ক্যালরি ও বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান পাওয়ার জন্য খাবার খাওয়া হয়। কিন্তু সেই খাবার যদি টক্সিন বা শরীরের জন্য ক্ষতিকর উপাদান সমৃদ্ধ হয় তবে সেটা সত্যিই উদ্বেগজনক।  

আমরা নিজেদের অজান্তেই প্রতিনিয়ত টক্সিন সমৃদ্ধ বিভিন্ন খাবার খেয়ে চলেছি যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য খাবারের টক্সিন সম্পর্কে জানা এবং খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। 

এই অনুচ্ছেদে খাদ্যের ৬ টি টক্সিন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। কিভাবে টক্সিন সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলা সম্ভব সেই সম্পর্কে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

কৃত্রিম ট্র্যান্স ফ্যাট (Trans fats) 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী ৫ বিলিয়ন মানুষ ট্র্যান্স ফ্যাটের ক্ষতিকর প্রভাবের ঝুঁকিতে রয়েছে। ট্র্যান্স ফ্যাট হার্টের রোগ সৃষ্টির অন্যতম প্রধান একটি কারণ। প্রতিবছর সারাবিশ্বে ট্র্যান্স ফ্যাটের প্রভাব জনিত হার্টের রোগের ফলে ৫ লাখ মানুষ অকাল মৃত্যু বরণ করেন। (WHO, 2023) 

ট্র্যান্স ফ্যাট রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং উপকারী কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। ট্র্যান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার ফলে হার্টের রোগ (বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক), টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও আলজেইমার্স রোগে (Alzheimer’s disease) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান Dr Tedros Adhanom Ghebreyesus বলেন, ট্র্যান্স ফ্যাটের কোনো স্বাস্থ্য উপকারিতা নেই বরং এটি স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। খাবারে ট্র্যান্স ফ্যাটের কোনো স্থান (গ্রহণযোগ্যতা) নেই, বরং সবার জন্য ট্র্যান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার বর্জন করা উচিত।  

প্রাকৃতিকভাবে কিছু খাবারের মধ্যে (দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, গরু ও খাসির মাংস) অল্প পরিমাণে ট্র্যান্স ফ্যাট থাকে। তবে ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ট্র্যান্স ফ্যাট ব্যবহার করা হয়‌। যেমনঃ বিস্কুট, চানাচুর, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ফ্রায়েড চিকেন, পোড়াতেলে ভাজা খাবার সহ প্রায় সবধরনের ফাস্টফুড।

  ট্র্যান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক খাবারগুলো যতটা সম্ভব কম খেতে হবে। আর কৃত্রিম খাবারগুলোর পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস হিসেবে বিভিন্ন ধরনের বাদাম (চীনাবাদাম, কাঠবাদাম, পেস্তা বাদাম, আখরোট ইত্যাদি), খেজুর, সূর্যমুখী বীজ, কুমড়ার বিচি ও বিভিন্ন ধরনের ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। 

বিসফেনল এ (Bisphenol A) 

bisphenol a

বিসফেনল এ (Bisphenol A; সংক্ষেপে BPA) একটি রাসায়নিক উপাদান যা বিভিন্ন প্লাস্টিকের বোতল ও বক্স তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়াও ক্যান (Cans) তৈরিতে বিসফেনল এ ব্যবহার করা হয় যেগুলোতে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের ড্রিংকস থাকে। যেমনঃ কোকাকোলা ক্যান ও বিয়ার ক্যান। 

প্লাস্টিকের সকল বোতল ও বক্স বিসফেনল এ সমৃদ্ধ হয়ে থাকে এমন নয়। বরং কিছু কিছু প্লাস্টিক সামগ্রী বিসফেনল এ মুক্ত (BPA free) হয়ে থাকে।  

প্লাস্টিকের বোতল ও বক্সের নিচে ত্রিভুজের মতো আকৃতির চিহ্ন এবং এর মধ্যে নাম্বার লেখা থাকে যাকে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং নাম্বার বলা হয়। এই নাম্বার ৭ (Plastic recycling symbol 7) হলে বুঝতে হবে যে, এতে বিসফেনল এ (BPA) রয়েছে। এছাড়াও প্লাস্টিক রিসাইক্লিং নাম্বার ৩ এর ক্ষেত্রে বিসফেনল এ থাকতে পারে।

বোতল, ক্যান বা বক্স থেকে বিসফেনল এ খাবারের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশের সুযোগ পায়। বিসফেনল এ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর যা বিভিন্ন জটিল রোগ (টাইপ-২ ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হার্টের রোগ ইত্যাদি) সৃষ্টি করতে পারে। (Spritzler, 2022) 

বিসফেনল এ থেকে বাঁচার জন্য প্লাস্টিক ও ক্যানজাত খাবার ও পানীয় যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। মাইক্রোওয়েভ ওভেনে খাবার গরম করার ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বক্স ব্যবহার না করাই উত্তম। কারণ তাপের প্রভাবে বক্স থেকে বিসফেনল এ খাবারের মধ্যে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।  

পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন 

পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন (Polycyclic Aromatic Hydrocarbons; সংক্ষেপে PAHs) জৈব জ্বালানি (কয়লা, তেল, গ্যাসোলিন ইত্যাদি) জ্বালানোর ফলে উৎপন্ন হয় এবং পরিবেশ দূষণ করে থাকে।

গরুর মাংস, মুরগি ও মাছের গ্রিল (Grilled) পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। এছাড়াও সিগারেট থেকে ক্ষতিকর এই উপাদানটি নিঃসরণ হয়। 

PAHs উপাদানটি শরীরে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের (স্তন, কোলন, কিডনি ও প্রস্টেট ক্যান্সার) ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই ক্ষতিকর এই উপাদানটি থেকে বাঁচতে মাছ ও মাংসের গ্রিল না খেয়ে বরং রান্না করে খাওয়া উচিত। এছাড়াও ধুমপানের অভ্যাস বর্জন করতে হবে।  

দারুচিনি

দারুচিনির বৈজ্ঞানিক নাম হলো Cassia cinnamon যাতে কোমারিন (Coumarin) নামক একধরনের রাসায়নিক উপাদান থাকে। অতিরিক্ত পরিমাণে কোমারিন গ্রহণ করা হলে তা লিভারের ক্ষতি সহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।  

সাধারণত রান্নার কাজে খাবারের স্বাদ ও গন্ধ বৃদ্ধির জন্য দারুচিনি ব্যবহার করা হয়। রান্নায় যতটুকু পরিমাণে দারুচিনি ব্যবহার করা হয় তাতে খুব অল্প পরিমাণ কোমারিন থাকে যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হয় না। 

শরীরের প্রতি কেজি ওজনের অনুপাতে দৈনিক ০.১ মিলিগ্রাম পরিমাণ কোমারিন গ্রহণ করা হলে তাতে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয় না। অর্থাৎ ৭০ কেজি ওজনের একজন মানুষের জন্য দৈনিক ৭ মিলিগ্রাম পর্যন্ত কোমারিন গ্রহণ নিরাপদ হিসেবে গণ্য হবে। 

এক চা চামচ (২.৫ গ্রাম পরিমাণ) দারুচিনি গুঁড়ায় ৭ থেকে সর্বোচ্চ ১৮ মিলিগ্রাম পর্যন্ত কোমারিন থাকতে পারে। তবে এতো বেশি পরিমাণে দারুচিনি সাধারণত খাওয়া হয় না বলে ভয়ের কিছু নেই। শিশুদের জন্য নিরাপদ মাত্রা বড়দের তুলনায় কম। তাই রান্না ব্যতীত অতিরিক্ত দারুচিনি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

চিনি বা সুগার 

sugar

চিনি কে বলা হয় হোয়াইট পয়জন বা সাদা বিষ। চিনি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর একথা প্রায় সবারই জানা। শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সাথে চিনি খাওয়ার যোগসূত্র রয়েছে।

খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য চিনি যোগ করা হয়ে থাকে। যেমনঃ বিস্কুট, পাউরুটি, কেক, বোতলজাত ফলের জুস, কোমল পানীয় ও মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। 

মাছে মার্কারি 

মাছ খুব স্বাস্থ্যকর একটি খাবার যা ভালো মানের প্রোটিন ও শরীরের জন্য উপকারী ফ্যাট (ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড) সরবরাহ করে। তবে মাছে কোনো ক্ষতিকর উপাদান নেই একথা বলা‌ যায় না। কারণ মাছে মার্কারী (Mercury) থাকে যা স্নায়ুতন্ত্রের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। 

মিঠা পানির মাছের তুলনায় সামুদ্রিক মাছে মার্কারী থাকার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি। তবে মাছে মার্কারীর পরিমাণ এতোই সামান্য যে ক্ষতির সম্ভাবনা খুবই কম।‌ বরং সামুদ্রিক মাছ তুলনামূলক বেশি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হয়ে থাকে ফলে মার্কারীর ভয়ে মাছ বর্জন করা উচিত হবে না।  

নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে পরিমিত পরিমাণে সামুদ্রিক মাছ খেতে হবে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, স্তন্যদানকারী মা ও শিশুদের জন্য সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২ দিনের বেশি সামুদ্রিক মাছ খাওয়া উচিত হবে না।

References

Spritzler, F. (2022, August 01). 6 ‘Toxins’ in Food That Are Actually Concerning. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/food-toxins-that-are-concerning

WHO. (2023, January 23). Five billion people unprotected from trans fat leading to heart disease. Retrieved from WHO: https://www.who.int/news/item/23-01-2023-five-billion-people-unprotected-from-trans-fat-leading-to-heart-disease

Last Updated on December 21, 2023