ফাস্টিং অর্থ হলো উপবাস করা। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (Intermittent fasting বা সংক্ষেপে IF) এর ধারণা অনেক আগে থেকেই প্রচলন ছিল। তবে ২০১২ সালে ডা: মাইকেল মোসলে বিবিসিতে একটি প্রোগ্রাম করেন যার মূল বিষয়বস্তু ছিল উপবাস করার মাধ্যমে সুস্থ থাকা। এর পর থেকে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর জনপ্রিয়তা অনেকগুণ বেড়ে যায়। (Harvard Medical School, 2021)
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং মেটাবলিজম বৃদ্ধি করে কিনা এবং শরীরের ওজন কমানোর ক্ষেত্রে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ভূমিকা সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং কি মেটাবলিজম বৃদ্ধি করে?
এই প্রশ্নের উত্তর বোঝার জন্য প্রথমত মেটাবলিজম সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে। সহজভাবে বলতে গেলে মেটাবলিজম বলতে শরীরের ক্যালরি উৎপাদন প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়।
আমরা যে খাবার খাই তা হজম হয়ে অন্ত্রের মাধ্যমে শোষণ হয় এবং রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে শরীরের প্রত্যেকটি কোষে পৌঁছায়। অতঃপর মেটাবলিজম বা বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য থেকে ক্যালরি উৎপন্ন হয় যা শরীরের বিভিন্ন কাজে ব্যয় হয়।
যখন উপবাস করা হয় অর্থাৎ কোষে পর্যাপ্ত খাদ্য উপাদান না থাকে সেই সময়টাতে ক্যালরি চাহিদা পূরণের জন্য শরীরে জমে থাকা ফ্যাট ভেঙে ক্যালরি উৎপন্ন হয়।
ফ্যাট থেকে ক্যালরি উৎপন্ন হওয়ার জন্য মেটাবলিজমের গতি বেড়ে যায়। অর্থাৎ ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং মেটাবলিজম বৃদ্ধি করে।
তবে দীর্ঘসময় (একটানা ৩ দিনের বেশি) পর্যন্ত না খেয়ে থাকার ফলে শরীরের পেশী ক্ষয় হতে থাকে। আর পেশী ক্ষয় হওয়া মানে হলো মেটাবলিজমের গতি কমে যাওয়া। তাই অনেক বেশি সময় পর্যন্ত উপবাস করা যাবে না।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ওজন কমানোর জন্য কার্যকর
শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য কার্যকরী একটি উপায় হলো ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করা। বিভিন্ন সময়ের গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং শরীরের ওজন কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। (West, 2021)
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করার প্রচলিত ৩টি উপায় নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।
১৬:৮
সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হলো ১৬:৮ ডায়েট অর্থাৎ একটানা ১৬ ঘন্টা উপবাস করা এবং বাকি ৮ ঘন্টা খাবার খাওয়া।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ক্ষেত্রে রোজার মতো একদম কিছুই খাওয়া যাবে না তা নয়। বরং উপবাসের সময় ক্যালরি নেই এমন খাবার ও পানীয় পান করা যাবে। যেমনঃ দুধ ও চিনি ছাড়া চা ও কফি, পানি, শশা, টমেটো, আঙ্গুর, শাকসবজি ইত্যাদি।
৫:২
সপ্তাহে ৫ দিন স্বাভাবিক খাবার খাওয়া এবং বাকি ২ দিন (একটানা হওয়া জরুরী নয় বরং যেকোনো ২ দিন হলেও চলবে) উপবাস করতে হবে। এছাড়াও উপবাসের দিনগুলো খুব কম ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া যেতে পারে।
১ দিন পর পর উপবাস করা
এ নিয়মে একদিন পর পর উপবাস করতে হয়। তবে উপবাসের দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ ক্যালরি গ্রহণ করা যাবে। ৫০০ ক্যালরির জন্য ১টি কলা, ১টি সিদ্ধ ডিম এবং শাকসবজি খেতে হবে।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর মাধ্যমে শরীরের ওজন কমানোর ক্ষেত্রে মাংসপেশী ক্ষয় হয় না। তবে এর জন্য উপবাসের দিন বাদে বাকি দিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত প্রোটিন জাতীয় খাবার রাখতে হবে।
প্রোটিন পেশীর গঠন ঠিক রাখতে সাহায্য করে এবং পরিমিত পরিমাণে প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়া হলে তা শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না।
শরীরের প্রতি ১ কেজি ওজনের জন্য দৈনিক সর্বোচ্চ ২ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা যাবে। অর্থাৎ ৭০ কেজি ওজনের একজন মানুষ দৈনিক সর্বোচ্চ ১৪০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করতে পারবে।
স্বাস্থ্যকর প্রোটিন জাতীয় খাবার বলতে মাছ, ডিম, মুরগির মাংস, ফ্যাট-ফ্রি দুধ, বাদাম, ডাল ইত্যাদি বোঝানো হয়।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ফ্যাট বার্নিং হরমোন বাড়ায়
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ক্ষেত্রে ফ্যাট বার্নিং হওয়ার জন্য শরীরে হরমোনের মাত্রা পরিবর্তন হয়।
ইনসুলিন
প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন নামক হরমোন নিঃসরণ হয় যা মেটাবলিজমের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের ফলে শরীরে ফ্যাট জমা হতে থাকে এবং শরীরের ওজন বেড়ে যায়।
পক্ষান্তরে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ফলে ইনসুলিন সেনসিটিভিটি (রেজিস্ট্যান্সের বিপরীত) বেড়ে যায় যার ফলে শরীরে জমে থাকা ফ্যাট ভেঙে ক্যালরি উৎপন্ন হয় তথা শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমে যায়।
গ্রোথ হরমোন
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ফলে গ্রোথ হরমোন (Human growth hormone) নিঃসরণ এর পরিমাণ কিছুটা বেড়ে যায় যা শরীরের ফ্যাট ভেঙে ক্যালরিতে রুপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। এছাড়াও পেশীর গঠন ঠিক রাখতে (যেন পেশী ক্ষয় না হয়) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নরএপিনেফ্রিন (Norepinephrine)
মানসিক চাপের ফলে এডরেনাল গ্ল্যান্ড থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ হয় যা শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার একটি অন্যতম কারণ।
নরএপিনেফ্রিন হরমোনকে কর্টিসলের ঠিক বিপরীত বলা যায়। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ফলে নরএপিনেফ্রিন নিঃসরণ বেড়ে যায় যা শরীরে জমে থাকা ফ্যাট ভেঙে ক্যালরি উৎপন্ন হতে সাহায্য করে।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর অন্যান্য উপকারিতা
শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করা ছাড়াও ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ফলে আরো যেসব উপকারিতা পাওয়া যায় তা হলোঃ (Gunnars, 2022)
- ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমাতে সাহায্য করে যা রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়।
- বয়সজনিত মস্তিষ্কের রোগ এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- কোষের অকাল মৃত্যু ঠেকায় এবং আর্থ্রাইটিসের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর উপকারিতা পাওয়ার জন্য অস্বাস্থ্যকর খাবার (চিনি, মিষ্টিজাতীয় খাবার, ভাত বিস্কুট, চিপস, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, চর্বিযুক্ত মাংস ইত্যাদি) যতটা সম্ভব বর্জনের চেষ্টা করতে হবে।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং চলাকালীন সময়ে মৃদু প্রকৃতির ব্যায়াম করা যেতে পারে। যেমনঃ হাঁটাহাঁটি, সাঁতার কাটা, ইয়োগা ইত্যাদি।
শেষ কথা
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং মেটাবলিজম বৃদ্ধি করে এবং শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে।
তবে গর্ভবতী নারী, স্তন্যদানকারী মা, শিশু, ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তি, উচ্চ রক্তচাপের রোগী বা অন্য কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
References
Gunnars, K. (2022, 06 16). Intermittent Fasting 101 — The Ultimate Beginner’s Guide. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/intermittent-fasting-guide
Harvard Medical School. (2021, February 28). Intermittent fasting: The positive news continues. Retrieved from Harvard Medical School: https://www.health.harvard.edu/blog/intermittent-fasting-surprising-update-2018062914156
West, H. (2021, 08 13). Does Intermittent Fasting Boost Your Metabolism? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/intermittent-fasting-metabolism
Last Updated on December 31, 2023
Leave A Comment