ তাতে ঢেকুর উঠে যার মাধ্যমে পাকস্থলী থেকে গ্যাস উপরের দিকে উঠে আসে।

কফি পানের অভ্যাস সীমিত করতে হবে।

✓ খাবারের সাথে সালাদ হিসেবে কাঁচা পেঁয়াজ না খাওয়াই ভালো।

তবে অনেকের জন্যই উপরে উল্লেখিত খাবার গুলো একেবারে বর্জন করা হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে পরিমাণে যতটা সম্ভব কম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এবং সেই সাথে Dr. Ekta Gupta এর পরামর্শ হলো এসব খাবার অন্তত পক্ষে রাতের বেলায় বর্জন করে চলতে পারেন।

গ্যাসের সমস্যার সমাধান (কয়েক মিনিটে)

গ্যাসের সমস্যার ঘরোয়া সমাধান হিসেবে বেশ কয়েকটি অসাধারণ প্রাকৃতিক পদ্ধতি রয়েছে। সবগুলো পদ্ধতির মধ্যে এখানে যে সমাধানটি উল্লেখ করা হয়েছে তা খুব কার্যকর এবং তৈরি করা অত্যন্ত সহজও বটে। মাত্র ২টি উপাদান লাগবে প্রাকৃতিক এই ওষুধটি তৈরি করতে-

  • লেবু এবং
  • বেকিং সোডা

তৈরির নিয়মঃ

একটি গ্লাসে একটি বড় লেবু বা দুটি মাঝারি আকারের লেবু চিপে রস বের করে নিন। এরপরে লেবুর রসে এক চা চামচ বেকিং সোডা যোগ করুন। এটি ধীরে ধীরে করতে হবে কারণ সোডা দেয়ার সাথে সাথে বুদবুদ করে ফেনা উঠতে শুরু হবে। এবার পানি যোগ করুন যতক্ষণ না মিশ্রণটি অর্ধেক গ্লাস পর্যন্ত হয়। ব্যাস! তৈরি হয়ে গেল ওষুধটি।

যখনই মনে হবে আপনার বদহজম হচ্ছে বা গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে, তখনই এটি তৈরি করে খেয়ে নিন। এতে খুব ভাল উপকার পাবেন। এই প্রতিকারটি একই সাথে প্রাকৃতিক, সুস্বাদু এবং আপনার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো। এই ওষুধটি গ্রহণের পরে আপনার কোনো গ্যাসের সমস্যা থাকবে না এবং আপনার পেটও আর ফুলে ফেঁপে থাকবে না।

গ্যাসের সমস্যা হলে কি করা উচিত 

গ্যাসের সমস্যা হলে কি করা উচিত 

গ্যাসের সমস্যায় প্রাথমিকভাবে উপরে উল্লেখিত নিয়মগুলো এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমেই সহজ সমাধান পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। তবে যদি এই সমস্ত নিয়ম মানার পরেও কোনো পরিবর্তন দেখা না দেয় তবে সেটা হতেও পারে জটিল কোনো রোগের সংকেত। আর এমতাবস্থায় ঠিক কি কারণে আপনার বদহজম বা গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একজন ভালো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। 1

এছাড়াও নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে সেক্ষেত্রে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

  • তীব্র ব্যথা (পেটে অথবা বুকে)
  • প্রায়শই বমি বমি ভাব বা বমি
  • খাবার গিলতে বেশ অসুবিধা বোধ
  • কফের সাথে রক্তের উপস্থিতি
  • কালো পায়খানা হওয়া
  • রক্তস্বল্পতা (Anemia) ইত্যাদি

গ্যাসের সমস্যা সাধারণত জটিল আকার ধারণ করে না। আর তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্যাসের সমস্যা দূর করতে ঘরোয়া উপায় সমূহ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু জটিল লক্ষণ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। তবে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই কারণ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সুস্থ জীবন যাপন করা সম্ভব।

 

 

 

References

Gupta, E. (n.d.). GERD Diet: Foods That Help with Acid Reflux (Heartburn). Retrieved from Johns Hopkins Medicine: https://www.hopkinsmedicine.org/health/wellness-and-prevention/gerd-diet-foods-that-help-with-acid-reflux-heartburn?amp=true

Harvard Medical School. (2021, 11 16). 9 ways to relieve acid reflux without medication. Retrieved from Harvard health Publishing: https://www.health.harvard.edu/digestive-health/9-ways-to-relieve-acid-reflux-without-medication

 

Last Updated on April 15, 2023